মুহূর্তেই পাবিপ্রবি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের পরিবার শেষ, সড়কেই ঈদের আনন্দ মাটি
![]() |
| সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী-সন্তান হারানো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফিরোজ হোসেনকে সান্ত্বনা দিতে আসেন পত্নীতলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পপি খাতুন। শনিবার দুপুরে উপজেলার চকগোছাই গ্রামে র | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি নওগাঁ: প্রতিবছর ঈদের সময় স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যান পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ফিরোজ হোসেন (৩৫)। গ্রামের বাড়িতে মা-বাবা, ভাই-বোনসহ স্বজনদের নিয়ে একসঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করেন। কখনো এর ব্যত্যয় ঘটেনি। সন্তানেরাও দাদার বাড়িতে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল থাকত। এবারও ফিরোজ বাড়িতে এসেছেন। তবে আসতে পারেনি তাঁর স্ত্রী-সন্তানেরা।
গত বৃহস্পতিবার রাতে পাবনা থেকে নওগাঁয় যাওয়ার পথে মান্দা উপজেলার বিজয়পুর এলাকায় নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কে সড়ক দুর্ঘটনায় ফিরোজ হোসেনের স্ত্রী রেশমা আক্তার (৩০) ও ছেলে ফারাবি হোসেন (৫) নিহত হয়েছে। দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মেয়ে ফারিহা (৮) রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। ফিরোজের একটি হাত ভেঙে গেছে।
স্বজনেরা জানান, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে গ্রামের বাড়ি নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার চকগোছাই গ্রামে ফিরছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফিরোজ হোসেন। পাবনা থেকে বাসে রাজশাহীতে আসার পর সেখান থেকে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় গ্রামের বাড়িতে ফিরছিলেন। মান্দা উপজেলার বিজয়পুর এলাকায় পৌঁছানোর পর বিপরীত দিক থেকে আসা একটি পিকআপের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলেই ফিরোজের পাঁচ বছর বয়সী ছেলে নিহত হয়। রাজশাহী মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় স্ত্রীর মৃত্যু হয়। আট বছর বয়সী ছোট্ট ফারিহার হাত ও পা ভেঙে গেছে। এ ছাড়া পেট ও লিভারে গুরুতর আঘাত পাওয়ায় এখন সে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।
আজ শনিবার দুপুরে ফিরোজের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আধপাকা বাড়িতে অনেক মানুষের ভিড়। সবার মধ্যে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। বাড়ির উঠানে বসে বিলাপ করছিলেন ফিরোজ ও তাঁর মা-বাবা। এ সময় আত্মীয়স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
![]() |
| নিহত রেশমা আক্তার ও ফারাবি হোসেন (ডানে) | ছবি: সংগৃহীত |
ফিরোজ হোসেন বলেন, ‘আমার কলিজা ফারাবি ওর মায়ের কোলে বসে ছিল। মেয়ে ফারিহা আমার কোলে ছিল। মায়ের কোল থেকে ছিটকে আমার বাচ্চাটা পড়ে যায়। সিএনজি উল্টে আমরা নিচে চাপা পড়ি। এরপর আর কিছু মনে নেই। আমার যখন জ্ঞান ফিরল, তখন শুনি ফারাবি আর ওর মা আর নেই। মেয়েটাও হাসপাতালে ছটফট করছে। আমার ছেলে-মেয়ে দাদার বাড়িতে আসার জন্য ব্যাকুল থাকত। আল্লাহ কিসের জন্য আমাকে এত কষ্ট দিল?’ একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
ফিরোজের ছোট ভাই ফারুক হোসেন বলেন, ‘ভাই দূরে থাকায় ঈদ ছাড়া পরিবার নিয়ে গ্রামে কম আসতেন। ভাই, ভাবি ও ভাতিজা-ভাতিজিরা বাড়িতে এলে আমাদের ঈদ পরিপূর্ণ হতো। বৃহস্পতিবার ওদের আসার খবরে আমরা সবাই মুখিয়ে ছিলাম। ওরা এলে সবাই একসঙ্গে ঈদের আনন্দ উপভোগ করব। ওরা যখন রাজশাহীতে, তখনো চাচার সঙ্গে ভাইয়ের কথা হয়। কিছুক্ষণ পরই আব্বার কাছে মান্দা থানা থেকে ফোন আসে, ওদের সিএনজি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। এর পর থেকে আমাদের সব আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়েছে।’
সারা বছর ঈদের দিনের জন্য অপেক্ষা করতেন ফিরোজের বাবা শাহজাহান হোসেন। তিনি বলেন, ‘ছোট নাতি ফারাবি কথা বলতে শিখেছে। মোবাইলে কল দিলে সে বলত, “দাদু এবার অনেক দিন গ্রামের বাড়িতে থাকব। অনেক মজা করব।” বাড়িতে এলে ফারাবি আমার পিছু ছাড়ত না। দুই ভাই-বোন পুরা বাড়ি মাতিয়ে রাখত। এক দুর্ঘটনায় আমার দাদুভাই ও বউমা আমাদের মাঝ থেকে চলে গেল। ফুটফুটে নাতনিটাও হাসপাতালে শুয়ে কাতরাচ্ছে। কত আশা ছিল, ঈদে নাতি-নাতনি নিয়ে অনেক আনন্দ করব। দুর্ঘটনায় সব শেষ হয়ে গেল।’
মান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোজাম্মেল হক কাজী বলেন, নিহত রেশমা ও ফিরোজ হোসেন দম্পতি পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ঈদের ছুটি কাটাতে দুই সন্তানকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি পত্নীতলায় যাচ্ছিলেন। পথে বিজয়পুর এলাকায় মর্মান্তিক দুর্ঘটনার শিকান হন। দুর্ঘটনাকবলিত পিকআপ ও সিএনজি থানায় আছে। চালক ও তাঁর সহকারী পলাতক। এ ঘটনায় থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।


Comments
Comments