[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

মুক্তিযুদ্ধের শেষের কিছু দিন

প্রকাশঃ
অ+ অ-

হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম

সিলেট রেলস্টেশনে মেজর জেনারেল কে​ ভি কৃষ্ণ রাওয়ের সঙ্গে জেড ফোর্স কমান্ডার জিয়াউর রহমান (বাঁ থেকে দ্বিতীয়), ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ | ছবি: সংগৃহীত

২১ নভেম্বর। প্রথমবারের মতো ৪/৫ গুর্খা ব্যাটালিয়ন এবং ১ম ইস্ট বেঙ্গল এক মাইল গ্যাপ দিয়ে সুরমা নদী অতিক্রম করে জকিগঞ্জ এলাকায় ঢোকে। আটগ্রামে পাকিস্তানিদের রক্ষণভাগে প্রচণ্ড আঘাত হানে গুর্খারা এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করেও পাকিস্তানিদের পরাভূত করে। আটগ্রামের মাইলখানেক পূর্ব দিকে সুরমা নদীর পাড়ে চারগ্রাম বাংলো এলাকায় শত্রুর প্লাটুন ঘাঁটি গেড়েছে। ৪/৫ গুর্খা ব্যাটালিয়নকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল চারগ্রাম দখলের। কিন্তু আটগ্রামে একজন মেজর এবং তিনজন লেফটেন্যান্ট নিহত হওয়ার কারণে তারা চারগ্রামে অভিযান চালাতে অক্ষমতা জানায়। ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার ওয়াটকে জেড ফোর্স কমান্ডারকে অনুরোধ করেন চারগ্রাম আক্রমণ করার জন্য। জিয়াউর রহমান আমাকে হেডকোয়ার্টারে ডেকে নিয়ে চারগ্রাম আক্রমণের নির্দেশ দেন।

আমি বিকেল চারটার দিকে ব্রাভো কোম্পানি নিয়ে চারগ্রাম বাংলো এলাকায় আক্রমণ চালাই। পাকিস্তানি সেনারা সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল এবং ফসলহীন মাঠে আক্রমণকারীদের জন্য কোনো আড়াল ছিল না। আমি শত্রু অবস্থানের ওপর এক ঘণ্টা ধরে থেমে থেমে কামানের গোলা বর্ষণ করি ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায়। কিন্তু দেখলাম, পাকিস্তানি বাহিনীকে অবস্থান থেকে সরানো যাচ্ছে না। অবশেষে ভোররাতে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং বেতার সেট অফ করে দিলাম। নিকটবর্তী গ্রামে কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর প্লাটুন কমান্ডারদের ব্রিফ করলাম। উপলব্ধি করলাম, এ আক্রমণও কামালপুরের মতোই হবে, তবে আমাদের গোলন্দাজ সাপোর্ট রয়েছে এবং শত্রুর মনোবল ততটা চাঙা নয়।

ভোরে আলো ফোটার আগেই আমরা চারগ্রাম বাংলোর ৫০০ গজ দূরে এফইউপিতে পৌঁছাই এবং আল্লাহু আকবর ও জয় বাংলা বলে আক্রমণ চালাই। সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য কামানের গোলা ব্যবহার করিনি। সাইলেন্ট অ্যাটাক। টার্গেটের ৩০০ গজ কাছে যেতেই শত্রুর রাইফেল ও মেশিনগান গর্জে ওঠে। কিন্তু আমরা ভ্রুক্ষেপ না করে দ্রুত এগিয়ে বাংলো এলাকা দখল করি। পাকিস্তানি সেনারা প্যারামিলিটারি থল স্কাউটের সদস্য। তারা পাঁচজন আহত সৈনিককে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। যাওয়ার আগে দুজন বাঙালি রাজাকারকে একটি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখে যায়, সঙ্গে অবাক করা একটি চিরকুট ‘দে আর ট্রেইটরস, সর্ট দেম আউট।’ পড়ে মজা পেলাম আমরা।

চারগ্রাম দখল করে বেতার সেট অন করলাম। জিয়াউর রহমানের কণ্ঠ ভেসে এল, ‘গোলাগুলির শব্দ শুনছি। রিপোর্ট সিচুয়েশন।’

‘আমি অবজেকটিভ (চারগ্রাম বাংলো) দখল করেছি,’ বললাম। জিয়ার বোধ হয় বিশ্বাস হচ্ছিল না। কারণ, আমি কামান ব্যবহার করিনি। বললেন, ‘রিপিট মেসেজ।’

‘চারগ্রাম দখল করেছি এইমাত্র,’ আমি বললাম।

‘কনগ্র্যাচুলেশনস, আমি একটু পরই আসছি।’ জিয়া বললেন।

যুদ্ধজয়ের আনন্দের সঙ্গে কোনো কিছুরই তুলনা হয় না। আমি বুট খুলে একটি টুলের ওপর পা তুলে এক মগ চা খাচ্ছি, এ সময় নদীর ওপারে তিনজন সঙ্গীসহ উপস্থিত হলেন জিয়াউর রহমান। একটি ডিঙিনৌকায় চড়ে তাঁরা এপারে এলেন। আমি নদীর পাড়ে গিয়ে তাঁদের অভ্যর্থনা জানালাম। জিয়া নেমেই বলেন, ‘আই অ্যাম প্রাউড অব ইউ।’ আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। সঙ্গীদের সঙ্গে পরিচিত হলাম। একজন ডিভিশন কমান্ডার মেজর জেনারেল গনজালভেস। শত্রু বাংকারে স্তূপীকৃত গোলাবারুদের পরিমাণ দেখে তাঁরা অবাক হলেন। একটি বাংকারে শাড়ি এবং ভাঙা চুড়ি পাওয়া গেল। জিয়া আনন্দিত হয়ে বললেন, পরদিন থেকে তিনিও আমাদের সঙ্গে থাকবেন।

একই দিনে ভারতীয় বাহিনী উভচর ট্যাংক ব্যবহার করে জকিগঞ্জ সীমান্তঘাঁটি দখল করে নেয়। শত্রু সিলেট শহর রক্ষার জন্য দ্রুত পশ্চাদপসরণ শুরু করে। আমরাও সামরিক কায়দায় তাদের অনুসরণ করতে থাকি।

২৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় আমরা ১ম ইস্ট বেঙ্গল জকিগঞ্জের গৌরীপুর গ্রামে ডিফেন্স নিই। সামনে চার্লি ও ডেল্টা কোম্পানি। পেছনে ব্রাভো ও আলফা। গভীর রাত, জনমানুষের কিংবা পশুপাখির কোনো সাড়াশব্দ নেই। কেবল কোদাল দিয়ে সৈনিকদের ট্রেঞ্চ খোঁড়ার ছপছপ শব্দ। মাঝেমধ্যে দূরবর্তী অঞ্চল থেকে কামানের গোলার ক্ষীণ শব্দ ভেসে আসছে। একসময় আমার সঙ্গে দেখা করতে এল ক্যাপ্টেন মাহবুব। খাকি শার্টের ওপর চেক বেডশিট চাপিয়েছে। আমরা দুই বন্ধু ভেজা ঘাসের ওপর খড় বিছিয়ে ২০ মিনিট ধরে গল্প করলাম। উভয়ের অনুভূতি, চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছি আমরা, পাকিস্তানি সেনারা পলায়নপর। বিদায় নেওয়ার সময় বললাম, ‘টেক কেয়ার, সাবধানে থাকিস।’ মাহবুব রসিকতার সুরে জানাল, ‘এক গণক আমার হাত দেখে বলেছে ৪০ বছর পেরোনোর আগে আমার মৃত্যু নেই। ডোন্ট ওরি, সকালে দেখা হবে।’

পরদিন ২৮ নভেম্বর। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে শত্রুর ৩১ পাঞ্জাব ব্যাটালিয়ন আমাদের ওপর আক্রমণ চালায়। আমরা দৃঢ়ভাবে আক্রমণ প্রতিহত করি। পাকিস্তানি সেনাদের কমান্ডার মেজর সরওয়ারসহ ৫০ জন নিহত হয় এবং ২৫ জন জীবিত অবস্থায় আমাদের হাতে বন্দী হয়।

শত্রু আক্রমণের অপেক্ষায় রুদ্ধশ্বাসে পরিখায় বসে আছি। কানে বেতারযন্ত্রের হ্যান্ডসেট। আমাদের বিভিন্ন কোম্পানি এবং মিত্রবাহিনীর গোলন্দাজ ব্যাটারি কমান্ডার একই ফ্রিকোয়েন্সিতে। গভীর মনোযোগের সঙ্গে বেতার সেটে কথোপকথন শুনছি। মাহবুবের আলফা কোম্পানির ওপর শত্রু আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ সময় মাহবুব ব্যাটারি কমান্ডারের কাছে ম্যাপের গ্রিড রেফারেন্স পাঠিয়ে শত্রুর ওপর গোলা বর্ষণ করার অনুরোধ পাঠাল, ‘ওয়ান রাউন্ড গান ফায়ার।’

মিত্রবাহিনীর ছয়টা গোলা নিক্ষিপ্ত হলো পাকিস্তানি সেনাদের ওপর।

মাহবুব উল্লসিত স্বরে জানাল, ‘অন টার্গেট, ওয়েল ডান। রিপিট। (শত্রু ঘায়েল হয়েছে। আবার এক রাউন্ড করে গোলা বর্ষণ করো)।’

এমন সময় পাকিস্তানিদের কামানের একটিমাত্র গোলার শব্দ পাওয়া গেল। মাহবুবের সাড়াশব্দ নেই। ব্যাটারি কমান্ডারের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, ‘হ্যালো, ওয়ান (মাহবুবের কল সাইন) রিপোর্ট, রিপোর্ট।’

কিন্তু মাহবুবের কণ্ঠস্বর শোনা গেল না।

কিছুক্ষণ পর গোলাগুলির শব্দ থেমে গেল। আমি পূর্ব দিকে মাহবুবের কোম্পানির দিকে এগিয়ে গেলাম। সামনে একটি কাঁচা সড়ক উত্তরে-দক্ষিণে বিস্তৃত। দেখলাম কয়েকজন বন্দী পাঞ্জাবি সৈনিককে চোখ বেঁধে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আলফা কোম্পানির কয়েকজন জওয়ান। একটু পরই এল একটি মৃতদেহ, চারজন বহন করে নিয়ে আসছে। আমাকে দেখেই সুবেদার মেজর মজিদ এবং সুবেদার চাঁদ বখশ হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। চেক বেডশিট জড়ানো মৃতদেহ দেখে আমার মেরুদণ্ডে হিম স্রোত বয়ে গেল। সেই হাসিমুখ, নিমীলিত চোখ। মনে হলো আমাকে বলছে, ‘সকালে দেখা হবে, ডোন্ট ওরি।’

তাকে গৌরীপুর মসজিদের পাশে সমাহিত করা হলো। শোকবিহ্বল গ্রামবাসী গৌরীপুরের নামকরণ করে মাহবুবনগর। যুদ্ধ চলাকালে মাহবুবের শূন্যস্থানে কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয় ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট লিয়াকতকে। একপর্যায়ে সে-ও শত্রুর গুলিতে আহত হলে তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। ডেল্টা কোম্পানির প্লাটুন কমান্ডার সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ওয়াকার পাকিস্তানি বাহিনীর একটি অংশের ওপর কাউন্টার অ্যাটাক করে শত্রুর প্রচুর ক্ষতিসাধন করে।

৩ ডিসেম্বর। পাকিস্তানের যুদ্ধবিমান ভারতের কয়েকটি বিমানঘাঁটিতে একযোগে বোমাবর্ষণ করে। প্রত্যুত্তরে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। আমরা সবাই উল্লসিত, উপলব্ধি করলাম, যুদ্ধ শেষ হতে বেশি সময় লাগবে না। পাকিস্তানের পরাজয় অবধারিত। স্থানীয় জনগণের সমর্থন হারিয়ে এবং ঘৃণার শিকার হয়ে কোনো সেনাবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব নয়।

বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে বিভিন্ন রণাঙ্গনে পর্যুদস্ত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী পিছিয়ে এসে শক্ত প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তুলেছে দরবশত ও খাদিমনগর এলাকায়। সিলেট শহর দখলের পরিকল্পনা করা হলো। স্থির হলো ৫/৫ গুর্খা ব্যাটালিয়নকে হেলিকপ্টারে ড্রপ করা হবে সিলেট শহরের উপকণ্ঠে এবং ১ম ইস্ট বেঙ্গল স্ট্রং পয়েন্ট এড়িয়ে তাদের সঙ্গে লিংক আপ করবে। সিদ্ধান্ত হলো আমরা কানাইঘাট-চুরখাই হয়ে হাওরের ভেতর দিয়ে সিলেট দরবশত সড়কে উঠে পরিস্থিতি দেখে পরবর্তী রুট নির্ধারণ করব।

পুরো ব্যাটালিয়ন সিলেট দখলের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। যেহেতু হাওরের মধ্য দিয়ে এগোতে হবে, আমাদের কয়েক দিন যুদ্ধ চালানোর জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। চিড়া-গুড় আর অ্যামুনিশন বিগ প্যাকে বহন করে পথচলা শুরু হলো। কমান্ডার জিয়াউর রহমানও আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন। কানাইঘাট ইতিমধ্যেই শত্রুমুক্ত হয়েছে। এখান থেকে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল সেকেন্ড লে. জহিরের নেতৃত্বে একটি এমএফ কোম্পানি এবং ক্যাডেট মুদাসসরের অধীন ৮ম বেঙ্গলের ইকো কোম্পানি। ১ হাজার ১০০ সৈনিকের বিরাট বাহিনী নিয়ে সিলেট দখলের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলেছি আমরা। মনোবল তুঙ্গে, বিজয় সন্নিকটে। মিত্রবাহিনীর ব্যাটারি কমান্ডার মেজর রাও আমাদের সঙ্গে চলেছেন। মিত্রবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের সঙ্গে বেতারে যোগাযোগ করছি আমরা।

আমরা পিঠে বোঝা বহন করে সারা রাত হাঁটি, দিনে গোপনীয়তা রক্ষার জন্য ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থাকি। পাকিস্তানি বিমান আক্রমণ করবে, এমন আশঙ্কাও ছিল, কিন্তু তাদের দেখা নেই। ভারতীয় বিমানবাহিনী আকাশে পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করেছে। শেষরাতের দিকে বিশ্রাম নিই। কমান্ডার জিয়ার একটি বিশাল ম্যাপ কেস রয়েছে ৮ ফুট বাই ৮ ফুট। রাতে সেটি বিছিয়ে জিয়া, ক্যাপ্টেন অলি ও আমি শুয়ে থাকি।

১০ ডিসেম্বর। গভীর রাতে সিলেট দরবশত সড়কের পাশে এক গ্রামে অবস্থান নিলাম। জনশূন্য এলাকা। পাঁচজনের রেকি প্যাট্রল নিয়ে সড়কের কাছাকাছি পৌঁছালাম। ধীরগতিতে শত্রুর দুটি সামরিক যান সিলেটের দিকে বাতি নিভিয়ে চলে গেল। অন্ধকারে আরোহীদের সংখ্যা নিরূপণ করা গেল না। একটি ক্রসিং পয়েন্ট চিহ্নিত করে ফিরে এলাম। সড়কের ওপাশেই চা-বাগান।

জিয়াউর রহমান, আমি ও জিয়াউদ্দিন ম্যাপে সিলেট পৌঁছানোর জন্য একটি রুট চিহ্নিত করলাম। পাকা সড়ক বাঁয়ে রেখে চা-বাগানের ভেতর দিয়ে এগোলেই দ্রুত সিলেটের উপকণ্ঠে পৌঁছাব। সিলেট দখলের কৃতিত্ব অর্জন করতে চাই আমরা। চিহ্নিত ক্রসিং পয়েন্ট দিয়ে আমরা চা-বাগানে প্রবেশ করলাম। দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকার ফলে চা-বাগানগুলো ঘন জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। জঙ্গলে ম্যাপরিডিং করে চলা দুষ্কর। কিছুক্ষণ চলার পর মেজর রাও জানালেন, তিনি মিত্রবাহিনীর সঙ্গে বেতার সেটে যোগাযোগ করতে পারছেন না। আমরা এগিয়ে চলেছি জঙ্গল কেটে পথ পরিষ্কার করে। তৃতীয় দিনেই আমাদের শুকনা খাবার ফুরিয়ে গেল, তবু পথচলার বিরাম নেই।

১৪ ডিসেম্বর। ভোররাতে সিলেট শহরের এমসি কলেজের কাছাকাছি ক্যাটল ফার্ম এলাকায় পৌঁছালাম। ভোরের আলো ফুটতেই সামনে টিলার ওপর ২০০ গজ দূরে এমসি কলেজের প্রিন্সিপালের বাসা দৃষ্টিগোচর হলো। সেদিকে মুখ করে ব্রাভো কোম্পানিকে দ্রুত রক্ষণব্যূহ গড়তে নির্দেশ দিলাম। শুরু হলো পরিখা খনন। আমার ডানে ডেল্টা কোম্পানি, পেছনে চার্লি ও আলফা কোম্পানি। এদের সঙ্গেই ব্যাটালিয়ন ও ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার। সামনের টিলায় রোদ পোহানোর জন্য সৈনিকেরা বাংকার থেকে বেরিয়ে এসেছে। চেহারাসুরত, গড়ন দেখে বোঝাই যাচ্ছে এরা পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্য। আমাদের পরনে তাদের মতোই খাকি পোশাক, হাতে একই ধরনের চায়নিজ অস্ত্র। এ মুহূর্তে যুদ্ধ চলছে খাদিমনগর এলাকায়। মুক্তিবাহিনী যে সিলেট শহরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে, এটা তারা ধারণা করেনি।

তারা উর্দু-পাঞ্জাবি ভাষায় চিৎকার করে আমাদের পরিচয় জানতে চায়। আমরা উত্তর না দিয়ে দ্রুত ট্রেঞ্চ খুঁড়ে চলেছি ডিফেন্স নেওয়ার জন্য। আমাদের নীরবতা এবং তাদের দিকে মেশিনগান তাক করে পজিশন নেওয়ার কারণে কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝে গেল আমরা কারা। আধা ঘণ্টার মধ্যেই সংগঠিত হয়ে তারা আমাদের ওপর আক্রমণ চালায়। টিলার ওপরে থাকায় আমরা কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থান থেকে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করি। তাদের জনা চল্লিশেক নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। আমাদের ট্রেঞ্চ অসম্পূর্ণ; হাঁটু পর্যন্তও খোঁড়া হয়নি। ফলে আমাদেরও বেশ ক্ষয়ক্ষতি হলো। ব্রাভো কোম্পানির ৭ জন শহীদ এবং ১৪ জন মারাত্মকভাবে আহত হলো। আমার যোগ্যতম প্লাটুন কমান্ডার সুবেদার ফয়েজ বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে শহীদ হলেন। মেশিনগান ডিটাচমেন্টের দুজন কমান্ডার বাচ্চু মিয়া ও নুরুন্নবীও সাহসিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে শহীদ হলেন। নায়েব সুবেদার হোসেন আলী অসম্পূর্ণ ট্রেঞ্চ থেকে মেশিনগান চালিয়ে শত্রুর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেন। আহত ব্যক্তিদের পেছনে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দিলাম। ডা. মুজিব ফকির তাঁদের জীবন রক্ষাকারী ইনজেকশন দিয়ে কোনোক্রমে বাঁচিয়ে রাখেন।

দুপুরের দিকে হঠাৎ মেজর রাওয়ের সঙ্গে মিত্রবাহিনীর বেতার যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হলো। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কামানের সাহায্য লাগবে কি না। যেহেতু শত্রুবাহিনীর সঙ্গে আমাদের দূরত্ব খুবই কম, কামানের গোলার শিকার আমরাও হতে পারি। রাওকে বিমান হামলার জন্য অনুরোধ পাঠাতে বলি। আধঘণ্টার মধ্যে দুটি ভারতীয় জেট বিমান অধ্যক্ষের বাসা ও বাংকারের ওপর ১০ মিনিট ধরে রকেট নিক্ষেপ করে। আমাদের সৈনিকেরা উল্লসিত হয়ে চিৎকার করে ওঠে, পাকিস্তানি সেনারা নীরবে পরাজয় মেনে নেয়। রকেট হামলার পর তাদের কোনো তৎপরতা দেখা গেল না।

সূত্র: সৈনিক জীবন: গৌরবের একাত্তর, রক্তাক্ত পঁচাত্তর, হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম, প্রথমা প্রকাশন, ২০২০। 

● লেখক: জেড ফোর্সের মুক্তিযোদ্ধা; সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য

Fetching live reactions...
Was this article helpful?

Comments

Comments

Loading comments…
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন