প্রতিনিধি পাবনা

বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও পায়ে চালিত রিকশায় পাবনা জেলা শহরের অলিগলি–সড়কে যাত্রী আনা–নেওয়া করেন ৭৫ বছর বয়সী শাহজাহান শেখ। সোমবার শহরের আবদুল হামিদ সড়কে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

পাবনা জেলা শহরের ট্রাফিক মোড় (স্থানীয়দের কাছে এটি ঘোড়াস্ট্যান্ড নামেও পরিচিত)। প্রায় প্রতিদিন সকালের আলো ফোটার পরপর সেখানে দেখা মেলে শাহজাহান শেখের (৭৫)। প্যাডেলচালিত জীর্ণ একটি রিকশায় বসে অপেক্ষা করেন যাত্রীর জন্য। ৫৫টি বছর ধরে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন তিনি। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায়ও রিকশাই তাঁর অবলম্বন। এর মাধ্যমে এখনো বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

জানতে চাইলে আক্ষেপের সুরে শাহজাহান বলে ওঠেন, রিকশার চাকা না ঘুরলে তাঁর জীবনের চাকা ঘোরে না। শরীরে যতক্ষণ শক্তি আছে, ততক্ষণ কাজ করেই খেতে হবে। তাই তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। সন্তানদের জন্য আর অপেক্ষা করেন না। যা আয় করেন, তা দিয়েই খেয়ে–না খেয়ে জীবন চলছে। ডাল-ভাত যা–ই হোক, তিনি আর তাঁর স্ত্রী মিলে রান্না করে খান। কথার এ পর্যায়ে মুচকি হেসে জানান, দুজনে মিলেমিশে ভালোই আছেন।

সোমবার শাহজাহান তাঁর জীবনসংগ্রামের এই কথাগুলো যখন বলছিলেন, তখন প্রায় দুপুর। তিনি বলেন, তাঁর বাড়ি পাবনা জেলা সদরের মালিগাছা ইউনিয়নের মনোহরপুর গ্রামে। ৩ ছেলে ও ১ মেয়ে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার ছিল। মেয়েটি প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার আগেই টিউমারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বর্তমানে ছেলেরা বিয়ে করে আলাদা সংসার গড়েছেন। ফলে অসহায় হয়ে পড়েছেন তিনি ও তাঁর স্ত্রী ভানু খাতুন (৬০)। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জমিটুকু ছেলেদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন। আর নিজের ভাগের আধা কাঠা জমির ওপর তুলেছেন একটি টিনের ঘর। ভাঙাচোরা ঘরটিই এখন শাহজাহান ও ভানুর ঠিকানা।

দুজনের সংসার চালাতে বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শরীর নিয়ে প্রায় প্রতিদিন সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে ট্রাফিক মোড়ে আসেন শাহজাহান। আর তাঁর সঙ্গী ওই ভাঙাচোরা রিকশা। একদিকে বৃদ্ধ চালক, অন্যদিকে পায়ে চালিত রিকশা। এসব দেখে অনেক যাত্রীই তাঁর রিকশায় উঠতে চান না। এর মধ্যে দুই-চারজন উঠলে কিছু একটা আয় হয়। তবে সেটিও পর্যাপ্ত নয়। শাহজাহানের দাবি, দিনে ১২০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন। আর এ অর্থ দিয়েই তাঁদের ওষুধ-পথ্য ও খাবারের জোগান হয়।

শহরজুড়ে হাজারো ইঞ্জিনচালিত রিকশার ভিড়ে শাহজাহানের পায়ে চালিত জীর্ণ রিকশাটি সহজেই আলাদা করা যায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

শাহজাহান বলতে থাকেন, এখন মানুষ ইঞ্জিনচালিত রিকশায় চলেন। প্যাডেল রিকশায় আর কেউ চড়তে চান না। বয়সের কারণে তিনিও বেশিক্ষণ প্যাডেল চালাতে পারেন না। আর কানেও কম শোনেন। তাই আগের মতো আর ভাড়া পান না, আয়ও অনেকটা কমে গেছে। একসময় কিস্তিতে একটি ইঞ্জিনচালিত রিকশা কেনার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু কিস্তি পরিশোধ করতে না পারলে কী হবে—এই ভয়ে আর সাহস করেননি। একটি ইঞ্জিনচালিত রিকশা পেলে জীবনের শেষ দিনগুলো হয়তো একটু স্বস্তিতে কাটাতে পারতেন, সেই স্বপ্ন ও আশা তাঁর।

ছোটবেলা থেকে শাহজাহান শেখকে দেখে আসছেন জানিয়ে ট্রাফিক মোড় এলাকার মাইক ব্যবসায়ী আফসার আলী বলেন, শাহজাহান শেখ খুব সাদামাটা একজন। তবে এখন তাঁর শরীর ভেঙে পড়েছে, শক্তি কমেছে। মাঝেমধ্যেই অসুস্থ থাকেন। তবু মনের জোড়ে প্রতিদিন রিকশা নিয়ে বের হন। শাহজাহানের এই শক্তি আর সাহস দেখে তাঁরাও মনোবল পান।

শাহজাহান শেখ যেখানে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করেন, সেখানে ডাব বিক্রি করেন মোস্তফা। তিনি আফসোস করে বলেন, ‘মানুষটার জন্য কষ্টই হয়। একটা ইঞ্জিনের রিকশা হলে মানুষটা একটু আরাম পাইত।’ একই কথা জানান পাবনা জেলা রিকশা ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি পাভেল হোসেনও। তাঁর ভাষ্য, বর্তমান সময়ে পায়ে চালিত রিকশা আর নেই বললেই চলে। সবাই এখন ব্যাটারিচালিত রিকশা চালান। এই সময়ে একজন বৃদ্ধ মানুষ পায়ে চালিত রিকশা চালিয়ে জীবন চালাচ্ছেন। এটা বেশ কষ্টের। কিন্তু তাঁদের ইচ্ছা থাকলেও শাহজাহানের জন্য কিছু করার সাধ্য নেই। আশা করেন কোনো হৃদয়বান ব্যক্তি শাহজাহানের পাশে দাঁড়াবেন। এতে শেষ জীবনে কিছুটা হলেও তাঁর শান্তিতে কাটবে।