প্রতিনিধি যশোর

লুটপাটের পর পুড়িয়ে দেওয়া বাড়িগুলো এখনো বসবাসের উপযোগী হয়নি। আজ মঙ্গলবার দুপুরে যশোরের অভয়নগর উপজেলার ডহর মশিয়াহাটী গ্রামে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে, টহল দিচ্ছে সেনাবাহিনী। কিছু তরুণ রাত জেগে গ্রামে পাহারা দিচ্ছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক প্রতিনিধিরা আসছেন প্রতিদিন। আসছেন প্রশাসন ও পুলিশের কর্তা ব্যক্তিরা, আশ্বাস দিচ্ছেন নিরাপত্তার। এরপরও আতঙ্ক কাটছে না যশোরের অভয়নগর উপজেলার ডহর মশিয়াহাটী গ্রামের বাসিন্দাদের।

আজ মঙ্গলবার দুপুরে ডহর মশিয়াহাটী গ্রামে গিয়ে এমন তথ্যই পাওয়া যায়। কৃষক দল নেতাকে গুলি করে হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত বৃহস্পতিবার লুটপাটের পর পুড়িয়ে দেওয়া বাড়িগুলোতে বেশির ভাগ পুরুষ ও শিশুরা এখনো ফেরেনি। অনেকে দিনের বেলায় বাড়িতে এলেও আবারও বাড়িঘরে হামলার আশঙ্কায় রাতে অন্য জায়গায় গিয়ে থাকছেন। পুড়ে যাওয়া বাড়িগুলোও বসবাসের অনুপযোগী।

ডহর মশিয়াহাটী গ্রামটির অবস্থান বিলের মধ্যে। পাকা সড়ক থেকে মাটির রাস্তা ধরে গ্রামের একটি পাকা বাড়ির উঠানে গিয়ে দেখা গেল, পোড়া লেপ-কাঁথা-তোশকের স্তূপ। ঘরটি দুই কক্ষের। পাকা গাঁথুনি, টিনের ছাউনি। বারান্দায় উঠতেই ঘর থেকে আসা পোড়া গন্ধ পাওয়া গেল। একটি কক্ষে রাখা সব ধান পুড়ে গেছে। সেখান থেকে বের হচ্ছে গন্ধ। অপর কক্ষে পড়ে আছে আগুনে পোড়া টেলিভিশন, টেবিল ফ্যান, খাট। ঘরের মেঝে ভরে আছে পুড়ে যাওয়া জিনিপত্রের ছাইয়ে।

বারান্দার এক পাশ পুড়ে যাওয়া খাটের ওপর বসে ছিলেন তরুলতা বিশ্বাস (৭৫)। তিনি বলেন, ছেলে দিলীপ বিশ্বাস (৪৬) এবং দুই নাতনি হৈমন্তী বিশ্বাস (১৩) ও দেবশ্রী বিশ্বাসকে (১১) নিয়ে তাঁদের সংসার। ছেলে দিনমজুর। বৃহস্পতিবার রাতে অনেক লোকজন এসে আগে ঘরে রাখা ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা নিয়েছেন। এরপর ঘরের সবকিছু আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছেন। ছেলেটা মেয়ে দুটোকে নিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। গতকাল সোমবার সকালে বাড়ি এসেছিলেন। সন্ধ্যার আগে আবার চলে গেছেন।

পুড়ে যাওয়া বাড়ির বারান্দায় বসে আছেন এক গৃহিণী। মঙ্গলবার দুপুরে যশোরের অভয়নগর উপজেলার ডহর মশিয়াহাটী গ্রামে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

তরুলতা বিশ্বাস বলেন, ‘ঘরে থাকার মতো অবস্থা নেই। বারান্দায় থাকি। রাতে ভয় লাগে। বৃহস্পতিবার সকালে ভাত খেয়েছিলাম। মাঝের কয় দিন ভাত খাইনি। আজ সকালে একজন ভাত দিয়ে গেছে, তা–ই খেয়েছি।’

তরুলতাদের পাশের বাড়ির টিনের ঘরটি আগুনে পুড়ে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। গাছগুলোও পুড়ে গেছে। পুড়ে যাওয়া ঘরের সামনে পড়ে আছে একটি পোড়া ইঞ্জিনচালিত ভ্যান। বাড়ির উঠানে পাঁচ বছরের ছেলেকে কোলে দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন পিয়া বিশ্বাস (২২)। পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর শাশুড়ি চন্দ্রিকা বিশ্বাস (৭০) বলেন, ছেলে বাসুদেব বিশ্বাস ভ্যান চালান। ঘরে দেড় লাখ টাকা এবং তিন ভরি সোনার গয়না ছিল। বৃহস্পতিবার রাতে সেগুলো লুট করার পর ঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তাঁরা পাশের বিলে পালিয়ে থেকে প্রাণে বাঁচেন। ঘরের যাবতীয় আসবাব, টেলিভিশন, ১৫টি মুরগি, ১৫০ কেজি চাল, বৈদ্যুতিক মোটর, সেলাইমেশিন, জমির দলিলপত্র, আইডি কার্ড—সব আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভ্যানটিও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

ঘরে থাকার মতো অবস্থা নেই উল্লেখ করে চন্দ্রিকা বিশ্বাস আরও বলেন, ‘সারা দিন সবাই বাড়িতে থাকি, সন্ধ্যার আগে অন্যত্র চলে যাই। লোকজন যা খাবার দেয়, তা–ই খেয়ে আছি।’

গ্রামের আরেক বাসিন্দা তুলসী বিশ্বাসদের (৭৫) ঘরটি আগুনে পুড়ে টিন খসে পড়েছে। দেয়ালগুলো দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের মধ্যে সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে আছে। পাশে খড় রাখার ঘরে মাচার ওপর বসে তুলসী বিশ্বাস বলেন, আগুনে ৩০ মণ ধান, ৪ মণ চাল, ২টি টেলিভিশনসহ ঘরের সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ছেলে বিষ্ণুপদ বিশ্বাস (৪৮) ও প্রদীপ বিশ্বাস (৪৭) ওই দিন রাত থেকে বাড়িছাড়া। ভয়ে বাড়ি আসতে পারছেন না। ঘরে থাকার মতো বিন্দুমাত্র জায়গা নেই। দিনে তাঁরা বাড়িতে থাকলেও রাতে অন্যত্র গিয়ে থাকছেন।

কয়েকটি বাড়ি ঘোরার পর পুরুষ সদস্য পাওয়া গেল গ্রামের বাসিন্দা সুশান্ত বিশ্বাসের (৫৬) বাড়িতে। তিনি বলেন, ‘ঘরে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা ছিল। ওই টাকা নেওয়ার পর ঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। আগুনে সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ১৫ মণ ধান, সাড়ে ৩ কাহন বিচালি (খড়) আগুনে পুড়ে গেছে। বাড়িতে থাকার মতো এক ইঞ্চি জায়গাও নেই। খুব ভয় লাগে।’ রাতে অন্যত্র গিয়ে থাকছেন।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ডহর মশিয়াহাটী গ্রামের একটি বাড়িতে কৃষক দল নেতা তরিকুল ইসলামকে (৫০) কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটে। তরিকুল ইসলাম উপজেলার ধোপাদী গ্রামের ইব্রাহিম সরদারের ছেলে। তিনি উপজেলার নওয়াপাড়া পৌর কৃষক দলের সভাপতি ছিলেন।

পুড়িয়ে দেওয়া বাড়িগুলো এখনো বসবাসের উপযোগী হয়নি। মঙ্গলবার দুপুরে যশোরের অভয়নগর উপজেলার ডহর মশিয়াহাটী গ্রামে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

তরিকুল ইসলামকে হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে একদল লোক ডহর মশিয়াহাটী গ্রামের অন্তত ২০টি হিন্দু বাড়িতে লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন। এ ছাড়া উপজেলার সুন্দলী বাজারে দুটি দোকানে অগ্নিসংযোগ এবং চারটি দোকান ভাঙচুর করা হয়েছে। এ সময় আহত হন অন্তত ১০ জন।

এদিকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ডহর মশিয়াহাটী গ্রামের পুড়িয়ে দেওয়া বাড়িগুলোর সদস্যদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। গত শনিবার বিকেলে গ্রামের ১৮টি পরিবারের মধ্যে এই ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হয়। প্রতিটি পরিবারকে ২ বান্ডিল টিন, ৩০ কেজি চাল, ২টি কম্বল এবং নগদ ৬ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়।

তরিকুল ইসলাম হত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে উল্লেখ করে অভয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল আলিম বলেন, ডহর মশিয়াহাটীর গ্রামের বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মামলা হয়েছে। তবে এ মামলায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। গ্রামে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। গ্রামের বাসিন্দাদের ফিরতে নিরাপত্তাজনিত কোনো সমস্যা নেই।