নারীর অধিকার ও মর্যাদায় নূরজাহান বেগম প্রেরণার উৎস
![]() |
| নূরজাহান বেগমের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণানুষ্ঠানে অতিথিরা। রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে; ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৫ | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
নূরজাহান বেগম শুধু একজন সম্পাদক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি আন্দোলনের নাম। তাঁর সম্পাদিত সচিত্র বেগম পত্রিকা বাংলাদেশের নারীদের অধিকার, মর্যাদা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। দেশের রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভেতর থেকেও তিনি নারীর অধিকার ও মর্যাদার প্রশ্নে সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর জীবন ও কর্ম নতুন প্রজন্মের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
আজ শুক্রবার বিকেল চারটায় রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে নারীবিষয়ক পত্রিকা বেগম-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, নারী জাগরণের অগ্রদূত নূরজাহান বেগমের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে স্মরণানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। খিলগাঁওয়ের ইসলামী পাঠাগার ও সমাজকল্যাণ পরিষদ অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে। এতে নারী নেত্রীবৃন্দ, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজচিন্তার বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা অংশ নেন।
আলোচক ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও প্রাবন্ধিক মফিদুল হক, কবি ও প্রাবন্ধিক মোরশেদ শফিউল হাসান এবং কবি ও গবেষক দিলারা হাফিজ। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন ইসলামী পাঠাগারের সহসভাপতি মজিবর রহমান আখন্দ। বক্তারা নূরজাহান বেগমের কর্মময় জীবন, সাহসী চিন্তা ও সমাজ পরিবর্তনে তাঁর ঐতিহাসিক অবদানের কথা স্মরণ করেন।
নূরজাহান বেগমের জন্ম ১৯২৫ সালের ৪ জুন চাঁদপুর জেলার চিলাতলী গ্রামে। ২০১৬ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। ব্রিটিশ শাসনামলের রক্ষণশীল সামাজিক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে তিনি নারীর শিক্ষা, অধিকার ও আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন সামনে এনেছিলেন। নারীবিষয়ক সচিত্র পত্রিকা বেগম ১৯৪৭ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল।
জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানের গুরুত্ব উল্লেখ করে মফিদুল হক বলেন, 'বেগম সমাজের অনেক ঘটনা তুলে ধরেছে, যা সমাজে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে ভূমিকা রেখেছে। নারীশিক্ষা ও অধিকার চমৎকারভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।' পত্রিকার পাশাপাশি নূরজাহান বেগম বেগম ক্লাব নামের একটি নারীমুখী ক্লাবও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেখানে নারীরা বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতেন।
![]() |
| অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি মফিদুল হক। রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। ২৬ ডিসেম্বর | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
মোরশেদ শফিউল হাসান বলেন, বেগম ছিল পারিবারিক পত্রিকা। যে বাড়িতে শিক্ষিত মহিলা থাকতেন, সেসব বাড়িতে বেগম পত্রিকা রাখা হতো। প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদে বেগম রোকেয়ার ছবি প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকাটিতে নারী লেখকদের ছবিও ছাপা হতো। সে সময় এটি ছিল অসাধারণ ঘটনা এবং সাহসী উদ্যোগ।
বেগমের সম্পাদকীয় বিষয়ে বিশেষভাবে মন্তব্য করে মোরশেদ শফিউল হাসান বলেন, এগুলোর ভাষা ও শৈলী অসাধারণ ছিল। নারীদের সমস্যা মূল ফোকাস হলেও আরও অনেক বিষয়ও এতে থাকত। বেগম পত্রিকার নির্বাচিত লেখা পরে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।
দিলারা হাফিজ বলেন, 'বেগম পত্রিকার ছবি দেখলেই আমরা নারী জাগরণের কথা স্মরণ করতে পারি। নারীদের লেখা ও তাদের ছবি প্রকাশ করা হতো। এটি নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস ছিল।' তিনি জানান, নিজের অনেক কবিতাও বেগম পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। প্রায় ৬০ বছরের সম্পাদকের জীবনে তিনি নারী জাগরণের কাজে অবদান রেখেছেন।
অনুষ্ঠানের সভাপতি মজিবর রহমান আখন্দ বলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ব্যক্তিদের কাজ নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতেই ইসলামী পাঠাগার ও সমাজকল্যাণ পরিষদ এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করে। তিনি বলেন, এর ধারাবাহিকতায় নূরজাহান বেগমের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে এই স্মরণানুষ্ঠান করা হয়েছে। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ইসলামী পাঠাগারের সম্পাদক আহাদুল ইসলাম।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই নূরজাহান বেগমের জীবন ও কর্মের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
নূরজাহান বেগমের বাবা ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক এবং সওগাত পত্রিকার সম্পাদক নাসিরউদ্দীন। মা ফাতেমা খাতুন। নূরজাহান বেগম ১৯৪২ সালে বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত কলকাতার সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। পরে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে ১৯৪৪ সালে উচ্চমাধ্যমিক এবং ১৯৪৬ সালে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন।
![]() |
| বক্তব্য দেন কবি ও গবেষক দিলারা হাফিজ। রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। ২৬ ডিসেম্বর | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
এই পত্রিকার প্রথম চার মাস সম্পাদক ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। নূরজাহান বেগম ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। প্রথমে এটি ছিল সাপ্তাহিক পত্রিকা। পরে তিনি সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে নূরজাহান বেগমরা ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকা থেকে তাঁর সম্পাদনায় বেগম প্রকাশিত হতে থাকে। তাঁর জীবনসঙ্গী ছিলেন বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক রোকনুজ্জামান খান (দাদা ভাই)।
দীর্ঘ সময় ধরে বেগম পত্রিকার মাধ্যমে নূরজাহান বেগম অসংখ্য নারী লেখককে আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দেন। অনেক নারী সাহিত্যিক ও সাংবাদিকের পথচলার শুরু এই পত্রিকার হাত ধরে। নারীর কণ্ঠস্বরকে তুলে ধরা, তাদের অভিজ্ঞতাকে ভাষা দেওয়া এবং সমাজে সম্মানজনক অবস্থান প্রতিষ্ঠায় নূরজাহান বেগম ও তাঁর সম্পাদিত বেগম পত্রিকার অবদান তাৎপর্যপূর্ণ।
বেগম বাংলা ভাষায় নারীবিষয়ক সাংবাদিকতার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এই পত্রিকা শুধু সাহিত্য বা গৃহস্থালির পরামর্শেই সীমাবদ্ধ ছিল না; পত্রিকাটি নারীর রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক বৈষম্য, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের প্রশ্নকে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছিল।
নূরজাহান বেগমের জন্মশতবর্ষের আলোচনায় বক্তারা এ বিষয়গুলোই সামনে এনেছিলেন। তাঁদের আলোচনায় বিস্মৃতি থেকে নতুন করে সামনে আসেন নূরজাহান বেগম।



Comments
Comments