নিউইয়র্কের দেয়ালে এক টুকরো বাংলাদেশ
![]() |
| নিউইয়র্কের জ্যামাইকার প্রধান সড়কের পাশে বসানো ম্যুরালের সামনে এর শিল্পী টিপু আলম | ছবি: সংগৃহীত |
বিশেষ প্রতিবেদক: এক-দেড় দশক আগেও নিউইয়র্কের জ্যামাইকার অধিকাংশ বাসিন্দা ছিল অশ্বেতকায়, প্রধানত ক্যারিবীয় অঞ্চল থেকে আসা অভিবাসী। সেই উপশহর এখন নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে, এর প্রধান অধিবাসী হয়ে উঠছে অভিবাসী বাঙালি। অধিকাংশ নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকও তাঁরাই। সে কারণে একে এখন ‘লিটল বাংলাদেশ’ নামে অভিহিত করা হয়। এই নামে একটি রাস্তার নামকরণও করা হয়েছে। এখানে নগর প্রশাসনের উদ্যোগে একটি সরকারি উদ্যানে স্থাপিত হয়েছে ২১ ফেব্রুয়ারি স্মরণে একটি স্মৃতিফলক।
রোববার সেই জ্যামাইকার প্রধান সড়কের পাশে স্থাপিত হলো একটি ম্যুরাল, যেখানে ধরা পড়েছে এক টুকরো বাংলাদেশ। বাঙালি মালিকানাধীন তাজমহল পার্টি হলের বহির্দেয়ালে নির্মিত ৩২ বাই ২০ ফুট দীর্ঘ এই ম্যুরালটির শিল্পী টিপু আলম। অ্যাক্রেলিকে আঁকা ম্যুরালটির বিষয় একটি শাপলা ঝিল। টলটলে জলে তাজা একগুচ্ছ শাপলা, যা দেখে কারও কারও মনে ফরাসি চিত্রকর ক্লদ মোনের আঁকা শাপলা ঝিলের কথা মনে পড়বে। নরমান্ডির গিভারনি গ্রামে মোনের আঁকা ঝিলে শাপলা রয়েছে ঠিকই। যা নেই তা হলো বাংলাদেশের আকাশ। টিপু আলমের ম্যুরালটির উপরিভাগজুড়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ শরতের আকাশ, তার রং হালকা নীল ও সাদা। বাঙালির চোখে এই আকাশ শুধু তার নিজস্ব, তার একার।
ম্যুরালটি উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের দুই মুক্তিযোদ্ধা কণ্ঠশিল্পী কাদেরী কিবরিয়া ও রথীন্দ্রনাথ রায়। তাঁরা দুজনই দীর্ঘদিন প্রবাসে, অথচ এক মুহূর্তের জন্য ‘বাংলাদেশ ছেড়ে অন্য কোথাও যাননি’। ম্যুরালটির দিকে তাকিয়ে প্রায় বাক্রুদ্ধ কণ্ঠে সে কথাই বললেন রথীন্দ্রনাথ রায়। তিনি বলেন, ‘যে ছবি আমরা বুকের ভেতর নিয়ে ঘুরি, এখন তা নিউইয়র্কের দেয়ালে। এ তো ঠিক যেন এক টুকরো বাংলাদেশ।’
শিল্পী টিপু আলমও দীর্ঘদিন প্রবাসে, এই নিউইয়র্কে বসেই তিনি প্রায় নিরলসভাবে বাংলাদেশকে তুলে ধরছেন নানাভাবে। এর আগে ব্রঙ্কসে আরেক বাঙালি–অধ্যুষিত এলাকায় তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষাসৈনিকদের স্মৃতির প্রতি উৎসর্গীকৃত আরেকটি দীর্ঘ ম্যুরাল নির্মাণ করেন। সে কথা স্মরণ করে উদ্বোধনীতে আগত একজন দর্শক বললেন, ‘সেদিন দূরে নয়, যেদিন এই শহরকে আমরা বাংলাদেশের ছবি দিয়ে রাঙিয়ে তুলব।’
উদ্বোধন শেষে দর্শকদের মুক্তিযুদ্ধের গান গেয়ে শোনান দুই অতিথি কণ্ঠযোদ্ধা। শুরুতেই রথীন্দ্রনাথ রায় শোনান, ‘আমার এ দেশ সব মানুষের’। তিনি প্রবীণ শিল্পী, ভরাট গলা, তাতে বিন্দুমাত্র মরচে ধরেনি। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এই গান তিনি বহুবার গেয়েছেন। একাত্তরের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বললেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সারা দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল। সে যুদ্ধের অলিখিত দ্বাদশ সেক্টর ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। তাঁর সে কথার সঙ্গে সম্মত হলেন কাদেরী কিবরিয়া। জলদগম্ভীর কণ্ঠে যখন তিনি গান ধরলেন, ‘ও আমার দেশের মাটি’। অনুষ্ঠানকেন্দ্রে আগত অনেকের চোখেই ছিল স্মৃতিকাতর চোখের জল।

Comments
Comments