নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা
![]() |
‘পান্থকুঞ্জ মোকদ্দমা: জনগণ বনাম অন্তর্বর্তী সরকার’ শীর্ষক এই গণশুনানিতে বিচারকেরা। শুক্রবার রাজধানীর পান্থকুঞ্জে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
রাজধানীর পান্থকুঞ্জ উদ্যান জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত এবং সেখানে গাছরক্ষা আন্দোলনকারীদের অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন গণ আদালত। একই সঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে পান্থকুঞ্জে জনসাধারণের অবাধ প্রবেশ ও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে গণস্বার্থ বিষয়ে এটি ছিল প্রথম গণ আদালত।
আজ শুক্রবার বিকেলে পান্থকুঞ্জের উত্তর প্রান্তে অনুষ্ঠিত গণ আদালত এই রায় ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ গাছরক্ষা আন্দোলন ‘পান্থকুঞ্জ মোকদ্দমা: জনগণ বনাম অন্তর্বর্তী সরকার’ শীর্ষক এই গণশুনানির আয়োজন করে।
পান্থকুঞ্জের গাছ কেটে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের (দ্রুতগতির উড়ালসড়ক) র্যাম্প নির্মাণ বন্ধের দাবিতে গাছরক্ষা আন্দোলনের কর্মীরা গত ১৪ ডিসেম্বর থেকে এখানে অবস্থান করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে গণ আদালত পরিচালনা করে এই গণশুনানির আয়োজন করা হয়।
আদালতের এজলাসের মতোই লাল সালু কাপড়ে আচ্ছাদিত বিচারকদের মঞ্চ, সাক্ষীদের কাঠগড়া, বিচারমঞ্চের উভয় পাশে বাদী ও বিবাদীপক্ষের আসন এবং সামনে দর্শকদের আসনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বাদীপক্ষ উপস্থিত থাকলেও বিবাদীপক্ষে কেউ ছিলেন না। তাঁদের আসনগুলো খালিই ছিল। বিবাদীরা হলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সচিব, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, সড়ক পরিবহন সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, সেতু বিভাগের নির্বাহী পরিচালক (সচিব), পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রকল্প পরিচালক।
বিচার কার্যক্রমের শুরুতে বাদীপক্ষের প্রসিকিউটরের ভূমিকা পালনকারী গাছরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আমিরুল রাজিব আদালতকে জানান, বিবাদীপক্ষকে রেজিস্ট্রি ডাক, ই-মেইলে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গণশুনানিতে হাজির থাকার জন্য জানানো হলেও তাঁরা জনগণের পক্ষের এই আবেদনে সাড়া দেননি; উপেক্ষা করেছেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় জনগণের প্রতি তাঁদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই।
আমিরুল রাজিব জানান, গাছরক্ষা আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দল বা কোনো বেসরকারি সংস্থা নয়। প্রাণ পরিবেশ প্রকৃতি ও অধিকার আদায় নিয়ে যারা কাজ করে, তাদের একটি সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম। গত ১৬৮ দিন থেকে তাঁরা পান্থকুঞ্জে অবৈধভাবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নির্মাণ বন্ধের দাবিতে আন্দোলন করছেন। এখানে প্রায় দুই হাজার গাছ কাটা হয়েছে। বহু পাখি, পতঙ্গের আবাস ধ্বংস হয়েছে। আশপাশের এলাকা মানুষের এই মিলনস্থল, প্রাতর্ভ্রমণের জায়গাটি বিনষ্ট করা হচ্ছে।
গাছরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক বলেন, সুস্পষ্টভাবে সংবিধান, আইন ও আদালতের নির্দেশ অমান্য করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সুবিধার জন্য বিগত স্বৈরাচারী সরকারের আমলের এই জনবিরোধী প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই দুর্নীতিদুষ্ট জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্প বাতিলের জন্য প্রায় ৬ মাসে ৪০টির বেশি সংবাদ সম্মেলন, সেমিনার, সাংস্কৃতিক সমাবেশ, আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। সেখানে দেশের অগ্রগণ্য শিক্ষাবিদ, প্রাণ পরিবেশ প্রকৃতিবিশেষজ্ঞ, অধিকারকর্মী, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ অংশ নিয়েছেন। কিন্তু এই সরকার কোনো কিছুতেই কর্ণপাত করছে না। এ কারণে এই গণশুনানির আয়োজন করা হয়েছে।
সহকারী প্রসিকিউটরের ভূমিকায় গাছরক্ষা আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক নাঈম উল হাসান আদালতের সামনে ছয়টি অভিযোগ তুলে ধরেন। এগুলো হলো অর্থনৈতিক অনিয়ম ও দুর্নীতি; সংবিধান, আইন ও আদালতের আদেশের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন; পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া প্রকল্পের কাজ করা; বৈষম্যমূলক চুক্তির মাধ্যমে জনগণের ওপরে জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্প চাপিয়ে দেওয়া; প্রকল্প কাজের সময় দেশের নাগরিকের মৃত্যুর পরে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দায়মুক্তি দেওয়া; প্রকল্পের অজুহাতে হাতিরঝিল ভরাট এবং পান্থকুঞ্জের দুই হাজারের বেশি গাছ কাটা ও পাখি–পতঙ্গের বাসস্থান ধ্বংস করা।
এই অভিযোগ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য–উপাত্ত এবং নানা অসুবিধার কথা তুলে ধরে কাঠগড়ায় এসে শপথ নিয়ে সাক্ষ্য দেন নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহম্মদ খান, লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ, তেঁতুলতলা মাঠরক্ষা আন্দোলনের সংগঠক ও পরিবেশকর্মী সৈয়দা রত্না, পান্থকুঞ্জ প্রভাতি সংঘের সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন, শিল্পী সৈয়দ মোহাম্মদ জাকির।
এজলাসে পাঁচ সদস্যের বিচারকমণ্ডলীর প্রধান ছিলেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য গীতি আরা নাসরিন। অন্য সদস্যরা হলেন সর্বজনকথা সম্পাদক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান, প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষা মঞ্চের আহ্বায়ক জ্যোতির্ময় বড়ুয়া এবং জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সামসি আরা জামান।
বিচারকমণ্ডলীর প্রধান গীতি আরা নাসরিন জানতে চান বিবাদীপক্ষের কেউ উপস্থিত আছেন কি না এবং তাঁদের কোনো বক্তব্য আছে কি না। তাঁকে জানানো হয়, বিভিন্ন মাধ্যমে গণশুনানিতে হাজির থাকার জন্য অনুরোধ করা হলেও বিবাদীদের কেউ উপস্থিত হননি। এরপর বিচারকেরা রায়ের একেকটি অংশ ঘোষণা করেন।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, আদালত মনে করে, ভবিষ্যতে এ ধরনের জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্প গ্রহণ থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে। গোপনীয়তার অজুহাতে প্রকল্পের চুক্তি ও অন্যান্য জনগুরুত্বপূর্ণ তথ্য জনসমক্ষে না প্রকাশ করার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। এই গোপনীয়তার ফলে মেগা প্রকল্পেই দুর্নীতি হয়েছে। এই আদালত ভবিষ্যতের সব প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য তথ্যের অবাধ সরবরাহ নিশ্চিতের আদেশ প্রদান করছে। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রকল্পে যেসব দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা আজকের শুনানিতে প্রমাণিত হয়েছে, সে বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করছে।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পরিবেশ ছাড়পত্রের শর্ত ভঙ্গ করে পান্থকুঞ্জ ও হাতিরঝিল জলাধারে নির্মাণকাজ চালানো হয়েছে। এ জন্য পুনরায় ছাড়পত্র প্রদান কিংবা নবায়নের ক্ষেত্রে জনগণের ক্ষতিপূরণ আদায়সহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হলো। তা ছাড়া পান্থকুঞ্জ উদ্যানের দুই হাজার গাছ কেটে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটানোর কারণে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জনসমক্ষে প্রকাশ করার জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হলো।
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, আজকের আদালত বিবাদীপক্ষের এহেন আইন অমান্য করার প্রবণতার কারণে উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং তীব্র তিরস্কার করছে।
সামসি আরা জামান প্রকল্প চলাকালে দেশের নাগরিকের মৃত্যু সম্পর্কে বলেন, বিদ্যমান ফৌজদারি আইনেই তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব ছিল। আদালত সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে অবহেলাজনিত হত্যার কারণে বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনে যেহেতু শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, সেহেতু উক্ত আইনে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য আইজিপি (পুলিশ মহাপরিদর্শক) ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ প্রদান করছে।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে প্রধান বিচারক গীতি আরা নাসরিন বলেন, বাদীপক্ষ ১২টি সংযুক্তির মাধ্যমে তাদের অভিযোগের প্রমাণাদি উপস্থাপন করেছে। বৈষম্যমূলক চুক্তি এবং জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্প দেশের জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে আদালত সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। বিদেশি কোম্পানির স্বার্থ রক্ষার্থে বৈষম্যমূলক চুক্তি করে এই জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। বৈষম্যমূলক ও জনস্বার্থবিরোধী এই প্রকল্প ও চুক্তির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসমূহের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আমলে নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আদালত নির্দেশ প্রদান করছেন।
রায়ে প্রধান বিচারক পান্থকুঞ্জ সবার ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত ও গাছরক্ষা আন্দোলনের অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত করার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে প্রকল্পের কাজ স্থগিত ঘোষণা করে রায় দেন।
গণশুনানিতে পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন মুরশিদ, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন হক। তবে তাঁরা কোনো মন্তব্য করেনি। অন্যদের মধ্যে শিক্ষাবিদ, প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ ও অধিকারকর্মী শিল্পী-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীসহ সর্বস্তরের জনসাধারণ উপস্থিত ছিলেন।
গাছরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আমিরুল রাজিব ও গবেষক পাভেল পার্থ প্রথম আলোকে বলেন, এই রায়কে তাঁরা স্বাগত জানান। রায় তাঁরা বিবাদীপক্ষের সংশ্লিষ্টদের কাছে পৌঁছে দেবেন। তাঁরা আশা করছেন, গাছরক্ষা আন্দোলন যেমন গণ আদালতের রায়কে সম্মান জানিয়ে মেনে নিয়েছে, তেমনি বিবাদীপক্ষও রায়ের সুপারিশ ও নির্দেশনা মেনে নেবেন।