[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমেছে, তবু দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য অপরিবর্তিত

প্রকাশঃ
অ+ অ-
জ্বালানি তেল | গ্রাফিক্স: পদ্মা ট্রিবিউন 

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অনেক কমেছে। কিন্তু দেশে কমেছে খুবই সামান্য; বরং বেশি দাম রাখার ফলে সরকারের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) মুনাফা আরও বেড়েছে।

বিপিসি গত অর্থবছরে (২০২৪-২৫) ৪ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা মুনাফা করেছে, যেখানে আগের অর্থবছরে (২০২৩-২৪) মুনাফা ছিল ৩ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় (২০২৪ সালের মার্চ) বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখে দেশে প্রতি মাসে জ্বালানি তেলের (ডিজেল, পেট্রল, অকটেন ও কেরোসিন) দাম নির্ধারণ শুরু হয়। ওই সরকার ভর্তুকি তুলে নেয়। তখন ‘অব্যবস্থাপনা ও লুটপাটের’ কারণে অর্থনীতি সংকটে পড়েছিল।

বিপিসি জ্বালানি তেল থেকে শুধু বড় অঙ্কের মুনাফাই করছে না, সরকারের আয়ও অনেক। জ্বালানি তেলের ওপর শুল্ক–কর আরোপ করে সরকার প্রতি অর্থবছরে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে।

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ২০২৪ সালের মার্চে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল বা ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের ব্যারেলপ্রতি (১৫৯ লিটার) দাম ছিল ৮৫ মার্কিন ডলারের কিছু বেশি। গত অক্টোবরে এই দাম নেমে আসে প্রায় ৬৪ ডলারে। ফলে তখনকার তুলনায় দাম এখন ২৫ শতাংশ কম। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, এই সময়ে ডলারের দাম বেড়েছে ১১ শতাংশ। সরকার ডিজেলের দাম কমিয়েছে মাত্র ৪ শতাংশের মতো।

বিপিসি শুধু জ্বালানি তেল থেকে বড় অঙ্কের মুনাফাই করছে না, সরকারের আয়ও অনেক। জ্বালানি তেলের ওপর বিভিন্ন শুল্ক–কর আরোপ করে সরকার প্রতি বছর প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পায়। বিপিসির নিরীক্ষিত হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শুল্ক–কর বাবদ সরকারের আয় হয়েছে ১৪ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা।

বিপিসি বছরে প্রায় ৬৮ লাখ টন জ্বালানি তেল সরবরাহ করে। এর মধ্যে ৬২ শতাংশ যায় পরিবহন খাতে এবং ১৫ শতাংশ কৃষি খাতে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে দফায় দফায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় পরিবহন ভাড়া এবং কৃষি উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যায়। এরপর নানা কারণে বাড়তে থাকে নিত্যপণ্যের দাম। ফলে মূল্যস্ফীতি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ওই অভ্যুত্থানে সবচেয়ে বেশি প্রাণ হারান শ্রমজীবী মানুষ।

অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, আয়করের মতো প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে না পেরে, ধনী ও সচ্ছলদের কাছ থেকে যথেষ্ট কর আদায় করতে না পেরে এবং বড় বড় প্রকল্প নিয়ে বিপাকে থাকা বিগত সরকার রাজস্ব আয়ের জন্য জ্বালানি তেলের মতো খাতকে বেছে নিয়েছিল। সে অবস্থার পরিবর্তন তেমন একটা হয়নি।

অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে মূল্যস্ফীতি কমেছে, তবে তা এখনো ৮ শতাংশের বেশি। ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি অনেকটা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ তা করতে পারেনি। অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ মনে করেন, যদি জ্বালানি তেলের দাম কমানো হতো, পরিবহন ভাড়া ও উৎপাদন খরচও কমানোর সুযোগ তৈরি হতো। এতে সাধারণ মানুষ সুফল পেত।

জ্বালানি তেল একটি কৌশলগত পণ্য। এর ব্যবসা সরকারের হাতে থাকে, মুনাফার জন্য নয়, বরং নিরাপত্তা ও জনগণের জন্য সাশ্রয়ী মূল্য নিশ্চিত করতে। তবে বিগত সরকার এটিকে আয়ের বড় উৎসে পরিণত করেছিল। এখনো সেই প্রক্রিয়া চলছে।

অর্থনীতিবিদেরা বলেন, আয়করের মতো প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে না পারা, ধনী ও সচ্ছলদের কাছ থেকে যথেষ্ট কর আদায় করতে না পারা, এবং বড় প্রকল্প নিয়ে বিপাকে থাকা বিগত সরকার রাজস্ব আয়ের জন্য জ্বালানি তেলের মতো খাতকে বেছে নিয়েছিল। সেই পরিস্থিতি এখনও তেমন বদলায়নি।

যদিও জ্বালানি তেল থেকে মুনাফা আসে, বিদ্যুৎ খাতে সরকারকে বড় ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে প্রায় ৬২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। বিগত সরকারের সময় একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মাশুল দিতে হচ্ছে। বর্তমান সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়ায়নি। জ্বালানি তেলের দাম না কমানোর যুক্তি হলো, দাম কমালে প্রতিবেশী দেশে তেল পাচারের শঙ্কা থাকে। এছাড়া বিপিসির মুনাফার টাকা দিয়ে বিভিন্ন প্রকল্পও বাস্তবায়ন করা হয়।

বিপিসির মুনাফা কারও বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বরং উন্নয়নকাজে বিনিয়োগের জন্য এটি ব্যবহৃত হয়। জ্বালানি তেল পরিশোধন সক্ষমতা বাড়াতে নতুন শোধনাগার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যাতে বিপিসি অর্থায়ন করবে।

— মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, বিপিসির মুনাফা কারও ব্যক্তিগত বাড়ি বা খাতে যায় না। বরং এটি উন্নয়নকাজে বিনিয়োগের জন্য ব্যবহার করা হয়। জ্বালানি তেল পরিশোধন সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নতুন শোধনাগার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা অর্থায়ন করবে বিপিসি।

বিপিসির নতুন শোধনাগারের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১২ সালে। তখন তারা লোকসান ভোগ করছিল। ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে বিপিসি মুনাফা করতে শুরু করে। গত এক দশকে জ্বালানি তেল বিক্রি করে করপোরেশনটি ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে। এর মধ্যে শুধু ২০২১-২২ অর্থবছরে তারা ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা লোকসান করে। উল্লেখ্য, প্রকল্পটি বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশনের পর্যবেক্ষণে রয়েছে।

২০২৪ সালেও বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের গড় দাম ৭০ ডলারের ঘরে ছিল। আর এখন এটি নেমে এসেছে ৬২ থেকে ৬৪ ডলারে।

বিশ্ববাজারে দাম কমেছে
জ্বালানি তেল আমদানি ও বিক্রির একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান হলো বিপিসি। এর অধীনে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নামে তিনটি কোম্পানি ডিলারদের মাধ্যমে তেল বিক্রি করে।

বিগত কয়েক বছরে জ্বালানি তেলের দামে বড় ধরনের ওঠানামা হয়েছে। করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম গড়ে ছিল ৪২ মার্কিন ডলার। পরের বছর বাজার অস্থির হয়ে ওঠে।

তেলের দাম বড় উল্লম্ফন ঘটায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর। ২০২২ সালে তেলের গড় দাম প্রতি ব্যারেলে ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। ওই বছরের সর্বোচ্চ দাম উঠেছিল ১৩৯ ডলার পর্যন্ত। এর ফলে বিশ্বজুড়ে জিনিসপত্রের দামও বেড়ে যায়। ওই বছরের আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম সর্বোচ্চ সাড়ে ৪২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ব্যাপক সমালোচনার মুখে ওই মাসে মাত্র ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ দাম কমানো হয়, যা প্রতি লিটারে ৫ টাকা হ্রাস পায়। এরপর প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিন বিক্রি হয় ১০৯ টাকায়, পেট্রল ১২৫ টাকায় এবং অকটেন ১৩০ টাকায়।

২০২৪ সালেও বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের গড় দাম ছিল ৭০ ডলারের কাছাকাছি। বর্তমানে এটি নেমে এসেছে ৬২ থেকে ৬৪ ডলারের মধ্যে।

 
বাজারদরের কথা বললেও তা এড়িয়ে সুবিধামতো মূল্য নির্ধারণের স্বয়ংক্রিয় সমন্বয়ের সূত্র তৈরি করা হয়েছে। সূত্রে ৯টি জায়গায় দুর্বলতা জানানোর পর বর্তমান সরকার দুটি সংশোধন করেছে। তাই বিশ্ববাজারে দাম কমলেও ভোক্তা বাড়তি দামে কিনছে, আর বিপিসি মুনাফা করছে। এটি গ্রহণযোগ্য নয়।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, সিপিডির গবেষণা পরিচালক
দেশে এখন ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ১০৪ টাকা, পেট্রল ১২০ টাকা এবং অকটেন ১২৪ টাকা। এই মাসেই প্রতি লিটারে ২ টাকা করে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে।

বিপিসির কর্মকর্তারা বলেন, বিশ্ববাজারে দাম কমলেও সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজারে প্রভাব পড়ার সুযোগ নেই। কারণ তেল কেনার পর দেশে আসতে এক মাস সময় লাগে। ২১ অক্টোবর থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে দাম সমন্বয় করা হয়েছে, এবং ওই সময়ে বিশ্ববাজারে দাম বর্তমানের তুলনায় বেশি ছিল।

তবে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গত বছরের নভেম্বরেও বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, বাজারদর অনুযায়ী নির্ধারণ করলে ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা কমানো সম্ভব। একটি সূত্র অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকার মাসে মাসে দাম নির্ধারণের কথা বলেছিল, যদিও পুরো সূত্রটি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাজারদরের কথা বললেও তা এড়িয়ে সুবিধামতো মূল্য নির্ধারণের স্বয়ংক্রিয় সমন্বয়ের সূত্র তৈরি করা হয়েছে। সূত্রে ৯টি জায়গায় দুর্বলতা চিহ্নিত হওয়ার পর বর্তমান সরকার দুটি সংশোধন করেছে। তাই বিশ্ববাজারে দাম কমলেও ভোক্তা বেশি দামে কিনছেন, আর বিপিসি মুনাফা করছে। তিনি বলেন, তেল পাচারের যুক্তি হাস্যকর। সীমান্তের অজুহাতে দেশের ভোক্তাকে বঞ্চিত করার সুযোগ নেই।
 

বিপিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে জ্বালানি তেল চুরি, দুর্নীতি ও অদক্ষতার অভিযোগ রয়েছে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, চুরি, দুর্নীতি ও অদক্ষতা কমাতে পারলে জ্বালানি তেলের দাম কমানো যাবে।

বিপিসির আন্তর্জাতিক নিরীক্ষার দাবি
অকটেন ও পেট্রল বিক্রি করে বিপিসি সব সময় মুনাফা করে। মূলত ডিজেলের ওপরই বিপিসির লাভ-লোকসান নির্ভর করে। দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৭৫ শতাংশই ডিজেল। দেশের একমাত্র শোধনাগার থেকে পাওয়া যায় ৬ লাখ টন ডিজেল, বাকিটা আমদানি করতে হয়।

বিপিসির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে জ্বালানি তেল চুরি, দুর্নীতি ও অদক্ষতার অভিযোগ রয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, চুরি, দুর্নীতি ও অদক্ষতা কমালে জ্বালানি তেলের দাম কমানো সম্ভব হবে।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, ‘এক দশক আগেই বিপিসির আন্তর্জাতিক নিরীক্ষার দাবি তোলা হয়েছিল। আজও তা হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘সারা দুনিয়ার নিয়ম হলো সরকার সেবা দেবে, মুনাফা করবে না। অথচ শুল্ক–করের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব নেওয়া হলেও সরকার তা উন্নয়নে বিনিয়োগ করছে না। বিনিয়োগের নামে বিপিসি বাড়তি মুনাফা করছে।’

একটি মন্তব্য করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন