[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

ইউএনওর বিদায়ে এলাকাবাসীর কান্না, নিজেও কাঁদলেন জোবায়ের

প্রকাশঃ
অ+ অ-

চট্টগ্রামের আনোয়ারা থেকে বিদায় নেওয়ার সময় ইউএনও শেখ জোবায়ের আহমেদকে জড়িয়ে ধরে কান্না করেন অনেকে। ২৪ জানুয়ারি, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

নিজস্ব প্রতিবেদক: চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় ৩ বছর ১১ মাস উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন শেখ জোবায়ের আহমেদ। তিনি পদোন্নতি পেয়ে চলে যাচ্ছেন, এ খবরে গত মঙ্গলবার উপজেলা চত্বরে বসে কাঁদছিলেন বারখাইন ইউনিয়নের শোলকাটা এলাকার প্রায় ৫০ বছর বয়সী রহিমা বেগম। তাঁর ভাষায়, ‘টিয়ুনু বলে যাইবগু? এহন আঁরে হনে চাইবু (ইউএনও নাকি চলে যাচ্ছে, এখন আমাকে কে দেখবে?)।’

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সরওয়ার জামান এসেছিলেন শেখ জোবায়ের আহমেদকে বিদায় জানাতে। ইউএনও থাকা অবস্থায় জোবায়ের আহমেদ চাতরী চৌমুহনী বাজারে সরওয়ার জামানকে দোকান করে দিয়েছেন। ওই দোকানের আয়েই তাঁর সংসার চলছে।

ফুল ছিটিয়ে, বুকে জড়িয়ে ধরে কোনো স্বজনের বিদায়ে যেমন মানুষ পিছু পিছু অনেক দূর পর্যন্ত এসে বিদায় দেন, শেখ জোবায়ের আহমেদের বিদায়েও তেমনই করেন আনোয়ারা উপজেলার অনেক বাসিন্দা। আর বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের এমন ভালোবাসায় শেখ জোবায়ের বিদায়ের সময় নিজেও কেঁদেছেন। বিদায়ের সেই ভিডিও ও ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ঘুরছে। একাধিকজন ফেসবুকে পোস্ট দিয়েও জোবায়ের আহমেদের বিদায়ে কেন কেঁদেছেন বা অন্যরা কেঁদেছেন, সে কথা লিখছেন।

পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগ দেওয়ার জন্য শেখ জোবায়ের আহমেদ বর্তমানে গোপালগঞ্জে আছেন। বুধবার সকালে ঢাকা থেকে মুঠোফোনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। বিদায়ের সময় কান্নার প্রসঙ্গ বলতেই মুঠোফোনে হেসে বললেন, কাউকে নির্দেশ দিয়ে বা বলে–কয়ে তো কাঁদানো যায় না। কান্নাটা ভেতর থেকে আসতে হয়। তিন বছরের বেশি সময়ে আনোয়ারার জনগণের সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল, তাই তিনি কেঁদেছেন এবং মানুষ ভালোবাসার জায়গা থেকে কেঁদেছেন।

আনোয়ারার একাধিক মানুষ  বলেছেন, ইউএনও হিসেবে শেখ জোবায়ের আহমেদ যখন দায়িত্ব পালন করেছেন, তখন তাঁর হাসিমুখ দেখে সবাই ভরসা পেতেন, কথা বলার সাহস পেতেন। আর শেখ জোবায়ের বললেন, ‘একজন ইউএনওর কাছে মানুষ কিছু প্রত্যাশা নিয়ে আসেন। আমার সঙ্গে সবাই কথা বলতে পেরেছেন। আমি মানুষের কথা শুনেছি। ফোনে, হোয়াটসঅ্যাপেও অনেকে যোগাযোগ করেছেন। আমি চেষ্টা করেছি মানুষের ভোগান্তি কমাতে। ইউএনও হিসেবে কাজের দায়িত্বের বাইরেও মানুষকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। কেউ হয়তো পাসপোর্ট–সংক্রান্ত ঝামেলায় আছেন, পাসপোর্ট অফিসে আমার কেউ পরিচিত থাকলে তাঁকে সমস্যাটি সমাধানের অনুরোধ করেছি। এভাবেই মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।’

মানুষ কেন কাঁদলেন
শেখ জোবায়ের আহমেদের নেতৃত্বে তিন বছরে দুবার জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যক্রমে দেশসেরা উপজেলা হয়েছে আনোয়ারা। উপজেলা সদরে স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য, মিনি শিশু পার্ক তৈরি, দুটি নান্দনিক পুকুরঘাট নির্মাণ, উপজেলা সদরের একমাত্র খেলার মাঠটির উন্নয়ন, গাছ লাগিয়ে পরিষদ চত্বরকে সাজানো, পাঠাগার, ব্যায়ামাগার, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র—এ ধরনের বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরি ও নানা উদ্যোগ নিয়েছেন জোবায়ের আহমেদ। এগুলো মানুষের কোনো না কোনো কাজে লেগেছে বা তাঁদের মধ্যে ভালোলাগা তৈরি হয়েছে।

শেখ জোবায়ের বলেন, ‘অবকাঠামো নির্মাণ বা উন্নয়ন ইউএনওর দায়িত্ব নয়। আমি এগুলো করেছি নতুন কিছু করতে ভালো লাগে সে কারণে। বলা যায়, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাজগুলো করেছি। তবে এ ধরনের অবকাঠামো তৈরির জন্য মানুষ আমার জন্য কাঁদেননি, কেঁদেছেন তাঁদের সঙ্গে আমার যে যোগাযোগ ছিল, সে জন্য।’ বিজয় কনসার্ট, স্বাধীনতা কনসার্ট, উপজেলার জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনার মতো আয়োজনগুলোতে মানুষের সমর্থন পান জোবায়ের আহমেদ। 

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আনোয়ারা উপজেলায় ইউএনও হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন শেখ জোবায়ের আহমেদ। ইউএনওর বিভিন্ন সৃজনশীল পরিকল্পনায় সহযোগিতা করেন উপজেলা চেয়ারম্যান তৌহিদুল হোক চৌধুরীসহ অন্যরা। আনোয়ারা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফেরদৌস হোসেন বলেন, শেখ জোবায়ের একজন ‘ডায়নামিক লিডার’ ছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে পড়াশোনা করা জোবায়ের আহমেদ বারবার বলছিলেন, তিনি ইউএনও হিসেবে বিভিন্ন কাজের নেতৃত্ব দিয়েছেন বা সমন্বয় করেছেন। তবে কাজগুলো বাস্তবায়নে সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরি ছিল।

জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যক্রমে দেশসেরা উপজেলা হওয়ার পেছনেও সম্মিলিত উদ্যোগ ছিল বলে উল্লেখ করে জোবায়ের আহমেদ বলেন, তিনি যখন ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব নেন, তখন এ কার্যক্রমের সফলতার হার খুবই কম ছিল। ইউনিয়ন পরিষদ, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থা এ কাজের সঙ্গে জড়িত। ইউএনও হিসেবে তিনি নেতৃত্ব ও কাজের সমন্বয় করেছেন। আগাম জন্ম তথ্য জেনে হবু মাকে চিঠি লেখা, নবজাতককে টিকা দিতে আসার পর পরবর্তী টিকা নিতে হলে জন্মনিবন্ধন কার্ড লাগবে—এটি বলে দেওয়া, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইমামদের মাধ্যমে মসজিদে বিষয়টি জানানোসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়। শিক্ষা বিভাগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও সহায়তা করেছেন। এ ছাড়া ইউএনও হিসেবে শেখ জোবায়ের যখন যেখানে গিয়েছেন, সেখানেই জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। সব মিলে মানুষ উদ্বুদ্ধ হয়েছিল বলেই সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি মেলে।

শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র তৈরি প্রসঙ্গে জোবায়ের বলেন, ‘আমার স্ত্রী শারমীন আরা চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক। তিনি বর্তমানে উচ্চতর পড়াশোনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। আমাদের সাত ও পাঁচ বছর বয়সী দুই ছেলে এবং মেয়ে আছে। আমি আমার স্ত্রীকে দেখে বুঝেছি, কর্মজীবী নারীদের সন্তানের জন্য ডে কেয়ার সেন্টার বা শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র থাকা কতটা জরুরি।’

জোবায়ের আহমেদ জানান, পরিষদের নতুন ভবন তৈরি হলে আগের ভবনে তাঁর ও ভাইস চেয়ারম্যানের কক্ষটিকে ব্যবহার করার জন্য ডে কেয়ার সেন্টার হিসেবে তৈরির উদ্যোগ নেন। সেন্টার তৈরি এবং বেবি সিটারের বেতন দিতে অনুরোধ করা হয় আলাম্মা আবুল খায়ের ফাউন্ডেশনকে। ফাউন্ডেশন এ কাজে সহায়তা করে। ফাউন্ডেশন কখনো বেবি সিটারের বেতন না দিতে পারলে পরিষদ যাতে বেতন দেয়, তারও ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এক নারী তাঁর নবজাতক সন্তানকে ফেলে চলে গিয়েছিলেন। জোবায়ের আহমেদ ওই নবজাতককে কোলে নিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন, যত দিন কেউ এই নবজাতকের দায়িত্ব না নেবে, তত দিন তিনি নিজেই দায়িত্ব নিলেন। তিনি জানান, এ পোস্টের পর দেশ ও বিদেশের অনেক নিঃসন্তান দম্পতি নবজাতককে নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করেন। পরে পরিষদের কমিটির মাধ্যমে এক দম্পতিকে এ নবজাতককে লালন-পালনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। জোবায়ের আহমেদ জানালেন, মাঝেমধ্যে তিনি নিজেও বিভিন্ন শিশুর পড়াশোনার জন্য আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন।

টাঙ্গাইলের ছেলে জোবায়ের আহমেদ আনোয়ারায় ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার এক বছরের মাথায় দেশব্যাপী করোনা মহামারি আকারে হানা দেয়। তিনি বলেন, করোনায় তিনি আনোয়ারা উপজেলার মানুষের অনেক কাছাকাছি পৌঁছানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি তিনি মানুষের মনে সাহস দিতে পেরেছিলেন। এর আগেও চট্টগ্রাম বিভাগে অন্য পদে দীর্ঘদিন কাজের অভিজ্ঞতায় জোবায়ের চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা বুঝতে পারেন, অল্প বলতেও পারেন। করোনার সময় তিনি আঞ্চলিক ভাষায় (স্ক্রিপ্ট দেখে পড়েছেন) এক ভিডিও বার্তা দেন, যা মানুষ খুব পছন্দ করে। আনোয়ারার সবার জ্বর সারলে তিনি বাড়িতে যাবেন, ফেসবুকে এমন একটি লেখা পোস্ট করেছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের একটি সংলাপের কথা মাথায় রেখে। এটাও মানুষ ইতিবাচকভাবে নিয়েছিল। তিনি করোনার টিকা গ্রহীতাদের ফুল আর নাশতার প্যাকেট দিয়ে প্রশংসিত হন। ওই সময় শেখ জোবায়ের আহমেদ তিনবার করোনায় আক্রান্ত হন।

জোবায়ের আহমেদের ছেলে-মেয়েরা যখন দেশে ছিল, তখন তারা আনোয়ারায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে। এলাকায় অন্যান্য কিন্ডারগার্টেন স্কুল বা ভালো স্কুল থাকতে ছেলে–মেয়েদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ানোর কারণও জানালেন তিনি। বললেন, তাঁর মা জোবাইদা আখতার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। জোবায়ের নিজেও প্রাথমিক বিদ্যালয়েই পড়াশোনা করেছেন। তাই তিনি ও তাঁর স্ত্রী চেয়েছেন, ছেলে-মেয়েরা প্রাথমিক বিদ্যালয়েই পড়াশোনা করবে।

জোবায়ের আহমেদ বলেন, তিনি আনোয়ারা ছেড়ে যাচ্ছেন এ খবরে তাঁর ছেলে-মেয়েরা খুশি হয়নি। কেননা, তাদের বন্ধুরা তো সব এখানেই থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে বসে আনোয়ারার মানুষের কান্নার ভিডিও দেখে স্ত্রীও কেঁদেছেন উল্লেখ করে জোবায়ের বলেন, এলাকার মানুষ তাঁর স্ত্রীকেও আপন করে নিয়েছিলেন। তাই তিনিও ভিডিও দেখে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি।

Fetching live reactions...
Was this article helpful?

Comments

Comments

Loading comments…
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন