[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর: ঋণ না পেলেও ভবিষ্যতে সহযোগিতার আশ্বাস

প্রকাশঃ
অ+ অ-

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা | ফাইল ছবি

রাহীদ এজাজ: চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ‘কৌশলগত অংশীদারত্বে’ উত্তরণ হলেও ঢাকা বরাবরই বাণিজ্যিক আর অর্থনৈতিক সহযোগিতায় জোর দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সদ্য সমাপ্ত বেইজিং সফরেও বাংলাদেশের অন্যতম অগ্রাধিকার ছিল অবকাঠামো উন্নয়নসহ অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় সহায়তা বাড়ানো।

চীনের সঙ্গে ৫০০ কোটি ডলারের ঋণসহায়তা নিয়ে যে আলোচনা চলছিল, এবারের সফরে বাংলাদেশ এ বিষয়ে অগ্রগতির প্রত্যাশা করছিল। এ সফরে পায়রা বন্দরকে ঘিরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সমন্বিত নতুন পরিকল্পনা দক্ষিণাঞ্চলীয় সমন্বিত উন্নয়ন উদ্যোগে (সিডি) চীনকে যুক্ত করতে আগ্রহী ছিল বাংলাদেশ। এর পাশাপাশি সামগ্রিকভাবে যোগাযোগ অবকাঠামোর বেশ কিছু প্রকল্পে অর্থায়নেরও প্রত্যাশা ছিল।

দেশের আর্থিক সংকট মোকাবিলায় চীনের প্রস্তাবিত ৫০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ চীনা মুদ্রা ইউয়ানে ঋণসহায়তার বিষয়টির সুরাহা এই সফরে হয়নি। তবে এতে যে সময় লাগবে, তার ইঙ্গিত আছে।

কারণ, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে উদ্ধৃত করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেছেন, বাংলাদেশকে অনুদান, সুদমুক্ত ঋণ, রেয়াতি ঋণ ও বাণিজ্যিক ঋণসহায়তা দেবে চীন। এ নিয়ে আলোচনার জন্য চীনের একটি কারিগরি প্রতিনিধিদল খুব শিগগির বাংলাদেশে আসবে। বাংলাদেশকে ৫০০ কোটি ডলারের ঋণ বাণিজ্যিক সহায়তার আওতায় দিতে চেয়েছিল চীন। যদিও আর্থিক সংকট মেটাতে বাংলাদেশের আগ্রহ বাজেট-সহায়তা। অর্থাৎ কারিগরি পর্যায়ে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে সুরাহা করাটা সময়সাপেক্ষ হতে পারে। চীন ১০০ কোটি ইউয়ান (প্রায় ১৬০০ কোটি টাকা) আর্থিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই সহায়তা দেওয়া হবে অনুদান হিসেবে।

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং, প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনা এবং সফর শেষে প্রচারিত যৌথ বিবৃতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ এই সফরে অর্থনৈতিক সহযোগিতায় গুরুত্ব দিয়েছিল। আর চীনের অগ্রাধিকার ছিল রাজনৈতিক সম্পর্ক আর সহযোগিতা জোরদারের মধ্য দিয়ে সম্পর্কের উত্তরণ।

আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশের আর্থিক সংকট মেটাতে জরুরি প্রয়োজন হিসেবে ৫০০ কোটি ডলারের যে ঋণসহায়তা প্রত্যাশিত ছিল, তা পূরণ হয়নি। আবার সিডির মতো নতুন পরিকল্পনায় সমর্থন করে তা অঞ্চল ও পথের উদ্যোগে (বিআরআই) যুক্ততার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের জরুরি ভিত্তিতে যে প্রত্যাশা ছিল, তা অপূর্ণ থেকে গেছে। তবে ভবিষ্যতের দিকটি বিবেচনায় নিলে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় চীনের বড় পরিসরে যুক্ত থাকার প্রতিশ্রুতি আছে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরের মধ্য দিয়ে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ক ‘কৌশলগত অংশীদারত্ব’ থেকে ‘সমন্বিত কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারত্বে’ উন্নীত হয়েছে। যৌথ ঘোষণায় এমনটাই বলা হয়েছে। সাধারণত কৌশলগত অংশীদারত্বের প্রসঙ্গ এলে স্বভাবতই প্রতিরক্ষা আর নিরাপত্তার উপাদানগুলোর কথা মাথায় আসে। তবে এবারের যৌথ ঘোষণা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সমন্বিত কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারত্বের মধ্য দিয়ে চীন মূলত রাজনৈতিক পরিসরে বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারত্ব বাড়ানোর দিকে মনোযোগী ছিল। এর প্রতিফলনও যৌথ ঘোষণায় রয়েছে।

বিশেষ করে বাংলাদেশ যখন এই সফরে অর্থনৈতিক সহযোগিতায় মনোযোগী ছিল, চীনের মনোযোগ ছিল রাজনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানো। এ জন্য চীন ‘এক চীন’ আদর্শ, তাইওয়ান চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ আর প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের তিন উদ্যোগ জিএসআই (বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগ), বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগ (জিডিআই) ও বৈশ্বিক সভ্যতা উদ্যোগে (জিসিআই) বাংলাদেশের যুক্ততার বিষয়ে চীন যথেষ্ট আগ্রহী ছিল। তবে এবার চীন বেশ কিছুটা দর-কষাকষি করে ‘এক চীন নীতির’ পরিবর্তে ‘এক চীন আদর্শ’—এই ধারণা ঘোষণায় যুক্ত করেছে। চীনের দাবি হচ্ছে, ‘নীতি’ বিষয়টি পশ্চিমা ধারণা। কাজেই তারা ‘আদর্শ’ বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বাংলাদেশ এই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে তাইওয়ান যে চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তা মেনে নিয়েছে। যার প্রতিফলন আছে যৌথ ঘোষণায়।

তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেইজিং সফর শুরুর আগেই স্পষ্ট ছিল যে ৫০০ কোটি ডলারের ঋণ না পেলে বাংলাদেশ জিডিআইয়ের সমঝোতা স্মারক সই করবে না। এমনকি যৌথ ঘোষণায় জিডিআইতে ভবিষ্যতে যুক্ততার বিষয়টি বাংলাদেশ উল্লেখ করতে সম্মতি দেবে না। গত বুধবার গ্রেট হল অব দ্য পিপলে শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনায় সি চিন পিং জিএসআই, জিডিআই এবং জিসিআইয়ে বাংলাদেশের যুক্ততার অনুরোধ জানান। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী চীনের প্রেসিডেন্টের অনুরোধের বিষয়ে সম্মতি দেননি বলে জানা গেছে। যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, দুই দেশ চীনের প্রেসিডেন্টের জিডিআইয়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে। বাংলাদেশের কাছে জিডিআইয়ের অভিজ্ঞতা বিনিময়ে তৈরি আছে চীন।

চীনের শিংহুয়া ইউনিভার্সিটির ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ইনস্টিটিউটের গবেষণা বিভাগের পরিচালক কিয়ান ফ্যাং গ্লোবাল টাইমস পত্রিকাকে বলেন, অর্থনীতি ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সফর দুই দেশের উচ্চতর সম্পর্কের বিকাশে অতীত ও বর্তমানের সেতুবন্ধ।

সামগ্রিকভাবে এবারের সফরের দিকে তাকালে দেখা যাবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেইজিং সফর শেষ পর্যন্ত শুধু দুই দেশের সম্পর্কের স্বার্থের পরিসরে সীমিত থাকেনি। এর সঙ্গে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিসরের নানা উপাদান জড়িয়েছে। যুক্ত হয়েছে ভূরাজনীতি ও ভূ-অর্থনীতি। গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর নিয়ে বেশ উন্মুখ ছিল বেইজিং। নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ তার পশ্চিমা মিত্রদের চাপ, চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে ভারতের মনোভাব—এসব বিষয় সরকার বিবেচনায় নিয়েছে।

নির্বাচনের পর ভারত ও চীন দুই দেশেই প্রধানমন্ত্রী সফর করবেন এটি সরকার স্পষ্টই জানিয়েছে। যদিও চীনের প্রত্যাশা ছিল, শেখ হাসিনা দিল্লি যাওয়ার আগে বেইজিং যাবেন। এমন এক প্রেক্ষাপটে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি যান। এর ফলে দিল্লিতে শেখ হাসিনার পরিকল্পিত দ্বিপক্ষীয় সফর নিয়ে অল্প সময়ের জন্য জল্পনা তৈরি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি আগে দিল্লি গেছেন, এরপর বেইজিং।

কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, গত তিন সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি আর বেইজিং সফর থেকে স্পষ্ট যে চীনের মতো ভারতের সঙ্গে সফরের আলোচনা সীমিত থাকে দ্বিপক্ষীয় পরিসরে। ওই সফরে দুই দেশের অভিন্ন ৫৪ নদীর অন্যতম তিস্তার পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এসেছে। এর ফলে তিস্তায় চীনের বৃহদায়তনের প্রকল্পের ভবিষ্যৎ আপাতত তিরোহিত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে চীনের মনোযোগ ছিল। আবার শেখ হাসিনার চীন সফরে কী ঘটতে চলেছে, তা নিয়ে আগ্রহ ছিল ভারতেরও।

ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রার কাছে শেখ হাসিনার চীন সফর নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন সাংবাদিকেরা। এই সফর নিয়ে দিল্লির কৌতূহল আছে তার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত আছে ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের কথায়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই ব্রিফিংয়ে বিনয় কোয়াত্রা বলেছিলেন, দুই শীর্ষ নেতার আলোচনা দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতায় কেন্দ্রীভূত ছিল। তবে সহযোগিতার পরিধি বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। দুই দেশের কৌশলগত ও নিরাপত্তা স্বার্থ এবং চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সুযোগ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে দুই দেশের আলোচনায় তৃতীয় দেশের প্রসঙ্গটি অনিবার্যভাবে এসেছে।

জানতে চাইলে চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বলেন, ভূরাজনীতি আর ভূ-অর্থনীতির প্রসঙ্গ আলোচনায় আগেও ছিল, এখনো আছে। তবে চীন অংশীদার হিসেবে চায় বাংলাদেশকে। অন্য কোনো দেশের মতো পক্ষ-বিপক্ষ বেছে নিতে জোর দেয় না। এই সফরটা বেশ ভালো হয়েছে। বিশেষ করে সম্পর্কের আরেক ধাপ উত্তরণ ঘটেছে। আর ঋণের বিষয়ে তো বলাই হয়েছে, খুঁটিনাটি বিভিন্ন বিষয় সুরাহার জন্য একটি কারিগরি দল বাংলাদেশে আসবে। সিডিতে সমর্থন দিয়ে তাকে বিআরআইয়ে যুক্ত করার কথাও যৌথ ঘোষণায় বলা আছে। সামগ্রিকভাবে এতে ভবিষ্যৎমুখী সহযোগিতার স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে।

Fetching live reactions...
Was this article helpful?

Comments

Comments

Loading comments…
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন