[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

সংস্কারের বাজারে সালেহউদ্দিন আসছেন পুরনো ছকের ‘সরল’ বাজেট নিয়ে

প্রকাশঃ
অ+ অ-

নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা

রাজনৈতিক পালাবদলে জনমানসে যখন সর্বত্র পরিবর্তনের প্রত্যাশা, সংস্কারের ছোঁয়ায় যখন অর্থনীতিকে নতুন আঙ্গিক দেওয়ার কথা, সেই সময় অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ আসছেন ‘সরল’ বাজেট নিয়ে।

তার হাত দিয়েই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত কিছুটা কমছে বাজেটের আকার। এর বাইরে আর কোনো চমক তিনি দিতে যাচ্ছেন– তেমনটা শোনা যায়নি। নতুন অর্থবছরের বাজেটে তিনি অভাবনীয় কিছু করতে যাচ্ছেন–তেমন ইঙ্গিতও মেলেনি।

রাজনৈতিক সরকারের মত নির্বাচনি ইশতেহার পূরণের জনতুষ্টির বাজেট দেওয়ার চাপ সালেহউদ্দিনের ছিল না। বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প শুরুর কোনো দায়ও অন্তর্বর্তী সরকারের নেই।

সাবেক এই গভর্নর তার বাজেটের হিসাব মিলিয়েছেন বহু বছরের চর্চার সেই পুরনো সমীকরণে। চাপে থাকা অর্থনীতির বাস্তবতা মেনেই তাতে থাকছে সংযত ভাব। 

সোমবার বিকাল ৩টায় জাতির উদ্দেশে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব পেশ করতে যাচ্ছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। সংসদ না থাকায় তার বাজেট বক্তৃতা সম্প্রচার করা হবে টেলিভিশনের মাধ্যমে।

এ পর্যন্ত যে আভাস পাওয়া গেছে, তাতে ব্যয়ের লাগাম টেনে বাজেট ঘাটতি ধরা হচ্ছে ১৪ বছরের সর্বনিম্ন। আর সেই অংক সীমাবদ্ধ থাকছে জিডিপির ৩ দশমিক ৬২ শতাংশের মধ্যে।

বাজেটের আগে  এক সাক্ষাৎকারে অর্থ উপদেষ্টা ‘সরল’ বাজেট দেওয়ার কথা বলেছেন, যেটি হবে ‘বাস্তবমুখী’। 

স্বাধীনতার পর প্রথমবার বাজেটের আকার বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে কমিয়ে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার আশপাশে (জিডিপির ১২ দশমিক ৬৫ শতাংশ) ধরা হচ্ছে। বিদায়ী অর্থবছরের চেয়ে শূন্য দশমিক ৮৮ শতাংশ কমছে আকার; টাকার অংকে যা সাত হাজার কোটির মত।

তবে সংশোধিত বাজেটের চেয়ে প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ৬ দশমিক ১৮ শতাশ বেশি থাকছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর রেখে যাওয়া ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার চলতি বাজেট (চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের) অন্তর্বর্তী সরকার সংশোধন করে ৭ লাখ ৪০ কোটি টাকায় নামিয়ে এনেছিল।

ব্যয় কিছুটা কমানোর কারণে ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রাও আগেরবারের চেয়ে কমিয়ে ধরা হচ্ছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। বিদায়ী অর্থবছরে যা ছিল ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা; জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ।  

২০১১-১২ সালের পর আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘাটতি (৩ দশমিক ৬২ শতাংশ) সবচেয়ে কম। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের পর থেকে ঘাটতি সবসময়ই ৪ দশমিক ৯ শতাংশের বেশি ছিল।

বাস্তবতার সঙ্গে মিল রাখতেই ঘাটতি কমিয়ে বাজেটের আকার ছোটো রাখার কথা বলেছেন প্রায় দেড় যুগ আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব সামলে আসা সালেহউদ্দিন।

তবে প্রথমবারের মত বাজেট দিতে গিয়ে তিনি জিডিপির প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৫ শতাংশে ওঠানো ও মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার যে লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করতে যাচ্ছেন তা যথেষ্টই উচ্চাভিলাষী।

পুরনো কাঠামোই থাকছে?
অভ্যুত্থানের পর ভিন্ন বাস্তবতায় রাজনৈতিক চাপ না থাকায় নতুন কিছু করার সুযোগটা নেননি অর্থনীতিবিদ সালেহউদ্দিন আহমেদ। কেননা এ বাজেটের কতটা তিনি বাস্তবায়ন করতে পারবেন সেই দিনলিপিও তার জানা নেই।

উল্টো সংস্কারের তোড়জোড়ের মধ্যে নির্বাচনি পথনকশার ডামাডোল সময়টাকে অস্থির করে তুলেছে; অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য আর বিনিয়োগের জন্য অনিশ্চিত পরিবেশ তৈরি করেছে। আবার একটি মাত্র বাজেট দিয়েই সবকিছু খোলনলচে পাল্টে দেবেন এমন যাদুমন্ত্রও তার হাতে নেই।

এ কারণে ‘আটসাঁট’ বাজেট দেওয়ার কথা বারবার বলা হলেও আসছে বাজেটে আগের পুরনো কাঠামোরই ‘পুনরাবৃত্তি’ দেখতে পাচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।

সাবেক আমলা ও অর্থনীতির শিক্ষক সালেহউদ্দিন আহমেদও মানছেন সে কথা। বৃহস্পতিবার বিকালে  দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'বাজেট এমন কিছু না যে একেবারে মৌলিক পরিবর্তন এনে এক বছরে বাস্তবায়ন করে ফেলব। ধাপে ধাপে পরিবর্তন করতে হবে। এবারের বাজেট বাস্তবতার ভিত্তিতে যতটা সম্ভব যুক্তিযুক্ত ও সরল রাখার চেষ্টা করেছি।' 

এমন যুক্তির মাঝেও তার কাছে অনেকের ভিন্ন অভিপ্রায় ছিল। অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী চেয়েছিলেন অতীতের জঞ্জাল দূর করে একটি ‘স্মার্ট বাজেট’।  

অরাজনৈতিক সময়ে, ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটের কারণে এ বাজেট নিয়ে প্রত্যাশার কথা বলেছেন আরেক অর্থনীতিবিদ সাউথ এশিয়ান নেটয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হানও।

বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, 'এটা আমরা বুঝি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে সময়টা অগাস্টের পরে পেয়েছে, প্রায় নয় মাসের মত সময় তারা পেয়েছে। কিন্তু তারপরও যে বাজেটটা প্রস্তাবিত হতে যাচ্ছে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে, সেখানে পুরনো যে বাজেট কাঠামো তার বাইরে গিয়ে আমরা যতটুকু খবর পাচ্ছি, খুব বেশি নতুন কিছু করার বিষয় নেই।' 

পুরনো ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বাজেট দেওয়া হচ্ছে বলে সমালোচনাও করেন তিনি। বলেন, 'আমরা দেখছি সেই বাজেটের ওপর বেইজ করে, সেই যে তথ্য-উপাত্তগুলো, যেগুলো নিয়ে আমরা চ্যালেঞ্জ করেছিলাম শ্বেতপত্র কমিটিতে, বাজেট হচ্ছে।  আমরা জিডিপির ফিগার নিয়ে চ্যালেঞ্জ করেছি, ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টসের যে তথ্যগুলো, বিনিয়োগ এবং অন্যান্য ডেটা নিয়ে আমরা চ্যালেঞ্জ করেছি। বলেছি, অনেক ক্ষেত্রে ম্যানিপুলেশন আছে; তথ্যগত ভুল আছে। কোনো কোনো জায়গায় বানিয়ে বলা হত। সেগুলো কিন্তু কোনো ধরনের পরিবর্তন হয়নি এবং সেগুলোর ওপর বেইজ করে কিন্তু নতুন আবার এই বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে।' 

গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এবারের বাজেটেও ‘নতুন মোড়কে পুরাতন গল্পই’ লেখা হবে বলে মনে করছেন।

শনিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, দু:খজনকভাবে এবারের বাজেটও গতানুগতিক হতে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণ আদায়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত এবং করের আওতা বাড়ানোর মত নতুন কোনো কিছু না থাকায় এবারের বাজেটে নতুন কোনো চমক থাকছে না।

 প্রত্যাশার চাপ কতটা?

সবশেষ সংসদের বাইরে বাজেট দেওয়া হয়েছিল ২০০৮ সালে। তখন ক্ষমতায় ছিল সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

ওই বছরের ৯ জুন তখনকার অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম ২০০৮-০৯ অর্থবছরের জন্য ৯৯ হাজার ৯৬২ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছিলেন।

সেদিনও ছিল সোমবার। বেলা ৩টায় বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে সম্প্রচার করা হয়েছিল মির্জ্জা আজিজের বাজেট বক্তৃতা।

এবারও টিভি ও বেতারে বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থ উপদেষ্টা। এরপর ৩০ জুন রাষ্ট্রপতি বাজেট অধ্যাদেশে সই করবেন। সেটাই হবে অনুমোদন।

তবে বাজেটের অনেক অংশ, বিশেষ করে ট্যাক্স ও কাস্টমস সংক্রান্ত বিষয়গুলো ২ জুন থেকেই কার্যকর হবে। অন্য বরাদ্দগুলো ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন অর্থ উপদেষ্টা।

ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের দেড় দশকের অবসান শেষে রাষ্ট্র সংস্কারের একগুচ্ছ কার্যক্রমের মধ্যেই নতুন অর্থবছর সমাগত।

বরাবরের মত টানাটানির বাজেট করতে অর্থ উপদেষ্টাকে হিমশিম খেতে হলেও তার কাছে প্রত্যাশার শেষ নেই।

কালো টাকা, খেলাপি ঋণ, পাচার করা অর্থ পুনরুদ্ধার, বেহাল আর্থিক খাতের অবস্থা ফেরানোসহ নানা দুশ্চিন্তার মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে চারিদিকে দাবি দাওয়ার মহোৎসব দেখা গেছে বেশ কয়েক মাস ধরে। প্রাক বাজেট আলোচনায় সব পক্ষই নিজেদের জন্য আরও কিছু ভালো চেয়েছে।

সাবেক অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজ তার সময়কার এবং এবারের বাজেটের সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার তুলনামূলক বিচারে বলেন, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিভিন্ন দলের মধ্যে ‘মতপার্থক্য’ না থাকায় মানুষের মধ্যে ‘স্বস্তির পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল’। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন দল ভিন্ন ভিন্ন দাবি-দাওয়া পেশ করছে, যা আবার ‘সামঞ্জস্যপূর্ণ না’- যা বাজেটের কাজকে কঠিন করে তুলেছে।

তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ী নেতা মোহাম্মদ হাতেম বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার আসার পরে বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে অর্থনীতি অনেকটা চাঙা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের শিল্প খাত অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘আইসিইউতেই’ রয়েছে বলা যায়। আইসিইউ থেকে বের করতে হলে এখনও কিছু ক্ষেত্রে প্রণোদনা প্রয়োজন।

সংস্কারের আবহের মধ্যে সংযত বাজেট করতে গিয়ে এমন সব চাহিদাপত্র পাচ্ছেন সালেহউদ্দিন আহমদ।

রাজনৈতিক ও বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার চাপ শুরু থেকেই ছিল অর্থ উপদেষ্টার সামনে। এর মধ্যে সংস্কারের পথে এগিয়ে গিয়েও সরকারি কর্মচারীদের বাধায় এনবিআর ও সরকারি চাকুরে আইন থেকে পিছুটান দিতে হয়েছে সরকারকে।

সব ছাপিয়ে নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকেই বড় করে দেখছেন অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তার মতে, দেশে এখন বিনিয়োগের ‘পরিবেশ নেই’। এরকম অবস্থায় ব্যবসায়ীরা ‘টাকা পকেটে রাখাই পছন্দ করেন’।

এ নিয়ে সুরাহা হলে বিনিয়োগকারীরা ‘পরিষ্কার’ বার্তা পাবেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তখন বিনিয়োগকারীরা ওদিক থেকে বলবেন, এখন একটা মেঘ কেটে গেছে।”

অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারের পথ ধরে ভেঙে পড়া পুরনো ব্যবস্থা থেকে যেমন উত্তরণ ঘটবে, তেমনি এ অনিশ্চয়তাও কাটবে বলে আশা তার।

অর্থনীতির শিক্ষক সেলিম রায়হানও জোর দিচ্ছেন এ বিষয়ে। চলমান অস্থিরতা নিরসনের পাশাপাশি বাজেটে বিনিয়োগবান্ধব সিদ্ধান্ত নেওয়ার তাগিদ দেন তিনি।

বাজেটে এই সমস্যার সমাধানে নির্দেশনা থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনি। বলেন, বিনিয়োগ বাড়াতে সুদহার, করনীতিতেও পরিবর্তন আনা উচিত।

দারিদ্র্য বিমোচনে মূল্যস্ফীতির টেকসই নিয়ন্ত্রণ জরুরি মন্তব্য করে তিনি সামাজিক সুরক্ষা খাতেও পরিবর্তনের পরামর্শ দেন।

চাপের মধ্যেও সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা খাত থাকা উচিত বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক সেলিম রায়হান।

অন্তর্বর্তী সরকারের এ বাজেট নিয়ে নিজের প্রত্যাশার কথা বলেছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরী।

তিনি বলেন, 'এই সরকার যেহেতু কোনো রাজনৈতিক সরকার নয়। এই সরকারের একটা লক্ষ্য হওয়া উচিত, এই বাজেটটা একটা আদর্শ বাজেট হিসেবে তৈরি করা। বর্তমান সরকারের যে বাজেটটা আসছে, তা যেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ একটা বাজেট হয়। বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠী উপকৃত হতে পারে। একটি ‘আদর্শ’ বাজেট সামনের দিনে সব রাজনৈতিক সরকারকে ‘অনেক দূর এগিয়ে যেতে’ সহায়তা করবে বলে মনে করেন মুজেরী।' 

তার বিচারে, 'কেবল মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না। সেজন্য ব্যবসার সুস্থ পরিবেশ যেমন গড়ে তুলতে হবে, তেমনি দরকার হবে পণ্যভিত্তিক বাজার ব্যবস্থাপনা।'

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই প্রধান অর্থনীতিবিদের মতে, 'কর্মসংস্থান তৈরির জন্য অর্থনীতিকে সচল করতে হবে। সেজন্য রাজনৈতিক পরিবেশটাও গুরুত্বপূর্ণ।'

তার মতে, বাজেটের অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন ব্যয়ের একটি বড় অংশ দুর্নীতি ও অপচয় হয়। অরাজনৈতিক সরকার এই খাতে নিয়ন্ত্রণ আনতে পারে, অনুন্নয়ন ব্যয় যতটা সম্ভব কমিয়ে আনতে পারে, প্রকল্পের দুর্নীতি বন্ধ করতে পারে।

বিনিয়োগ নিয়ে ধুঁকছে সরকার। বিদেশি বিনিয়োগ অনেক কমেছে, দেশের কারখানা সম্প্রসারণের কাজও থমকে আছে।

এমন অবস্থায় ‘নীতির ধারাবাহিকতার’ ওপর জোর দেন জাহিদ হোসেন। বিশেষত কর নীতির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের মনোযোগ থাকার কথা তুলে ধরেন তিনি।

মহামারী থেকে পুনরুদ্ধারের সময়কাল থেকে চড়তে থাকা মূল্যস্ফীতিতে দেশের অর্থনীতি দুর্বল হচ্ছে। প্রান্তিক মানুষ ভুগছে বছর তিনেক ধরে।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে দফায় দফায় নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। এতে বাজারে অর্থের চাহিদা কমে বিনিয়োগে টান পড়ছে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ঘরে নেমেছে।

অভ্যুত্থানের পর দায়িত্বে আসা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট দিতে যাওয়ার আগের এমন পরিস্থিতিতে বাজেট প্রণয়নের উপায় বাতলাতে গিয়ে মির্জ্জা আজিজ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রাজস্ব আহরণ, ব্যয়ের মাত্রা নির্ধারণ ও ঘাটতি বাজেট তৈরিতে অভ্যন্তরীণ বা বিদেশি ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে খেয়াল রাখার কথা বলেন।

একই সঙ্গে সামষ্টিক অর্থনীতির বর্তমান সমস্যা বিশেষ করে জিডিপির অর্থাৎ মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়ার দিকে নজর দেওয়ার পরার্মশ দেন।

এ অবস্থায় দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি ‘হোঁচট’ খেতে পারে বলে শঙ্কা তার। 

ব্যবসাবান্ধব বাজেট, আর কী বললেন অর্থ উপদেষ্টা

প্রথমবারের মত বাজেট দিতে আসা অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিনের সামনে বাধা অনেক, দুশ্চিন্তাও কম নয়। মোটা দাগে তার সামনে চ্যালেঞ্জ অনেকগুলো।

টানাটানির বাজেটে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি আর মানুষের জীবনমানও উন্নত করতে চান তিনি।

বাজেটের আগে বৃহস্পতিবার বিকালে এক সাক্ষাৎকারে অর্থ উপদেষ্টা কথা বলেছেন বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে।

আগের সরকারের সময়ে বেশি সুবিধা পাওয়া ও কম সুবিধা পাওয়াদের মধ্যে বৈষম্য কমাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন তিনি।

অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ বাড়াতে করপোরেট করহার কমানো ও করছাড় যৌক্তিক করার পাশাপাশি অহেতুক ব্যয় কমিয়ে আনার পদক্ষেপ থাকছে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন।

অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, ঘাটতি ৪ শতাংশে আটকে রাখতে সাধ্যমত চেষ্টা যেমন করা হবে, তেমনি তা মেটাতে বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভরতা থাকবে। স্বল্প আয়ের মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টাও থাকছে আগামী বাজেটে। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, দুস্থ ভাতা, প্রতিবন্ধীদের ভাতার মত অনেক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু থাকছে; অল্প হলেও বাড়বে ভাতার পরিমাণ ও সুবিধাভোগীর সংখ্যা।

‘জুলাই আন্দোলনে’ সম্পৃক্ত ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য বড় আকারে ব্যবস্থা থাকার কথা বলেছেন তিনি।

তিনি বলেন, 'আমরা মূলত ব্যবসাবান্ধব বাজেটের দিকে এগোনোর চেষ্টা করেছি। তবে সবাই সমানভাবে উপকৃত হবেন–তা নয়। যেসব খাত এতদিন কম সুবিধা পেয়েছে বা যাদের জন্য সুযোগ কম ছিল, তাদের প্রতি আলাদাভাবে নজর দেওয়া হয়েছে।' 

“ভোক্তা বা সাধারণ মানুষের জন্য, বিশেষ করে যাদের আয় সীমিত, তাদের জন্য কিছুটা স্বস্তির ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। আমরা অনেক আগে থেকেই চেষ্টা করে আসছি যে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের ভার যেন সহনীয় থাকে। এবারের বাজেটেও সেই লক্ষ্যেই কাজ করা হয়েছে।”

ভ্যাট কাঠামো সহজ করার দিকে নজর দেওয়ার কথাও বলেন অর্থ উপদেষ্টা।

আরও কিছু পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “কর অব্যাহতি ধীরে ধীরে তুলে নেওয়া হচ্ছে। শুধু প্রয়োজনীয় জায়গাগুলোতেই নির্দিষ্ট ও যৌক্তিক করছাড় থাকবে। পুরো বাজেট পরিকল্পনাই হচ্ছে বাস্তবমুখী, ব্যবসাবান্ধব ও করব্যবস্থাকে সহজ করার ভিত্তিতে।”

এবার করমুক্ত আয়সীমা বাড়বে কী? এমন প্রশ্নে ইতিবাচক জবাব দিয়ে বলেন, আগের বারের চেয়ে কিছুটা বাড়ানো হবে।

বর্তমান করমুক্ত আয়সামী সাড়ে তিন লাখ থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাব করার আভাস মিলেছে এনবিআরের তরফে।

📊 বাজেটের প্রধান উপাদান

  • ব্যয়: ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা
  • জিডিপি প্রবৃদ্ধি: সাড়ে ৫%
  • মূল্যস্ফীতি: সাড়ে ৬%
  • জিডিপি: ৬২ লাখ ৪৪ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা
  • রাজস্ব: ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা
  • অনুন্নয়ন ব্যয়: ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা
  • বাজেট ঘাটতি: ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা (জিডিপির ৩.৬২%)
  • ব্যাংক ঋণ: ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা
  • ব্যাংক বহির্ভূত ঋণ: ২১ হাজার কোটি টাকা
  • বিদেশি ঋণ: ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা
  • মোট বিনিয়োগ: জিডিপির ৩০.২৫%
  • এডিপি: ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা

🛡️ সামাজিক নিরাপত্তা ও পুনর্বাসন

  • বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী, দুস্থ ভাতা অব্যাহত
  • ভাতার পরিমাণ ও উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়বে
  • ‘জুলাই আন্দোলনে’ ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে গুরুত্ব

💰 আয়কর ও কর কাঠামো

  • ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা: ৩.৭৫ লাখ
  • ‘জুলাই যোদ্ধা’ ও মুক্তিযোদ্ধাদের করমুক্ত আয়সীমা: ৫.২৫ লাখ
  • সর্বোচ্চ আয়কর: ৩০%
  • সর্বনিম্ন আয়কর: ১০%
  • নতুন করদাতার ন্যূনতম আয়কর: ১ হাজার
  • মার্চেন্ট ব্যাংকের কর হার: সাড়ে ২৭% (পূর্বে সাড়ে ৩৭%)
  • পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য শর্ত শিথিল

📄 ভ্যাট ও উৎসে কর পরিবর্তন

  • মাসিক ভ্যাট রিটার্নের পরিবর্তে ৩ বা ৬ মাসে
  • ধান-চাল-পাট ইত্যাদির উৎসে কর: ১% → ০.৫%
  • ১৫২ পণ্যে ২% অগ্রিম কর
  • বাড়িভাড়ার ওপর উৎসে কর: ৫% → ১০%
  • সিকিউরিটিজের সুদে কর: ৫% → ১০%
  • সিগারেট বিক্রয়ে কর: ৩% → ৫%
  • ওটিটি সেবায় ১০% সম্পূরক শুল্ক

🏭 শুল্ক, ছাড় ও অন্যান্য খাত

  • আয়কর ছাড়ের মেয়াদ বাড়ানো হয়নি
  • পেট্রোলিয়াম আমদানিতে শুল্ক হ্রাস ও ট্যারিফ প্রত্যাহার
  • যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিযোগ্য ১১০ পণ্যে শুল্ক ছাড়
  • ব্যাংকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত স্থিতিতে আবগারি শুল্ক মওকুফ
  • বাণিজ্যিক আমদানিতে আগাম কর: ৫% → ৭.৫%
  • নির্মাণ সেবায় ভ্যাট: ৭.৫% → ১০%
  • অনলাইন বিক্রয়ের কমিশনে ভ্যাট: ৫% → ১৫%
  • প্লাস্টিক পণ্যে ভ্যাট: ৭.৫% → ১৫%
  • কটন সুতা ও কৃত্রিম আঁশ: প্রতি কেজি ৩ → ৫ টাকা
  • ব্লেড উৎপাদনে ভ্যাট: ৫% → ৭.৫%
  • এলএনজি আমদানিতে ভ্যাট প্রত্যাহার
Fetching live reactions...
Was this article helpful?

Comments

Comments

Loading comments…
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন