প্রতিবন্ধীদের অধিকার থাকলেও তারা এখনও বঞ্চিত
| প্রতিবন্ধী | প্রতীকী ছবি |
মানিকগঞ্জ শহরের পশ্চিম দাশড়া এলাকায় একটি পুরোনো, বড় দোতলা বাড়ি আছে। সেই বাড়ির সিঁড়ির নিচে একটি ছোট ঘরে থাকেন চন্দন শিকদার, বয়স ৪৮। জন্ম থেকেই তিনি বাক্ ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী।
মা–বাবা মারা যাওয়ার পর চন্দনের ভাইরা পারিবারিক সম্পত্তি ভাগ করেছেন। কিন্তু চন্দনের ভাগে কিছুই পড়েনি। তিনি তার ভাইদের সংসারে অবহেলা ও তাচ্ছিল্যের মধ্যে দিন কাটান। চন্দন কেন সম্পত্তির ভাগ পাননি—এ প্রশ্ন করলে তার বড় ভাই বাদল শিকদার বলেন, ‘ও তো কিছু বোঝে না, সম্পত্তি দিয়ে কী করবে?’
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরও অন্য নাগরিকদের মতো সমান অধিকার রয়েছে। ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩’-এ বলা আছে, কোনো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে তার মৌলিক ও নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। কিন্তু এই আইনের সুরক্ষা চন্দনের জীবনে কার্যকর হয়নি।
শিক্ষা ও চাকরিতেও বৈষম্য
সরকারি ও বেসরকারি হিসাবের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও, বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা অনেক। এই সংখ্যক মানুষদের বেশির ভাগই পরিবার, স্কুল–কলেজ ও চাকরিতে বৈষম্যের মুখে পড়ছেন এবং নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
ঢাকার মিরপুরের দুই নম্বর সেকশনের বাসিন্দা শারমিন আক্তারের (৫০) জীবনও এর উদাহরণ। জন্ম থেকেই তার একটি পা বিকল। ৪০ বছর আগে, ১০ বছর বয়সে শারমিনকে স্কুলে ভর্তি করাতে চেয়েছিলেন তার মা–বাবা। কিন্তু স্কুলে তাকে ভর্তি করা হয়নি। যুক্তি ছিল, হুইলচেয়ারে থাকা মেয়েটিকে দেখে অন্য শিক্ষার্থীরা ‘অস্বস্তি’ বোধ করবে।
শারমিন বলেন, ‘আমি পড়াশোনা করে কিছু হতে চেয়েছিলাম। তখন স্কুলে ভর্তি হতে দেওয়া হয়নি। বাসায় থেকে যতটুকু পড়ার, পড়েছি। এখন সেলাইয়ের কাজ করে যা পাই, তা দিয়েই চলি।’
সেলাইয়ের কাজের মাধ্যমে চলা সম্ভব হলেও শারমিনের বিয়ে হয়নি, অর্থাৎ তিনি সংসার বা পরিবার গঠন করতে পারেননি। মা–বাবাও নেই। ভাইবোনেরা আলাদা পরিবার নিয়ে থাকায় শারমিনকে দূরসম্পর্কের এক ভাইয়ের বাসায় থাকতে হচ্ছে। কতদিন সেখানে থাকতে পারবেন, তা নিয়েও তিনি দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
২০১৩ সালে প্রণীত ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন’-এর ১৬ (ঙ) ধারায় বিয়ে ও পরিবার গঠনের অধিকার দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘মাতা-পিতা, বৈধ বা আইনগত অভিভাবক, সন্তান বা পরিবারের সঙ্গে সমাজে বসবাস, বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন ও পরিবার গঠনের অধিকার একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির থাকবে।’
আইন ও বিধিমালার ভিত্তিতে ২০১৮-২০২৫ মেয়াদের জন্য প্রতিবন্ধী জাতীয় কর্মপরিকল্পনা তৈরি হয়েছে। এতে সামাজিক অংশগ্রহণ ও পরিবার গঠনের ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্ব বিস্তারিত বলা আছে। কিন্তু বাস্তবায়ন কতটা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
চাকরি ও সরকারি কোটা অকার্যকর
২০১৩ সালের আইনে সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্দিষ্ট কোটা রাখার নির্দেশ আছে। তবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় বলছে, অনেক প্রতিষ্ঠানে সেই কোটা পূরণ হয় না।
চট্টগ্রামের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হুমায়ুন কবির (২৮) তিন বছর আগে অনার্স শেষ করেছেন। বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করেও এখনো চাকরি পাননি। তিনি বলেন, ‘সাক্ষাৎকার দিতে গেলে মনে হয় সবাই শুধু আমার চোখ নিয়ে কৌতূহলী। আমার যোগ্যতা নয়, অক্ষমতাই বড় হয়ে ওঠে।’
সরকারি সহায়তা সীমিত, বাস্তবায়নে দুর্বলতা
বর্তমানে প্রায় ৩৪ লাখ ৫০ হাজার প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন। মাসে ৯০০ টাকা করে এই ভাতা। কিন্তু এ অর্থে চিকিৎসা ও মৌলিক চাহিদা পূরণ করা কঠিন। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কেন্দ্র থাকলেও অনেক এলাকায় কার্যক্রম স্থবির। প্রশাসনিক জটিলতা ও বাজেটের অভাবে প্রকৃত সুবিধাভোগীরা সেবা পান না—এমন অভিযোগ আছে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘নীতিমালা ভালো, কিন্তু মাঠপর্যায় বাস্তবায়নের ব্যবস্থা দুর্বল। অনেক এলাকায় তালিকাভুক্ত প্রতিবন্ধীর সংখ্যা বাস্তবের সঙ্গে মেলে না। এটাও জটিলতার কারণ।’
মানসিকতা পরিবর্তন ও আইনের বাস্তবায়নই বড় চ্যালেঞ্জ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবন্ধীদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে এখনো গভীরভাবে আছে। ফলে অনেক প্রতিবন্ধী শিক্ষা ও চাকরিতে পিছিয়ে যাচ্ছেন এবং আত্মনির্ভরশীল হতে পারছেন না।
মানবাধিকারকর্মী সাইদ আহমদ বলেন, ‘সমাজে প্রতিবন্ধীদের প্রতি করুণা দেখানো হয়, কিন্তু মর্যাদা দেওয়া হয় না। পরিবার মনে করে যত্ন নিলেই দায়িত্ব শেষ। অথচ স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় না। পরিবার ভেতরের এই মানসিক বাধাই সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। আইন থাকা সত্ত্বেও অধিকার পাওয়া কঠিন।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিবন্ধী মানেই অক্ষম—এ ধারণা ভুল। অনেকেই শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি ও ক্রীড়াতেও সফল। প্রয়োজন শুধু সুযোগ ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা।’
আইনজীবী ও প্রতিবন্ধী অন্তর্ভুক্তি বিশেষজ্ঞ রেজাউল করিম সিদ্দিকী বলেন, ‘সম্পত্তি লাভ বা বিয়ে-পরিবার গঠনের বিষয়গুলো প্রতিবন্ধীর জন্য জটিল। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন এখনও সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।’
তিনি আরও বলেন, ‘আইন কাগজে থাকলেই হবে না। সঠিক বাস্তবায়ন করতে হবে। অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রীয় ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে প্রতিবন্ধীদের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে।’
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন