নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রয়াত কবি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক আজাদের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটির একাংশ ভেঙে দেওয়া হয়েছে।  ধানমন্ডির ১ নম্বর সড়কে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

বীর মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রয়াত কবি রফিক আজাদের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ির ছাদের একটি অংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে গতকাল বুধবার। জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে পাশের বাড়িটি ভাঙার সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয় রফিক আজাদের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি।

রাজধানীর ধানমন্ডির ১ নম্বর সড়কে অবস্থিত ১৩৯/৪ নম্বর প্লটে ছিল চারটি বাড়ি। এর মধ্যে তিনটি গতকাল পুলিশের উপস্থিতিতে ভেঙে ফেলা হয়। সকাল ১০টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত বুলডোজার দিয়ে চলে ভাঙার কাজ। কবি রফিক আজাদের বাড়িতে থাকেন তাঁর স্ত্রী অধ্যাপক দিলারা হাফিজ।

জাতীয় গৃহায়ণ কৃর্তপক্ষ বলছে, ১৩৯/৪ এ (পশ্চিমাংশ) প্লটটি সরকারি পরিত্যক্ত বাড়ি। সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হবে। এরই মধ্যে ফ্ল্যাট বরাদ্দও হয়ে গেছে। বাড়িটির সর্বশেষ বরাদ্দ ছিল রফিক আজাদের স্ত্রী দিলারা হাফিজের নামে। ২০১৮ সালে তাঁর নামে বরাদ্দ বাতিল করা হয়। বাড়ি ছাড়তে তাঁকে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। তবে তিনি বাড়ি ছাড়েননি। এমন বাস্তবতায় তাদের বাড়িটি ভাঙতে হচ্ছে।

তবে দিলারা হাফিজ অভিযোগ করেন, বাড়ি ছাড়ার জন্য তাঁকে কোনো ধরনের নোটিশ দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, ‘বাড়িটি ১৯৮৮ সালে আমার নামে বরাদ্দ হয়েছিল। ২০১৮ সালে বরাদ্দ বাতিল হলে আমি পুনরায় আবেদন করেছিলাম। এ নিয়ে হাইকোর্ট ও জজকোর্টে দুটি মামলা চলছিল। দুই আদালত থেকেই বাড়ি ভাঙার বিষয়ে স্থগিতাদেশ (স্টে অর্ডার) দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে এক মাস আগে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশটি বাতিল হয়েছে। তবে জজকোর্টের স্থগিতাদেশ এখনো বহাল আছে।’

জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ১৩৯/৪ এ প্লটের মোট জমির পরিমাণ ৩৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ। প্লটের চারটি বাড়িই একতলা করে। একটির বরাদ্দ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাঁট মুদ্রাক্ষরিক নিলুফার সুলতানের নামে, একটি এস জেড মজুমদারের পরিবারের নামে, আরেকটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী খোরশেদ আলমের নামে বরাদ্দ। তবে তাঁরা কেউ সেখানে থাকেন না। দক্ষিণ–পশ্চিম পাশের বাড়িতে শুধু কবি রফিক আজাদের স্ত্রী বসবাস করছেন।

গতকাল বিকেলে গিয়ে দেখা যায়, রফিক আজাদের বসবাসের বাড়িটি ছাড়া অন্য আরেকটি বাড়ির কিছু অংশ অবশিষ্ট আছে। বাকি দুই বাড়ির চিহ্ন নেই। এ সময় কবি রফিক আজাদের স্ত্রী দিলারা হাফিজ ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। শিক্ষা ক্যাডারের প্রভাষক হিসেবে বাড়িটির বরাদ্দ পেয়েছিলেন দিলারা হাফিজ। তিনি সরকারি বাঙলা কলেজ ও তিতুমীর কলেজের অধ্যক্ষ এবং সর্বশেষ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ঢাকার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর অবসর নেন।

ধানমন্ডির ১ নম্বর সড়কে অবস্থিত ১৩৯/৪ বাড়িটি একসময় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সরকারি আবাসন পরিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে ছিল। পরে বাড়িটি এই মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন আরেকটি সংস্থা জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তবে পরিত্যক্ত বাড়িটির দেখভালের দায়িত্ব হচ্ছে গণপূর্ত অধিদপ্তরের রক্ষণাবেক্ষণ শাখার।

ধানমন্ডি এলাকায় পরিত্যক্ত সম্পত্তি দেখভালের দায়িত্বে থাকা গণপূর্ত অধিদপ্তরের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী দেবব্রত দত্ত তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নির্বাহী প্রকৌশলী কায়সার কবিরকে গতকাল একটি চিঠি দেন। চিঠিতে বলা হয়, ধানমন্ডির ১ নম্বর সড়কে অবস্থিত ১৩৯/এ বাড়িটি পরিত্যক্ত সম্পত্তি। ১৯৮৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত গেজেটে বাড়িটি ‘ক’ তালিকাভুক্ত করা হয়। ধানমন্ডি এলাকার ১ নম্বর তালিকায় এ বাড়ির নাম রয়েছে।

চিঠিতে আরও বলা হয়, বুধবার পরিদর্শনে দেখা যায়, বাড়িটিতে উচ্ছেদ কার্যক্রম চলছে। উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা সদুত্তর দিতে পারেনি। উচ্ছেদপ্রক্রিয়ায় গণপূর্ত অধিদপ্তর অবহিত নয়। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বাসার বরাদ্দ বাতিল করে গণপূর্ত অধিদপ্তরকে বুঝিয়ে দিতে বলেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণপূর্ত অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, যে প্রক্রিয়া বাড়িটি উচ্ছেদ করার কথা ছিল, সে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি।

পরিত্যক্ত সম্পত্তি দেখভালের দায়িত্ব যেহেতু গণপূর্ত অধিদপ্তরে রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের, এ ধরনের সম্পত্তিতে অন্য কোনো সংস্থা উচ্ছেদ করতে গেলে বা প্রকল্প নিলে রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগকে অবহিত করা উচিত ছিল। গণপূর্ত অধিদপ্তরে রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগ জায়গাটি উদ্ধার করে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিতে পারত; কিন্তু সে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান সৈয়দ নুরুল বাসির বলেন, জায়গাটি জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের। দীর্ঘদিন এই জায়গা নিয়ে মামলা ছিল। সেটি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। সেখানে যাঁরা বসবাস করছেন, তাঁদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের বাসা ছেড়ে দিতে বলা হয়েছে; কিন্তু তাঁরা ছাড়েননি।

জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘কোনো সরকারি দপ্তর নোটিশ ছাড়া এভাবে কাউকে বাসাছাড়া করতে পারে না। আমরাও তা করিনি।’ বাড়ি ভাঙার আগে কাউকে জানানো হয়নি—এমন অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, সবাইকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। আরও কিছু জানার প্রয়োজন থাকলে তার দপ্তরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন তিনি।

তবে কোনো ধরনের নোটিশ না দিয়েই বাড়ি ভাঙার কাজ শুরু করা হয় বলে অভিযোগ করেন দিলারা হাফিজ। তিনি বলেন, ‘২০১৬ সালে রফিক আজাদ মারা যাওয়ার পর থেকে আমরা তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে এ ভবনটি সংরক্ষণের জন্য সরকারের কাছে বারবার চিঠি দিয়েছি। সর্বশেষ ১১ এপ্রিল গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমানের সঙ্গেও দেখা করেছি। তিনি আমাদের বলেন, এটা আইনের বিষয়, আইন নিজস্ব গতিতে চলবে।’

দিলারা হাফিজ আরও বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে পরিত্যক্ত বাড়িটি আমাকে বসবাসের জন্য দিয়েছিল সরকার। এর পর থেকে আমরা এই বাড়িতে বসবাস করি। কবি রফিক আজাদের অধিকাংশ কবিতা এই ভবনে বসে লেখা৷’

জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, পরিত্যক্ত ওই প্লটের জায়গায় ১০ তলা ভবন নির্মাণ করা হবে। বাড়ি ভাঙার পর সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হবে।