‘অত্যন্ত সংকটাপন্ন’ খালেদা জিয়া, শঙ্কা কাটেনি
![]() |
| বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া | ফাইল ছবি |
বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ফুসফুসে সংক্রমণ থেকে শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এরপর দেখা দেয় নিউমোনিয়া। এর সঙ্গে আছে কিডনি, লিভার, আর্থ্রাইটিস ও ডায়াবেটিসের পুরোনো সমস্যা। ফলে পরিস্থিতি এমন—একটি রোগের চিকিৎসা দিতে গেলে আরেকটির ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।
এমন অবস্থায় খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থাকে ‘অতি সংকটময়’ বলেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দলের নেতারা বলছেন, গত দুই দিনে তাঁর অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। চিকিৎসকেরা তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দ্রুত সিঙ্গাপুরে নেওয়ার বিষয়ে ভাবছেন।
এদিকে খালেদা জিয়ার বর্তমান শারীরিক অবস্থা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি খালেদা জিয়ার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন। তাঁর সুস্থতা কামনা করে গতকাল শুক্রবার সারা দেশের মসজিদে মসজিদে দোয়া ও মোনাজাত করেছে বিএনপি।
খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় গত রোববার। সেদিন তাঁর শ্বাসকষ্ট খুব বেড়ে যায়। দ্রুত তাঁকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাৎক্ষণিক নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তাঁর চিকিৎসা শুরু হয়। অবস্থার অবনতি হলে দুই দিন আগে তাঁকে কেবিন থেকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করা হয়। সেখানে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে মেডিকেল বোর্ড তাঁর চিকিৎসা চালাচ্ছে। শারীরিক অবস্থার অবনতির খবরে বিএনপির নেতা–কর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বেড়েছে।
লন্ডনে থাকা বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান সার্বক্ষণিক তাঁর শারীরিক অবস্থার খবর জানছেন। জুবাইদা রহমান খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শামিলা রহমান শাশুড়ির সঙ্গে হাসপাতালে রয়েছেন।
গতকাল বিকেলে হাসপাতালে যান মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তাঁরা সিসিইউতে প্রবেশ করেননি। বাইরে থেকে দেখে ফিরে আসেন। পরে হাসপাতালে উপস্থিত সাংবাদিকদের আমীর খসরু বলেন, ‘আমরা দূর থেকে দেখেছি। ইনফেকশনের ঝুঁকি আছে, তাই সিসিইউতে যাওয়া যায় না। আমরা চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলেছি। ম্যাডামের অবস্থার উন্নতি নেই। মেডিকেল বোর্ড চেষ্টা করছে।’
![]() |
| বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার খবর নিতে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে আসছেন বিএনপির নেতা–কর্মীরা। শুক্রবার রাতে হাসপাতালের সামনে তাঁদের একটি দল | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় দেশি–বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ড প্রতিদিন বৈঠক করে চিকিৎসা দিচ্ছে।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের আগে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দুই মামলায় খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড হয়। দুই বছরের বেশি সময় তিনি কারাগারে ছিলেন। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ তৎকালীন সরকার নির্বাহী আদেশে তাঁর সাজা স্থগিত করে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেয়। এরপর প্রতি ছয় মাস পরপর আবেদনের ভিত্তিতে তাঁর সাজা স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছিল। তবে চিকিৎসার জন্য তাঁকে বিদেশে যেতে দেওয়া হয়নি।
গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর খালেদা জিয়া মুক্তি পান। গত ৮ জানুয়ারি তিনি চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে যান। চার মাস পর ৬ মে দেশে ফেরেন।
অবস্থা ‘অত্যন্ত সংকটময়’
এ দফায় খালেদা জিয়া অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তাঁর জন্য সারা দেশে দোয়ার আয়োজন করছে বিএনপি। গতকাল ছিল মসজিদে দোয়া ও বিশেষ মোনাজাতের কর্মসূচি। গতকাল জুমার নামাজ শেষে নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে খালেদা জিয়ার সুস্থতার জন্য বিশেষ দোয়ায় অংশ নেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। সেখানে তিনি খালেদা জিয়ার অবস্থা অত্যন্ত সংকটময় বলে উল্লেখ করেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘গতকাল রাতে (বৃহস্পতিবার) ডাক্তাররা বলেছেন, তাঁর শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত সংকটময়। সে জন্য আমরা আমাদের দলের পক্ষ থেকে গণতন্ত্রের নেত্রী, গণতন্ত্রের মাতা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রোগমুক্তির জন্য সারা দেশের জনগণের কাছে, সারা দেশের মসজিদে মসজিদে দোয়া চেয়েছিলাম। সেই কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজকে (শুক্রবার) নয়াপল্টনের মসজিদে নামাজ আদায় করে আমরা সবাই দেশনেত্রীর সুস্থতার জন্য পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া চেয়েছি।’ মহাসচিব বলেন, ‘আমরা দোয়া চেয়েছি আল্লাহ তাআলার কাছে, তিনি যেন ম্যাডামকে পুরোপুরি সুস্থ করে দেন, সুস্থ অবস্থায় আবার জনগণের মাঝে ফিরিয়ে এনে দেশের মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ করে দেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আবারও দেশের মানুষের কাছে তাঁর রোগমুক্তির জন্য দোয়া করার আহ্বান জানাচ্ছি। সবাই ম্যাডামের জন্য দোয়া করবেন।’
এর আগে সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) দ্বিবার্ষিক-বার্ষিক সম্মেলনেও মির্জা ফখরুল দলের চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থা তুলে ধরে সাংবাদিকদের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে দোয়া চান।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘ম্যাডাম অসুস্থ হয়ে এভারকেয়ার হাসপাতালে আছেন। গতকাল (বৃহস্পতিবার) রাতে আমি প্রায় দুইটার সময়ে ফিরেছি হাসপাতাল থেকে। তখনও ডাক্তাররা চেষ্টা করছিলেন, কাজ করছিলেন।’
খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় রাজধানীসহ সারা দেশে মসজিদে জুমার নামাজের পর দোয়া হয়েছে বলে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টা দোয়া চেয়েছেন
বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বর্তমান শারীরিক অবস্থা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি তাঁর সুস্থতার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন।
গতকাল সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বার্তায় এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, প্রধান উপদেষ্টা নিয়মিতভাবে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজ রাখছেন এবং প্রয়োজনীয় সব চিকিৎসা সহায়তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রেস উইংয়ের বার্তায় আরও বলা হয়, প্রধান উপদেষ্টা তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দ্রুত সুস্থতা কামনা করে দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন। খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় যেন কোনো ঘাটতি না থাকে, প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা দিতে সরকার প্রস্তুত।
গণতান্ত্রিক উত্তরণের এ সময়ে খালেদা জিয়া জাতির জন্য বড় অনুপ্রেরণা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘তাঁর সুস্বাস্থ্য দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রয়োজনীয় সহায়তা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকারও নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রায় ৮০ বছর বয়সী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিসের পাশাপাশি কিডনি, লিভার, ফুসফুস ও চোখের সমস্যাসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন। ২৩ নভেম্বর রোববার রাতে তাঁকে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরীক্ষা–নিরীক্ষায় ফুসফুসে ‘সংক্রমণ’ ধরা পড়ায় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
পরদিন খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক এফ এম সিদ্দিকী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, কয়েক মাস ধরেই তিনি (খালেদা জিয়া) বারবার আক্রান্ত হচ্ছিলেন। কয়েকটি সমস্যা একসঙ্গে দেখা দিয়েছে। এ কারণে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
অধ্যাপক এফ এম সিদ্দিকী আরও বলেন, খালেদা জিয়ার বুকে সংক্রমণ হয়েছে। তাঁর হার্টের সমস্যা আগে থেকেই ছিল। হার্ট ও ফুসফুস দুইটিই একসঙ্গে আক্রান্ত হওয়ায় তাঁর শ্বাসপ্রশ্বাসে গুরুতর সমস্যা হচ্ছিল। সে জন্য খুব দ্রুত তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয় বলে চিকিৎসক জানিয়েছিলেন।
হাসপাতালের সামনে বিএনপির নেতা–কর্মীরা
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনে আসছেন বিএনপির নেতা–কর্মীরা।
গতকাল রাতে হাসপাতালের সামনে গিয়ে দেখা যায়, বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের কয়েকজন নেতা–কর্মী সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন। এ সময় গণমাধ্যমকর্মীরাও উপস্থিত ছিলেন।
খালেদা জিয়াকে দেখতে রাত ১১টা ৩৮ মিনিটে এভারকেয়ার হাসপাতালে আসেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি ১২টা ৬ মিনিটে হাসপাতাল থেকে বের হন। এ ছাড়া রাতে বিএনপির চেয়ারপারসনকে দেখতে আরও কয়েকজন শীর্ষ নেতা হাসপাতালে আসেন। তাঁদের মধ্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খানকে হাসপাতালে প্রবেশ করতে দেখা গেছে।
![]() |
| বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান রাত ১২টার পর এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার সময় অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার সর্বশেষ শরীরিক অবস্থান সম্পর্কে জানান | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
রাত ১২টা ৬ মিনিটের দিকে হাসপাতালের ফটকে আবদুল মঈন খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘মেডিকেল বোর্ড বসেছিল। বোর্ড তাঁর (খালেদা জিয়া) সর্বশেষ অবস্থা যাচাই করেছে এবং প্রয়োজনীয় যা যা করা দরকার, তারা ব্যবস্থা নিচ্ছে।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের স্বাস্থ্যের অবস্থার বিষয়ে চিকিৎসকের মতামত জানতে চাইলে আবদুল মঈন খান বলেন, ‘তাঁকে (খালেদা জিয়া) নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। তাঁর চিকিৎসায় যে যে বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন, তা বোর্ড পর্যবেক্ষণ করছে এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে।’
উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ৭ জানুয়ারি খালেদা জিয়া লন্ডনে যান। ১১৭ দিন সেখানে অবস্থানের পর গত ৬ মে তিনি দেশে ফেরেন। এরপর শারীরিক জটিলতা দেখা দিলে তাঁকে একাধিকবার হাসপাতালে যেতে হয়েছে।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন