[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

বগুড়ায় এত বাল্যবিবাহ কেন, কী বলছেন বাসিন্দারা

প্রকাশঃ
অ+ অ-

বাল্যবিবাহ | প্রতীকী ছবি

নাজনীন আখতার: কিশোর-কিশোরী ক্লাবের অনুষ্ঠানে আর সবার সঙ্গে গাইত মেয়েটি, ‘প্রতিদিন তোমায় দেখি সূর্য-রাগে।’ লাল-সবুজ শাড়ি, টিকলি-টায়রা, কানে দুল আর মাথায় প্লাস্টিকের ফুল লাগিয়ে ‘জ্বলে ওঠো বাংলাদেশ’ গানের সঙ্গে নাচত। সেই জ্বলে ওঠা আর হয়নি মেয়েটির।

২০২২ সালের শেষের দিকে এক ঈদের ছুটিতে বিয়ে হয়ে যায় মেয়েটির। তখন সে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে স্কুল ও ক্লাবের পাটও চুকে যায় তার। ছোটখাটো গড়নের, দুর্বল মেয়েটির কোলে এখন আট মাসের কন্যাশিশু।

জন্মনিবন্ধন অনুসারে মেয়েটির বয়স ১৪ বছর। থাকে শ্বশুরবাড়িতে; বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার আটমূল ইউনিয়নে। গত ১৮ এপ্রিল সেখানেই কথা হয় তার সঙ্গে। বেলা তখন ১১টা। কোলের শিশুটি বিছানায় ঘুমাচ্ছে। টিনের চালা আর মাটির মেঝের ঘর। বারান্দায় প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে বসে কথা শুরু হয়। মেয়েটি জানায়, এনজিও টিএমএসএসের কিশোর-কিশোরী ক্লাবের সদস্য থাকার সময় নানা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছে। সেবার (২০২২) অনুষ্ঠানের পাঁচ দিন পর তার বিয়ে হয়ে যায়।

এত ছোট থাকতে মা-বাবা কেন বিয়ে দিলেন—জানতে চাইলে লাজুক হাসে মেয়েটি। বলে, ‘দাদির হাউস থেকে মা-বাবা বিয়ে দিছে। মা-বাবা বলছে, এখনকার দিন-সমাজ ভালো না। ভালো ছেলে পাইছে, তাই বিয়া দিয়া দিছে।’ মেয়েটির বাবা ইজিবাইকের চালক। চার বোনের মধ্যে সে সবার বড়। স্বামী (২৪) ইটভাটায় কাজ করেন। পড়াশোনা কেন বন্ধ হলো জানতে চাইলে বলল, স্বামী চান না।

ওই বাড়ি থেকে বের হতেই মেয়েটির জায়ের সঙ্গে দেখা হয়। খড়ের গাদা গোছাতে গোছাতে ১৬ বছরের এই মেয়ে জানাল, বছরখানেক আগে মালয়েশিয়াপ্রবাসীর সঙ্গে মুঠোফোনে তার বিয়ে হয়েছে। স্বামীকে এখনো সামনাসামনি দেখেনি।

জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বাল্যবিবাহের প্রবণতা নিয়ে গত এপ্রিলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদন বলছে, বাল্যবিবাহের উচ্চ হারের দিক থেকে বগুড়া শীর্ষ তিন জেলার একটি। বাকি দুই জেলা জয়পুরহাট ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ। জেলায় ১৮ বছরের নিচে বাল্যবিবাহের হার ৬৩ শতাংশের বেশি। আর ১৫ বছরের নিচে এ হার ২০ শতাংশের বেশি। বাল্যবিবাহের হার বেশি শিবগঞ্জ ও সারিয়াকান্দি উপজেলায়, যথাক্রমে যা ৬৩ ও ৬৫ শতাংশ।

বিবিএসের হিসাবে ২০২৩ সালে দেশে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বাল্যবিবাহের হার প্রায় ৪২ শতাংশ; যা ২০২২ সালের তুলনায় ১ শতাংশ ও ২০২১ সালের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি।

১৭ ও ১৮ এপ্রিল এই প্রতিবেদক বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার আটমূল, শিবগঞ্জ ইউনিয়ন, শিবগঞ্জ পৌরসভা এবং সারিয়াকান্দি উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চল শিমুলতাইর গ্রাম ঘুরে দেখেন। স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, বাল্যবিবাহ সেখানে খুব স্বাভাবিক। ঈদের ছুটিতে মেয়েকে বিয়ে দেওয়া এক মা বলছিলেন, ‘ছোট মেয়েরা সংসারের সগলের সাথে মিলামিশা থাকে। তাই লোকজন ছোট মেয়েক বিয়া করতে চায়। মেয়েক কষ্ট কইরে বড় করমু, আর সে নিজের ইচ্ছামতো বিয়া করবি! এটা কি মেনে নিমু?’

সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ী ইউনিয়নের দুর্গম চর শিমুলতাইর। নৌ ও সড়কপথ মিলিয়ে সেখানে পৌঁছানো গেল। কথা হলো অনেকের সঙ্গে। এই গ্রামের কাজি মো. দুলালউদ্দিন শেখের মেয়ে পঞ্চম শ্রেণির পর আর পড়েনি। ঈদের ছুটিতে তিনি মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। এলাকার কেউ কেউ এটাকে বাল্যবিবাহ বললেও দুলালউদ্দিন দাবি করেন, মেয়ের বয়স ১৯ বছর।

বাল্যবিবাহের জন্য সামাজিক সচেতনতার অভাব ও অজ্ঞতাকে দায়ী করলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় মূল কারণগুলো খুঁজে দেখছে। পাশাপাশি বাল্যবিবাহ নিরোধ কমিটিগুলোকে আরও কার্যকর করা হচ্ছে।

 আরও যত অজুহাত
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করে ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ বা টিএমএসএস। এই সংস্থার যুগ্ম পরিচালক মো. কামরুজ্জামান খান মাঠপর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, আগে বাল্যবিবাহের পেছনে দারিদ্র্যকে প্রধানত দায়ী করা হতো। কিন্তু এখনকার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। দিনকাল ভালো না, স্মার্টফোনের কারণে ছেলেমেয়ে ‘নষ্ট’ হয়ে যাচ্ছে—এমন সব অজুহাতে মেয়েদের বাল্যবিবাহ দেওয়া হচ্ছে।

বাল্যবিবাহের শিকার যেসব মেয়ের সঙ্গে এই প্রতিবেদক কথা বলেছেন, তাদের কারও বিয়ে নিবন্ধিত হয়নি। বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলেও বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে অভিভাবকেরা এক হয়ে যান। কেউ কারও মেয়ের বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে জানাতে চান না। বিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক সময় স্কুলের দীর্ঘ ছুটি যেমন বার্ষিক পরীক্ষার পর, রমজান ও ঈদের ছুটির সময়টাকেও কাজে লাগান তাঁরা।

টিএমএসএসের তথ্য বলছে, সংস্থার কিশোর-কিশোরী ক্লাবের সদস্য ছিল, এমন ১৮টি মেয়ের বাল্যবিবাহ হয়ে গেছে এবারের ঈদুল ফিতরের ছুটিতে।

এত সব খবরের মধ্যে স্বস্তি পাওয়া গেল শিবগঞ্জ সদর ইউনিয়নের পশ্চিম জাহাঙ্গীরাবাদ গ্রামের একটি বাড়িতে ঢুকে। এই বাড়ির মেয়েটি নিজের বাল্যবিবাহ ঠেকিয়েছিলেন। মেয়েটি গত বছর উচ্চমাধ্যমিক পাস করে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অপেক্ষায়। তিনি জানান, আশপাশের বাল্যবিবাহের শিকার অনেক মেয়ের করুণ অবস্থা দেখে তিনি বিয়েতে রাজি হননি।

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকারের যেসব ব্যবস্থা আছে, সেগুলোকে সক্রিয় করলেই সাফল্য আসবে বলে মন্তব্য করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী। তিনি বলেন, নারী উন্নয়নে বাংলাদেশ এগিয়ে গেলেও হোঁচট খেতে হচ্ছে বাল্যবিবাহের কারণে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। মা-বাবাকে বোঝাতে হবে বাল্যবিবাহ না দিয়ে মেয়েটিকে পড়াশোনা শিখিয়ে স্বনির্ভর করে কীভাবে ভবিষ্যতের ভালো নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা যায়।

আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে—এমন প্রত্যয় ব্যক্ত করে বাল্যবিবাহ ঠেকানো মেয়েটি বলছিল, ‘বিয়ে পরে করব। আগে পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই; যাতে সংসারে কোনো ঝামেলা হলে মা-বাবার বোঝা না হই।’

Fetching live reactions...
Was this article helpful?

Comments

Comments

Loading comments…
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন