আসাদুজ্জামান ঢাকা

গায়ক মাঈনুল আহসান নোবেলকে আদালত থেকে হাজতখানায় নেওয়া হচ্ছে। ঢাকা, ২০ মে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

গায়ক মাঈনুল আহসান নোবেল আদালতের কাছে দাবি করেছেন, যে নারী ধর্ষণের অভিযোগ এনেছেন, তিনি তাঁর স্ত্রী। তিনি ধর্ষণ করেননি।  

ওই নারীকে স্ত্রী হিসেবে দাবি করলেও আদালতে কাবিননামা জমা দিতে পারেননি নোবেলের আইনজীবী জসীম উদ্দিন।

ওই নারীকে সাত মাস ধরে একটি বাসায় আটকে রেখে ধর্ষণ ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে নোবেলের বিরুদ্ধে। নোবেলকে গ্রেপ্তারের পর আজ বিকেলে আদালতে হাজির করা হয়। আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডেমরা থানার পরিদর্শক (তদন্ত)  মো. মুরাদ হোসেন আজ মঙ্গলবার রাতে বলেন, ‘কণ্ঠশিল্পী নোবেল ওই নারীকে বিয়ে করেছেন, এমন কোনো কাগজপত্র আমাদের কাছে জমা দিতে পারেননি। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, যাত্রাবাড়ীর কোনো একটি বাসায় ওই নারীর সঙ্গে নোবেলের মৌখিকভাবে বিয়ে পড়ানোর একটি ঘটনা রয়েছে; কিন্তু বিয়ের কোনো রেজিস্ট্রি কাবিননামা নেই।’

ডেমরা থানার পুলিশ আদালতকে লিখিতভাবে জানিয়েছে, সাত বছর আগ (২০১৮) ফেসবুকে নোবেলের সঙ্গে ওই নারীর পরিচয় হয়। তিনি মোহাম্মদপুরের একটি ভাড়া বাসায় থেকে রাজধানীর একটি কলেজে স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষে পড়তেন। তাঁদের মধ্যে কথাবার্তা হতো। গত বছরের ১২ নভেম্বর ডেমরায় নোবেলের স্টুডিও দেখানোর জন্য ওই নারীকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। রাত আটটার দিকে তিনি (নারী) বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলে তাঁর মুঠোফোন কেড়ে নেন নোবেল। পরে মুঠোফোনটি ভেঙে ফেলেন। এরপর তাঁকে ধর্ষণ করেন এবং ধর্ষণের সেই ভিডিও ধারণ করেন নোবেল। পরে ভয় দেখিয়ে সাত মাস ধরে ওই বাসায় তাঁকে আটকে রাখা হয়।

পুলিশ আদালতকে আরও জানায়, ওই নারীকে নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর তাঁর (নারী) বাবা-মা ঢাকায় আসেন। পরে ওই নারীকে নোবেলের বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মুরাদ হোসেন বলেন, ভুক্তভোগী নারী এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস (ওসিসি) সেন্টারে ভর্তি আছেন।

নোবেল কাঠগড়ায়

বেলা তিনটার দিকে আদালতের কাঠগড়ায় নেওয়া হয় নোবেলকে। কাঠগড়ায় দাঁড়ানো নোবেলের ডান হাতে ছিল হাতকড়া। পরনে সাদা রঙের টি-শার্ট আর কালো রঙের প্যান্ট। পায়ে প্লাস্টিকের স্যান্ডেল। তাঁকে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। কাঠগড়ার পাশেই ছিলেন ১০ জন পুলিশ সদস্য।

বেলা তিনটার পর কিছুক্ষণ পর এজলাসে আসেন বিচারক।
রাষ্ট্রপক্ষ থেকে একজন পুলিশ কর্মকর্তা মাঈনুল আহসান নোবেলের নাম ধরে ডাকেন।

তখন নোবেল হাত উঁচু করেন।

ওই পুলিশ কর্মকর্তা আদালতের উদ্দেশে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, নোবেলের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও মারধরের অভিযোগে মামলা হয়েছে।’

তখন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী আদালতকে বলেন, ‘কণ্ঠশিল্পী নোবেলের বিরুদ্ধে একজন ভুক্তভোগী ধর্ষণের মামলা করেছেন। ওই ভুক্তভোগী নারীর সঙ্গে নোবেলের পরিচয় হয়েছিল ফেসবুকে। পরে ওই নারীকে গত বছরের ২৪ নভেম্বর ডেমরা একটি বাসায় ডেকে নেন নোবেল। পরে ওই নারীকে তিনি ধর্ষণ করেন।’

ভুক্তভোগী নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ অস্বীকার করেন নোবেলের আইনজীবী মো. জসীম উদ্দিন। তিনি আদালতকে বলেন, ‘আমার মক্কেল নোবেল একজন জনপ্রিয় শিল্পী। আমার মক্কেলের বিরুদ্ধে যিনি মামলা করেছেন, তিনি নোবেলের স্ত্রী। চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা তিনি।’

নোবেলের আইনজীবীর কাছ থেকে এই কথা শোনার পর আদালত ওই আইনজীবীর কাছে জানতে চান, আপনারা যে বলছেন, মামলার বাদী নোবেলের স্ত্রী। কিন্তু এর প্রমাণ কী। কাবিননামা এনেছেন?

এ সময় পিপি ওমর ফারুক ফারুকী আদালতকে বলেন, মামলার বাদী যদি নোবেলের স্ত্রী হন, তাহলে কাবিননামা কোথায়? কাবিননামাই তো বিয়ের একমাত্র প্রমাণ। কাবিননামা জমা না দিয়ে মামলার বাদীকে স্ত্রী দাবি করা ঠিক নয়। মূলত নোবেল ওই নারীকে ব্ল্যাকমেল করে দিনের পর দিন ধর্ষণ করেছেন।

তখন আইনজীবী জসীমউদ্দীন আদালতকে বলেন, মাননীয় আদালত, নোবেলের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর পারিবারিক মনোমালিন্য হয়েছিল। পরে পুলিশ তাঁকে ডাকলে নিজেই তিনি থানায় যান। থানা-পুলিশ নোবেলকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে চালান দিয়েছে। যে কারণে বিয়ের কাবিননামাসহ অন্যান্য কাগজপত্র তাৎক্ষণিকভাবে জোগাড় করতে পারেননি।

নোবেল আদালতের কাছে দাবি করেছেন, যিনি মামলা করেছেন, তিনি তাঁর স্ত্রী।

আদালত উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে নোবেলকে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

এরপর বিচারক এজলাস ছেড়ে যান।

একজন পুলিশ সদস্য কাঠগড়ায় নোবেলের মাথায় হেলমেট পরিয়ে দেন। তাঁর দুই হাত পেছনে নিয়ে পরিয়ে দেন হাতকড়া। আটতলা থেকে লিফটে করে নোবেলকে নেওয়া হয় নিচতলায়। বৃষ্টি হচ্ছিল তখন। বৃষ্টির মধ্যে নোবেলকে আদালতের বারান্দা থেকে দ্রুত হাজতখানায় নিয়ে যায় পুলিশ।

নির্যাতনের ফুটেজ নোবেলের নানাবাড়ির

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও নোবেলের একজন আত্মীয়র সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডেমরার যে বাসা থেকে ওই নারীকে উদ্ধার করা হয়েছে, সেই বাসা নোবেলের নানাবাড়ি। নোবেলের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে। তাঁর মা–বাবা গ্রামেই থাকেন। ডেমরায় নানাবাড়িতে তাঁর মা উত্তরাধিকার সূত্রে ওই ফ্ল্যাটের মালিক। ফ্ল্যাটের তিনটি কক্ষ। সেখানে নোবেলের গানের স্টুডিও রয়েছে। পাশাপাশি তিনি সেখানেই থাকেন। বাসার তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় নোবেলের আত্মীয়রা থাকেন।

সম্প্রতি ভুক্তভোগী নারীকে নির্যাতনের যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে, সেটিই নোবেলের নানাবাড়ির।

তদন্ত কর্মকর্তা মুরাদ হোসেন বলেন, ‘আমরা নোবেল এবং ভুক্তভোগী নারী—দুজনকেই জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। ভুক্তভোগী নারী দাবি করেছেন, নোবেল প্রায়ই তাঁকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করতেন। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে সেদিন নোবেলের বাসা (দ্বিতীয় তলা) থেকে তিনি (নারী) তৃতীয় তলায় নোবেলের মামার বাসায় যান। বিষয়টি টের পেয়ে নোবেল তৃতীয় তলায় যান। সেখান থেকে ওই নারীকে টেনেহিঁচড়ে আবার দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যান।’

পুলিশ কর্মকর্তা মুরাদ হোসেন বলেন, নানাবাড়ির কোনো আত্মীয়র সঙ্গে নোবেলের সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার (সিসি ক্যামেরা) ফুটেজ তাঁরই এক আত্মীয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দেন। তাতেই ভুক্তভোগী নারীর নির্যাতিত হয়ে সাত মাস ধরে আটকে থাকার তথ্য সবাই জানতে পারেন।

ওই নারীর বরাত দিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা  বলেন, ভুক্তভোগী নারী সাত–আট মাস ধরে প্রচণ্ডভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে ওই নারী তাঁর মায়ের সঙ্গে মাত্র দুবার কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলেন।

অবশ্য নোবেলের এক আত্মীয় কাছে দাবি করেন, ভুক্তভোগী নারী নোবেলের স্ত্রী, তিনি অন্তঃসত্ত্বা। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল। যে কারণে দ্বিতীয় তলায় নোবেলের বাসা থেকে তৃতীয় তলায় নোবেলের এক আত্মীয়র বাসায় যান ওই নারী। নোবেল ওই নারীকে ধর্ষণ করেননি।

পুলিশ কর্মকর্তা মুরাদ হোসেন বলেন, ওই নারীর অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার বিষয়ে ভুক্তভোগী নারী এবং নোবেলকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। ওই নারী দাবি করেছেন, তিনি অন্তঃসত্ত্বা। তবে ফরেনসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো তথ্য বলা সম্ভব নয়। পরীক্ষার জন্য আদালতের কাছে আবেদন করা হবে।