দুই ফসলি জমি এখন গর্ত–জলাশয়, মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়
প্রতিনিধি সাতকানিয়া
![]() |
| ইটভাটার জন্য মাটি কাটায় জলাশয়ে পরিণত হয়েছে ফসলি জমি। গত বৃহস্পতিবার সকালে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার উত্তর ঢেমশা-তেমুহনী এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
একসময় বছরে দুটি মৌসুমে ধান চাষ করতেন চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার উত্তর ঢেমশা, তৈমুহনী, মরফলা ও রসুলাবাদ এলাকার কৃষকেরা। সম্প্রতি বোরো মৌসুমে সেসব ধানি জমিতে গিয়ে দেখা গেল ভিন্ন দৃশ্য। চাষাবাদের জমিতে বিশাল বিশাল গর্ত। একেকটি গর্তের গভীরতা ৪০ থেকে ৫০ ফুট। অনেকগুলো গর্তেই পানি জমে জলাশয় সৃষ্টি হয়েছে। ইটভাটার জন্য ফসলি জমির মাটি কেটে এসব গর্ত ও জলাশয়ের সৃষ্টি করা হয়েছে।
তৈমুহনী এলাকার প্রবীণ কৃষক মোহাম্মদ আলিম উল্লাহ বলেন, উত্তর ঢেমশা ও তৈমুহনী এলাকায় যেখানে এখন বিশাল জলাশয়ের সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে একসময় কৃষকেরা আমন ও বোরো ধানের আবাদ করতেন। মাটি ব্যবসায়ীরা ফসলি জমির মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রি করায় জলাশয় সৃষ্টি হয়েছে। অনেকের জমি থেকে জোরপূর্বক মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলের নেতা পরিচয়ে মাটির ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন কিছু ব্যক্তি।
সম্প্রতি সরেজমিন দেখা গেছে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সাতকানিয়া উপজেলার আন্ধারমার দরগার পশ্চিম পাশে উত্তর ঢেমশা ও তৈমুহনী এলাকায় বিশাল এক জলাশয়। জলাশয়টির পূর্ব ও পশ্চিম পাশে এবং উত্তর পাশের রেললাইন ঘেঁষে সদ্য কেটে নেওয়া বোরো ধানের নাড়া। উত্তর পাশে বেশ কয়েকটি ইটের ভাটা। সেখান থেকে অল্প কিছু দূরে পশ্চিমে মরফলার বিল ও উত্তরে রসুলাবাদ এলাকায়ও দেখা যায় বিশাল বিশাল গর্ত। গর্তগুলোর আশপাশেও বেশ কয়েকটি ইটের ভাটা।
কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের লোকজন ও স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপজেলার কেরানীহাট থেকে মৌলভীর দোকান পর্যন্ত জনার কেঁওচিয়া, উত্তর ঢেমশা, তৈমুহনী, মরফলা ও রসুলাবাদ এলাকায় ৪০টির অধিক ইটভাটা আছে। প্রায় ২০-২৫ বছর ধরে এসব এলাকার দুই ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রি করে আসছেন স্থানীয় মাটি ব্যবসায়ীরা। এতে ওই সব এলাকায় ১৮ থেকে ২০ হেক্টর ফসলি জমি জলাশয় ও বিশালাকার গর্তে রূপ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন সাতকানিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান।
![]() |
| ইটভাটায় পাচারের জন্য মাটি কেটে নেওয়া হয়েছে। তাই ফসলি জমিতে তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত। গত বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলার রসুলাবাদ এলাকা থেকে তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
সাতকানিয়া উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি ফরিদুল আলম বলেন, ‘ইটভাটার প্রধান কাঁচামাল মাটি। যারা মাটির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তাদের কাছ থেকেই আমরা মাটি কিনে ইট তৈরি করি। কিছু ফসলি জমি থেকে গভীর করে মাটি কাটার কারণে কিছু কিছু স্থানে জলাশয় ও বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। অনেক আগে থেকেই এসব জমি থেকে মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছিল।’
মাটি কাটার বিরুদ্ধে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রচারণামূলক সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে। উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভা করা হয়েছেও বলে জানান সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিল্টন বিশ্বাস। তিনি বলেন, মাটি কাটার খবর পাওয়া মাত্রই দিনে ও রাতে যেকোনো সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালিয়ে কয়েকজন মাটি ব্যবসায়ীকে কারাদণ্ড ও জরিমানা করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে কয়েকটি খননযন্ত্র ও ট্রাক। তা ছাড়া কয়েকটি খননযন্ত্র ও ট্রাক বিকলও করে দেওয়া হয়েছে।
উপজেলা প্রশাসনের অভিযানেও থামছে না সাতকানিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি কাটা। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দেওয়ার জন্য বেশির ভাগ সময় রাতের আঁধারেই ফসলি জমির মাটি কাটার এ কাজ চলছে বলে জানান এলাকাবাসী। জনার কেঁওচিয়া এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ মিনহাজ বলেন, প্রশাসনের লোকজন অভিযানে আসার আগেই মাটি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা জেনে যান। এতে মাটি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা সরে পড়েন। তাই প্রশাসন মাঝেমধ্যে অভিযান পরিচালনা করলেও ফসলি জমির মাটি কাটা থেমে থাকছে না।
সম্প্রতি উপজেলার রসুলাবাদ এলাকায় জমির মালিককে না জানিয়েই দুই কানি জমির মাটি বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ১৩ এপ্রিল সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দেন জমির মালিক আবুল বশর। অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, আবুল বশরের অজান্তে তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জমি থেকে ৫০ ফুট গভীর করে মাটি কেটে বিক্রি করে দিয়েছেন কামাল হোসেন ও মো. সোহেল নামের দুই ব্যবসায়ী।
জমির মালিক আবুল বশর মুঠোফোনে বলেন, ‘মাটি ব্যবসায়ীরা আমাদের জমি থেকে ২০ লাখ টাকার মাটি খনন করে নিয়ে গেছেন। এ ব্যাপারে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে বিভিন্ন ধরনের টালবাহানা করছেন।’ তবে জমির মালিককে না জানিয়ে কোনো মাটি কাটা হয়নি, বরং মালিকের কাছ থেকে মাটি কিনে অন্য মানুষের কাছে বিক্রি করেছেন বলে দাবি করেন মাটি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সোহেল। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউএনও মিল্টন বিশ্বাস বলেন, এ ধরনের একটি অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখার পর আইনগতভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


Comments
Comments