প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা বাড়ছে, সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন
| গুলি | গ্রাফিক্স: পদ্মা ট্রিবিউন |
সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক পাপ্পু শেখ। ১৮ বছর বয়সী এই যুব তার পরিবার নিয়ে রাজধানীর জুরাইন এলাকায় থাকতেন। সোমবার সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হওয়ার মাত্র ১০ মিনিট পর তাকে জুরাইন কনকর্ড স্কুলের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ সময় আরেকজন আহত হন।
পাপ্পুর পরিবার জানিয়েছে, ওই এলাকার কানা জব্বারের ছেলে বাপ্পা ও স্থানীয় কানচিসহ কয়েকজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী পাপ্পুকে গুলি করে পালিয়েছে। এর কিছুদিন আগে বাপ্পার ভাতিজা হিমেলের সঙ্গে পাপ্পুর ঝগড়া হয়েছিল। নিহতের পরিবার মনে করছে, সেই ঘটনার জের ধরে পাপ্পুকে হত্যা করা হয়েছে।
ঘটনার পর র্যাব-১০ হত্যাকাণ্ডে জড়িত দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। এর আগে রোববার একটি মামলায় হাজিরা দিয়ে খুলনা মহানগর ও জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রধান ফটকের সামনে হাসিব হাওলাদার (৪০) ও ফজলে রাব্বি রাজন (৩৫) আদালত পাড়ায় মোটরসাইকেলের ওপর বসে গল্প করছিলেন। তারা দুজনই শীর্ষ সন্ত্রাসী পলাশ গ্রুপের সহযোগী। গল্প করার সময় প্রকাশ্যে ভরদুপুরে তাদের মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
তারা শুধু গুলি করেই থামেনি, যাওয়ার সময় ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুনিরা এলোপাতাড়ি কুপিয়ে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। এ সময় আশপাশের মানুষদের মধ্যে চরম আতঙ্ক তৈরি হয় এবং শুরু হয় ছোটাছুটি। নিহতরা হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি ছিলেন।
গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, এই হত্যাকাণ্ডে নগরীর অপর সন্ত্রাসী গ্রেনেড বাবুরও সম্পৃক্ততা রয়েছে। শুধু জুরাইন ও খুলনার আদালতপাড়া নয়, সাম্প্রতিক সময়ে সারা দেশে প্রকাশ্য গুলি করে হত্যার ঘটনা বেড়েছে। সন্ত্রাসীরা এখন বেপরোয়া। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, পূর্বশত্রুতা, চাঁদাবাজি ও দখলবাজিসহ নানা কারণে তারা গুলি করে হত্যা করছে।
এসব ঘটনায় দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতির চিত্র যেমন সামনে এসেছে, ঠিক তেমনি সাধারণ মানুষরা নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। বিশেষ করে আদালত প্রাঙ্গণের মতো নিরাপদ এলাকায়ও প্রকাশ্য গুলি করে হত্যার ঘটনা শঙ্কা তৈরি করেছে। ঢাকার আদালতপাড়ায়ও গত মাসে এক সন্ত্রাসীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে যখন অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি বেশি থাকে, তখন প্রকাশ্য গুলি করে হত্যার ঘটনা বেড়ে যায়।
বিশেষ করে গত বছরের ৫ই আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হাসিনা সরকারের পতনের পর পুলিশি দুর্বলতার কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির দিকে যায়। ওই সময় বিভিন্ন থানায় দুর্বৃত্ত হামলা চালিয়ে লুটপাট করে পুলিশি অস্ত্র নিয়ে যায়। এ ছাড়া গণভবনে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এসএসএফ সদস্যদের অস্ত্রও লুট হয়। এসব অস্ত্রের বড় অংশ এখনও উদ্ধার হয়নি।
পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গণ-অভ্যুত্থানের সময় সারা দেশের থানা ও কারাগার থেকে ৫ হাজার ৭৫০টি অস্ত্র লুট হয়েছিল। এর মধ্যে ৪ হাজার ৪০৮টি অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। এখনও ১ হাজারের বেশি অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে এসএমজি, অ্যাসল্ট রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল ও এলএমজি রয়েছে। শুধু অস্ত্র নয়, সেই সময় গোলাবারুদও লুট হয়েছিল, যা পুরোপুরি উদ্ধার হয়নি। এসব অস্ত্র উদ্ধার না হওয়ায় নিরাপত্তার ঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।
এক দিকে এসব অস্ত্র ব্যবহার করে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, অন্য দিকে এগুলো সন্ত্রাসী, চরমপন্থী, উগ্রবাদী, জঙ্গি ও জেল পলাতক সন্ত্রাসীদের কাছে যাচ্ছে। গোয়েন্দারা এসব অস্ত্রের হদিস পাচ্ছেন না। ফলে শঙ্কা রয়ে যাচ্ছে, কোথায় কখন এসব অস্ত্র ব্যবহার হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র বলছে, দেশের অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে পার্শ্ববর্তী দুই দেশ থেকে অস্ত্র ঢুকছে। সীমান্তের অন্তত ১৮–৩০টি পয়েন্ট দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র প্রবেশ করছে। অস্ত্র চোরাচালানকারীরা একই রুট দীর্ঘদিন ব্যবহার করে না। কারণ ওই রুটে নজরদারি বেড়ে যায়। তারা সুযোগ সুবিধামতো রুট পরিবর্তন করছে।
গত ১১ই নভেম্বর পুরান ঢাকায় প্রকাশ্যে সন্ত্রাসী তারেক সাইদ মামুনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আদালতপাড়ায় এই হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। ১৫ই নভেম্বর লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জের পশ্চিম লতিফপুর এলাকায় ওয়ার্ড বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক আবুল কালামকে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। রাজধানীর পল্লবীতে এক যুবদল নেতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৭ই নভেম্বর পল্লবীর একটি হার্ডওয়্যারের দোকানে প্রবেশ করে মুখোশ ও হেলমেট পরা সন্ত্রাসীরা গুলি করে পল্লবী থানার সদস্য সচিব গোলাম কিবরিয়াকে হত্যা করেছে। আগের মাসে চট্টগ্রামে চলন্ত প্রাইভেট কার থামিয়ে প্রকাশ্যে দিন-দুপুরে বিএনপি সমর্থিত এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। নিহত ব্যক্তি বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতা ও রাউজানের সাবেক এমপি গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
গোয়েন্দা তথ্য বলছে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের অন্যতম মাফিয়া ইমন ব্যাংককে ঢাকার মাফিয়া ডন আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের ডেরায় বসে ঢাকার অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণ ঠিক করছেন। মোহাম্মদপুরের আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জোসেফ আন্ডারওয়ার্ল্ডে সক্রিয় তৎপরতা চালাচ্ছেন। মালয়েশিয়া থেকে রাজধানীর ধানমণ্ডি, নিউমার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড ও হাজারীবাগ এলাকায় সন্ত্রাসী বাহিনী পরিচালনা করছেন সানজিদুল ইসলাম ইমন। মোহাম্মদপুর ও আশপাশ এলাকায় নিজের সন্ত্রাসী বাহিনী চালাচ্ছেন পিচ্চি হেলাল। ইতিমধ্যে দখলবাজি, চাঁদাবাজি ও খুনোখুনিতে জড়িত থাকার অভিযোগে ইমন, পিচ্চি হেলাল এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা ও জিডি হয়েছে। গত বছর ক্ষমতার পালাবদলের পর ইমন ও পিচ্চি হেলাল বাহিনীর মধ্যে আধিপত্যের লড়াই চলছে। একপর্যায়ে পিচ্চি হেলাল দেশের বাইরে চলে যাওয়ায় মোহাম্মদপুরের নিয়ন্ত্রণ ইমনের হাতে চলে যায়। সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ গ্রেপ্তারের পর মামুন ওই এলাকার নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছিলেন। উদিকে ক্লাবপাড়া, মতিঝিল, খিলগাঁওসহ কয়েকটি এলাকার নিয়ন্ত্রণ করছে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান গ্রুপের সদস্যরা।
অপরাধ ও সমাজবিজ্ঞানী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, একই ধরনের অপরাধ যখন ক্রমাগত ঘটে, তখন বোঝা যায় যারা দায়িত্বে আছেন তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। যতটুকু পারছেন ততটুকু অপরাধীরা ভয় পাচ্ছে না। তাদের মধ্যে সতর্কতাও বাড়ছে না, আর অপরাধ থেকে দূরে থাকার মনোভাব তৈরি হচ্ছে না। তিনি বলেন, এসব ঘটনার তিনটি মূল কারণ রয়েছে।
প্রথমত, থানা থেকে পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। নির্দেশনা অনুযায়ী বাতিল করা লাইসেন্সধারী অস্ত্র থানায় জমা না দেওয়া এবং সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অস্ত্র ঢুকছে। ফলে সন্ত্রাসীদের হাতে এখন অনেক অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। দ্বিতীয়ত, গণ-অভ্যুত্থানের আগে ও পরে দেশের কারাগার ভেঙে দাগী সন্ত্রাসী পালিয়ে গেছে, জামিনে যেসব সন্ত্রাসী মুক্তি পেয়েছে, তাদের উপর পুলিশ নজরদারি করা হয়নি। তৃতীয়ত, প্রকাশ্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। পুলিশ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতে গিয়ে চিন্তা করছে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় কী। সন্ত্রাসীরা প্রভাবশালী হলেও ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, এটা জাতীয় ও রাজনৈতিক সমস্যা। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে সমাধান সম্ভব নয়। এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজনৈতিক কমিটমেন্ট দরকার। সন্ত্রাসীদের দমন করার সিদ্ধান্ত সেখান থেকে আসতে হবে। তা না হলে একেক সময় একেক সন্ত্রাসী দেশ জুড়ে আতঙ্ক তৈরি করবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন