নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা
সন্জীদা খাতুন স্বপ্নলোকের সৃষ্টি করেছিলেন। বাঙালি সংস্কৃতিকে ধারণ করে আপন ঐতিহ্যে মাথা উঁচু করে বাঁচার স্বপ্ন। তাঁর তিরোধানের পরে সেই স্বপ্ন বিলীন হয়ে যাবে না। আরও উজ্জ্বল, আরও শক্তিশালী হবে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের সংগ্রাম। এমনই প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন তাঁর অনুরাগী, অনুসারী ও সুরের সঙ্গীরা।
শনিবার সন্ধ্যায় ‘বিশ্ব হতে হারিয়ে গেছে স্বপ্নলোকের চাবি’ নামে ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সংগীতজ্ঞ সন্জীদা খাতুনের প্রতি শ্রদ্ধা ও স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ ঢাকা মহানগর শাখা। ছায়ানট ভবনের রমেশ চন্দ্র দত্ত স্মৃতি মিলনায়তনে এই অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল পরিষদের শিল্পীদের সম্মেলক কণ্ঠের গান ‘তোমার সুরের ধারা’ পরিবেশনা দিয়ে। অনুষ্ঠান সাজানো হয়েছিল গান, আবৃত্তি, স্মৃতিচারণা দিয়ে।
গানের পরে সম্মিলন পরিষদের সভাপতি লোপা আহাদ তাঁর শিক্ষক ও পথনির্দেশক সন্জীদা খাতুনের স্মৃতিচারণা করেন। তিনি বলেন, বহুগুণে গুণী মানুষ ছিলেন তিনি। একাধারে সংগীতবিশেষজ্ঞ, শিক্ষক, লেখক, সংগঠক এমন অনেক রূপে তাঁকে আমরা পেয়েছি। বাইরে থেকে তাঁকে দেখে যতটা কঠিন মনে হয়েছে, কিন্তু তার ভেতরে ছিল এক মমতাময়ী কোমল রূপ। তাঁর সান্নিধ্য যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা তাঁর হৃদয়ের সেই কোমলতা অনুভব করেছেন।
এরপর ‘যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা’ গানটি গেয়ে শোনান সুমা রানী রায়। দীপ্র নিশান্ত গেয়েছেন ‘যারে নিজে তুমি ভাসিয়ে ছিলে।’ এরপর আবার স্মৃতিচারণার পালা।
পারিবারিক বন্ধু ওসমান কায়সার চৌধুরী তাঁর শৈশবে সন্জীদা খাতুনের গান শোনা, ১৯৬৭ সালে রমনার বটমূলে ছায়ানটের প্রথম পয়লা বৈশাখের প্রভাতি অনুষ্ঠান, ছায়ানট স্কুল গঠনের কঠিন সংগ্রামের দিনগুলোর স্মৃতি তুলে ধরেন শ্রোতাদের সামনে। তিনি বলেন, তাঁর মা ছিলেন সন্জীদা খাতুনের বন্ধু। আজ ছায়ানট এত বড় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে; কিন্তু সেই আজিমপুরে অগ্রণী স্কুলের শ্রেণিকক্ষে যে ছায়ানটের যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই সংগঠন চালাতে যে অর্থসংকট, যে বিপুল পরিশ্রম, ত্যাগ নিষ্ঠা ছিল তাদের, তা এখন অনেকে ভাবতেই পারবেন না। তিনি বলেন, সন্জীদা খাতুনের একটি বিশেষ গুণ ছিল যে তিনি কোনো কাজ শুরু করলে তাতে লেগে থাকতেন। আজকের ছায়ানট এর একটি বড় দৃষ্টান্ত। নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে দেশের সংস্কৃতি বিকাশের জন্য এমন করে সারা জীবন কাজ করে চলার মতো দৃষ্টান্ত বিরল।
![]() |
লাইসা আহমদ লিসা ‘চির সখা হে ছেড়ো না মোরে’ গানটি গেয়ে শোনান | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
এরপর আবার পরপর কয়েকটি গানের পালা। সুস্মিতা হক পরিবেশন করেন ‘তোমারাই করিয়াছি’, শিবেন কীর্তনীয়া শোনান, ‘যিনি সকল কাজের কাজী’, স্বাতী সরকার গেয়েছেন, ‘প্রেম এসেছিল নিঃশব্দ চরণে’।
গানের পরে আবার স্মৃতিচারণার পালা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী সন্জীদা খাতুনকে এক ‘মহিমাময় নারী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি ছাত্রজীবন থেকে পরে সহকর্মী হিসেবে সন্জীদা খাতুনের বিভিন্ন ঘটনার টুকরা টুকরা স্মৃতি তুলে আনেন। তিনি বলেন, সন্জীদা খাতুন শিক্ষক হলেও তিনি ছিলেন মাতৃসম। তাঁর সম্পর্কে কবি শঙ্খ ঘোষ যেমন বলেছেন, ‘গান তাঁর জীবিকা ছিল না, গান ছিল তার জীবন’–এর সঙ্গে একই কথা যোগ করা যায়, গান ছিল তাঁর সংগ্রামের অংশ। বহু মানুষকে তিনি জাগিয়েছেন, প্রাণিত করেছেন, উজ্জীবিত করেছেন। ভবিষ্যতে তাঁর কাজের মূল্যায়ন হতেই থাকবে। নতুন প্রজন্ম উজ্জীবিত হবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে’ আবৃত্তি করেন জাহিরুল হক খান। এরপর শুধু গান আর গান। সেমন্তি মঞ্জরি গেয়েছেন ‘জীবন যখন শুকায়ে যায়’। বুলবুল ইসলাম পরিবেশন করেন, ‘তোমায় নতুন করে পাব বলে’, সাঈদা হোসেন গেয়েছেন ‘তুমি তো সেই যাবেই চলে’, আজিজুর রহমান তুহিন গেয়েছেন, ‘দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার’,‘লাইসা আহমদ লিসা গেয়েছেন,‘ চির সখা হে ছেড়ো না মোরে’। একক গানের পরে দুটি সম্মেলক গান, ‘আসা যাওয়ার পথের ধারে’ এবং ‘এবার দুঃখ আমায়’ পরিবেশনার পর সম্মিলন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও অনুষ্ঠানের সঞ্চালক কৃষ্টি হেফাজ স্মৃতি–শ্রদ্ধার এই আয়োজনের সমাপ্তি টানেন।