প্রতীক বর্ধন ঢাকা

পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি কমলেও বাংলাদেশে কমছে না | গ্রাফিক্স:পদ্মা ট্রিবিউন 

বাংলাদেশ যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে, তখন অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা উল্লেখযোগ্য হারে মূল্যস্ফীতি কমাতে পেরেছে। অথচ শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতির হার ছিল বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি।

সংকটের চূড়ান্ত সময় ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শ্রীলঙ্কার সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ৭৩ দশমিক ৭ শতাংশ পর্যন্ত ওঠে। ২০২৩ সালের মে মাসে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ৩৭ দশমিক ৩ শতাংশ। সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যান্য সূচকেও বাংলাদেশ এই দুটি দেশের তুলনায় ভালো অবস্থানে ছিল। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশ মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না।

২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি নেমে আসে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশে এবং শ্রীলঙ্কা মূল্যস্ফীতির ধারা থেকে বেরিয়ে উল্টো মূল্যহ্রাসের চক্রে ঢুকেছে, অর্থাৎ ডিফ্লেশন হচ্ছে দেশটিতে (মাইনাস ২ শতাংশ)। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি এখনো ৯ শতাংশের ওপরে, যদিও সম্প্রতি কিছুটা কমেছে। দুই বছরের বেশি সময় ধরে দেশে এই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এত দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনা।

শ্রীলঙ্কার ও পাকিস্তান সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছিল। শ্রীলঙ্কার ছিল ঋণ সংকট ও সে কারণে সৃষ্ট বিদেশি মুদ্রার সংকট। পাকিস্তানের বেলায় ছিল বৈদেশিক ঋণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতা- যে কারণে পাকিস্তান উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক স্থবিরতার মুখে পড়েছিল। বাংলাদেশ সে ধরনের সংকটে পড়েনি, যদিও আলোচনা ছিল, বাংলাদেশের অবস্তা শ্রীলঙ্কার মতো হবে কি না। দেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতির মূল কারণ অব্যবস্থাপনা।

বিষয়টি হলো, করোনার প্রথম ধাক্কার পর ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই মূল্যস্ফীতির হার সারা বিশ্বে বাড়তে শুরু করে। এরপর ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি হয়। ইউরোপ ও আমেরিকায় মূল্যস্ফীতির হার ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যায়। তখন থেকে বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করে। কিন্তু উপমহাদেশের অন্যান্য দেশ বা ইউরোপ–আমেরিকা মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে আনতে পারলেও বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার এখনো কমছে না।

সংকটের চূড়ান্ত সময় ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শ্রীলঙ্কার সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ৭৩ দশমিক ৭ শতাংশ পর্যন্ত ওঠে। ২০২৩ সালের মে মাসে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ৩৭ দশমিক ৩ শতাংশ। এখন পাকিস্তানে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ আর শ্রীলঙ্কার মাইনাস ২ শতাংশ ।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, নীতিগত ভুলের কারণে দেশে মূল্যস্ফীতি কমছে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রধান হাতিয়ার হলো মানুষের চাহিদার রাশ টেনে ধরা। এর স্বীকৃত মাধ্যম হলো নীতি সুদহার বাড়ানো। বিশ্বের সব দেশেই এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৩ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সুদহার কৃত্রিমভাবে কমিয়ে রাখে, তত দিনে মূল্যস্ফীতি ৭ থেকে ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এরপর ধাপে ধাপে নীতি সুদহার বাড়ানো হলেও তা ছিল সীমিত। ফলে বাস্তব সুদহার ছিল (মূল্যস্ফীতি বাদ দিলে) ঋণাত্মক। এ কারণে বেশি ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি আরও উসকে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। আবার এটাও ঠিক, বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি চাহিদাভিত্তিক নয়; এর সঙ্গে রাজস্ব নীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনার সংযোগ আছে।

আরেকটি বিষয় হলো টাকার মান কৃত্রিমভাবে ধরে রাখা। ২০২২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘদিন ডলারের মান ছিল ৮৬ টাকা, যদিও রপ্তানিকারকেরা দীর্ঘদিন ধরে টাকার অবমূল্যায়নের কথা বলে আসছিলেন। কিন্তু শেষমেশ টাকার বিনিময় হার বাজারের সঙ্গে যুক্ত করা হয় ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়। কিন্তু ডলার–সংকটের কারণে কালোবাজারে ডলারের দাম সরকারি হারের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি হয়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে সরকার আমদানি সীমিত করে। ফলে অনেক পণ্যের আমদানি বিঘ্নিত হয় এবং পরিণামে পণ্যের দাম আরও বেড়ে যায়। সেই যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেল, তারপর বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না।

আরেকটি বড় সমস্যা হলো, ভর্তুকি কমানো বা রাজস্ব আদায় বাড়ানোর ব্যর্থতা। জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম বৈশ্বিক দামের সঙ্গে যথাসময়ে সমন্বয় করা হয়নি। ফলে বাজেটের ওপর চাপ পড়ে। সরকার জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে আয়কর বা প্রত্যক্ষ কর সংস্কারে উদ্যোগ নেয়নি। এতে বাজেট–ঘাটতি বেড়েছে। এই ঘাটতির কিছু অংশ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পূরণ করা হয়। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে মূল্যস্ফীতিতে।

বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি দেয়। কিন্তু সেই ভর্তুকির লক্ষ্যভিত্তিক বণ্টন দুর্বল। জ্বালানি, সার ও খাদ্যপণ্যের ভর্তুকি দরিদ্রদের জন্য যথাযথভাবে বরাদ্দ করা হয়নি। মধ্যবিত্ত ও ব্যবসায়ীরাও এ সুবিধা পেয়ে যান। ফলে ভর্তুকির কার্যকারিতা কমে যায়। এসব কারণে দরিদ্র ও সীমিত আয়ের মানুষের জীবনে মূল্যস্ফীতির প্রভাব আরও বেড়ে যায়।

মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির আরেকটি বড় কারণ হলো বাজার তদারকি ও মূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা। পেঁয়াজ, চিনি, চালসহ মূল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে সিন্ডিকেট সক্রিয় আছে, যারা কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ায়। সরকারের বাজার তদারকির ব্যবস্থা দুর্বল ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত। ফলে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে কার্যকর সামাজিক সুরক্ষা অপ্রতুল। উন্নত দেশের সরকার যেভাবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে, বাংলাদেশ সেভাবে পারে না। এর মূল কারণ, অপ্রতুল রাজস্ব আয়। মূল্যস্ফীতির প্রভাব মোকাবিলায় একমাত্র প্রত্যক্ষ কর্মসূচি টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি। সেই সঙ্গে আছে বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা কর্মসূচি; যদিও তা ঠিক সরাসরি মূল্যস্ফীতির কারণে দেওয়া হয় না। সেটাও আবার পরিমাণ ও পরিসরে অনেক ছোট। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বড় অংশ এর আওতার বাইরে থেকে যায়। বিষয়টি হলো, পাকিস্তানের বিআইএসপি বা ভারতের বিনা মূল্যে খাদ্য কর্মসূচির মতো সর্বজনীন বা ব্যাপকভিত্তিক সহায়তা কর্মসূচি বাংলাদেশে অনুপস্থিত।

দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার আরেকটি কারণ হলো তথ্যের বিকৃতি ও নীতিগত ধারাবাহিকতার অভাব। অভিযোগ আছে, মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যান (বিশেষ করে খাদ্য ও বাসাভাড়া) বাস্তবতা থেকে কম দেখানো হয়। এসব কারণে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন হয়েছে। নীতিনির্ধারকদের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী ও সাধারণ নাগরিকদের। এ কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ে শঙ্কা আরও বেড়েছে।

২০২২ সালে শ্রীলঙ্কা ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক দুর্দশার মুখে পড়ে। কয়েক মাস ধরে চলে খাবার, জ্বালানি ও ওষুধের তীব্র সংকট | ফাইল ছবি: রয়টার্স

শ্রীলঙ্কা কী করল

ঋণ সংকটে জর্জর শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত করুণ। ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি ৭০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু ২০২৫ সালের মধ্যে দেশটি নেতিবাচক মূল্যহ্রাসের ধারায় নেমে গেছে। এটি সম্ভব হয়েছে কঠোর মুদ্রানীতি, রাজস্ব সংস্কার ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সহায়তায় পরিচালিত পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে।

২০২২ সালে অর্থনৈতিক সংকটে রীতিমতো অচল হয়ে পড়েছিল শ্রীলঙ্কা—প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশ ছুঁয়ে যায়, জ্বালানিসংকট চরমে পৌঁছায় আর পেট্রলপাম্পগুলোয় অপেক্ষমাণ যানবাহনের সারি কেবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। জন-অসন্তোষ চরমে ওঠে। গণরোষের মুখে পড়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। এরপর দায়িত্ব নেন রনিল বিক্রমাসিংহে।

নতুন গভর্নর আসার পর সরকার তাঁকে স্বাধীনভাবে দুটি কাজ করার সুযোগ দেয়। মূলত যে দুটি খাতে তিনি হাত দেন, তা হলো নীতি সুদহার বৃদ্ধি ও মুদ্রার একক বিনিময় হার নিশ্চিত করা। অন্যান্য দেশের মতো শ্রীলঙ্কায়ও মুদ্রার অনানুষ্ঠানিক বাজার আছে, সেখানকার কারসাজির কারণেও মুদ্রার বিনিময় হারে প্রভাব পড়ে, মূল্যস্ফীতি বাড়ে। তবে মুদ্রার বিনিময় হারের ওঠানামা করলেও নীতি সুদহার বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরে দেশটি। ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে নীতি সুদহার ৬ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করে। সেই সঙ্গে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজেট–ঘাটতি পূরণে টাকা ছাপানো বন্ধ করে। বাজারে মুদ্রাস্ফীতিও বন্ধ হয়।

২০২৩ সালের মার্চ মাসে শ্রীলঙ্কা আইএমএফের ঋণ পায়। বর্ধিত ঋণসুবিধার অংশ হিসেবে ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন বা ২৯০ কোটি ডলার ঋণ পায় শ্রীলঙ্কা।

তিন দেশের মধ্যে তুলনামূলক পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ প্রতিটি ক্ষেত্রেই পিছিয়ে। প্রথমত, নীতি সুদহার বাড়াতে বিলম্ব করা; দ্বিতীয়ত, মুদ্রার বিনিময় হার ভাসমান বা বাজারভিত্তিক করতে অনেক দেরি করা; তৃতীয়ত, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করতে না পারা ও চতুর্থত, নিম্ন আয় ও দরিদ্র মানুষের জন্য বিশেষায়িত কর্মসূচি গ্রহণ না করা।

এই চুক্তির শর্ত হিসেবে কিছু নীতিগত সংস্কারে হাত দেয় শ্রীলঙ্কা। যেমন এই চুক্তির আওতায় মূসক বা মূল্য সংযোজন কর ৮ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করে করা হয়; জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি তুলে দেওয়া হয়; কর-জিডিপির অনুপাত বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়; অপ্রয়োজনীয় সরকারি ব্যয় কমানো হয়।

এ ছাড়া ২০২২-২৩ সালে শ্রীলঙ্কা অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ বা সীমিত করে শুধু জ্বালানি, ওষুধ ও খাদ্যের মতো প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির অনুমোদন দেয়। এরপর ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করে; ২০২৪ সাল থেকে শ্রীলঙ্কা ধাপে ধাপে এসব নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষেরা। ফলে অনেক দেশের সরকার উচ্চ মূল্যস্ফীতির হাত থেকে এই শ্রেণিকে রক্ষা করতে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি হাতে নেয়। শ্রীলঙ্কাও ওই সময় বেশ কিছু প্রত্যক্ষ নগদ সুবিধা কার্যক্রম গ্রহণ করে, যেমন এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘অম্মসুমা’ নামের নগদ সহায়তা কর্মসূচি।

এবার একঝলকে দেখে নেওয়া যাক শ্রীলঙ্কা সরকার ঠিক কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং যার জেরে মূল্যস্ফীতির হার আজ শূন্যের নিচে নেমে এসেছে। প্রথমত, দেশটি নীতি সুদহার বাড়িয়ে ঋণ নিয়ন্ত্রণ করে; এরপর মুদ্রার ভাসমান বিনিময় হার চালু করে; রাজস্ব খাতে ভর্তুকি তুলে নিয়ে ভ্যাট বৃদ্ধি করে; আইএমএফের ঋণের শর্ত হিসেবে বিভিন্ন ধরনের নীতিগত সংস্কার করে; লক্ষ্যভিত্তিক নগদ সহায়তা ও আমদানি নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা ধাপে ধাপে শিথিল করে।

এই তিন দেশের মধ্যে তুলনামূলক পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ প্রতিটি ক্ষেত্রেই পিছিয়ে। প্রথমত, নীতি সুদহার বাড়াতে বিলম্ব করা; দ্বিতীয়ত, মুদ্রার বিনিময় হার ভাসমান বা বাজারভিত্তিক করতে অনেক দেরি করা; তৃতীয়ত, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করতে না পারা ও চতুর্থত, নিম্ন আয়ের ও দরিদ্র মানুষের জন্য বিশেষায়িত কর্মসূচি গ্রহণ না করা।

পাকিস্তান কী করল

শ্রীলঙ্কার মতো পাকিস্তানও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত। বাস্তবতা হলো, পৃথিবীতে যে দেশটি সবচেয়ে বেশিবার আইএমএফের বেইল আউট নিয়েছে, সেটি হলো পাকিস্তান। এ পর্যন্ত ২৫ বার তারা আইএমএফের ঋণ নিয়েছে। ২০২৩ সালে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতির হার ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত উঠে যায়। এ পরিস্থিতিতে দেশটি আইএমএফের সঙ্গে তিন বিলিয়ন বা ৩০০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি করে। এরপর দেশটি আইএমএফের শর্তাবলি মেনে চলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতি নেমে এসেছে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশে।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ; আগের অর্থবছরের একই সময় যা ছিল ২৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির এই নিম্নমুখী প্রবণতার কারণে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান চলতি মাসে নীতি সুদ হার ১০০ ভিত্তি পয়েন্ট কমিয়ে ১১ শতাংশ নির্ধারণ করে। এসবিপির পূর্বাভাস, চলতি অর্থবছর পাকিস্তানের গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৭ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে থাকবে।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে নীতি সুদহার ৯ দশমিক ৭৪৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২২ শতাংশে উন্নীত করে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

২০২৩ সালে আইএমএফের ৩০০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত হিসেবে পাকিস্তান বেশ কিছু শর্ত বাস্তবায়ন করে। যেমন করহার বৃদ্ধি করা, বিশেষ করে পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি) ও উৎসে কর বৃদ্ধি; জ্বালানির মূল্য নিয়ন্ত্রণের প্রথা বাতিল, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের শাসনব্যবস্থার উন্নয়ন ও রাজস্ব শৃঙ্খলা নিশ্চিতকরণ।
 
অর্থনৈতিক সংকটে পাকিস্তানে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। কম দামে খাদ্য কিনতে সরকারি বিক্রয়কেন্দ্রে সাধারণ মানুষের ভিড় এই পর্যায়ে গিয়েছিল | ফাইল ছবি: রয়টার্স

উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে এসব সংস্কারের কারণে জনজীবনে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে। তা মোকাবিলায় পাকিস্তান সরকার বেশ কিছু সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে। যেমন আয়–সহায়তা কর্মসূচির আওতায় মানুষকে নগদ সহায়তা দেওয়া, বিশেষ করে নিম্ন আয় ও দরিদ্র আয়ের মানুষের সহায়তায় গৃহীত এহসাস কর্মসূচি। এ কর্মসূচি মূলত কোভিড-১৯ কর্মসূচি মোকাবিলায় প্রণয়ন করা হয়েছিল। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, উপকারভোগীর সংখ্যার দিক থেকে এটি বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি। এই কর্মসূচির আওতায় দেড় কোটি পরিবারকে ১২ হাজার রুপি নগদ সহায়তা দেওয়া হয়। দারিদ্র্য বিমোচনে এই কর্মসূচি বড় ভূমিকা পালন করে।

এই তিন দেশের মধ্যে তুলনামূলক পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ প্রতিটি ক্ষেত্রেই পিছিয়ে। প্রথমত, নীতি সুদহার বাড়াতে বিলম্ব করা; দ্বিতীয়ত, মুদ্রার বিনিময় হার ভাসমান বা বাজারভিত্তিক করতে অনেক দেরি করা; তৃতীয়ত, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করতে না পারা ও চতুর্থত, নিম্ন আয় ও দরিদ্র মানুষের জন্য বিশেষায়িত কর্মসূচি গ্রহণ না করা।

মূল্যস্ফীতি একধরনের করের মতো। এতে মানুষের ব্যয় বেড়ে যায়। দীর্ঘ মেয়াদে মূল্যস্ফীতির হার বেশি থাকলে অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়, বিশেষ করে যারা কোনোরকমে দারিদ্র্যসীমার ওপরে বসবাস করে। সেই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধি বা আয় বৃদ্ধি কম হলে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ে। প্রকৃত আয় কমে যায়। এ ছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বিনিয়োগও ব্যাহত হয়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেলে বিনিয়োগকারীরা ভাবেন, এখন বিনিয়োগ করে সুফল পাওয়া যাবে না।