এক বছরে দ্বিগুণ বেড়েছে খেলাপি ঋণ
দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে এখন ব্যাপক আকার নিয়েছে। মোট বিতরণ করা ঋণের ৩৬ শতাংশ এখন খেলাপি। গত এক বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। তখন মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ ছিল খেলাপি। সেই হিসাবে এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা বা দ্বিগুণের বেশি। এত উচ্চ হারে খেলাপি ঋণ অর্থনীতি ও ব্যবসার জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বুধবার সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩ হাজার ৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির হার ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলো প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি রেখেছে মাত্র ১ লাখ ৩০ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। ফলে প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৪ হাজার ২৩১ কোটি টাকা। এ ঘাটতি আমানতকারী ও ব্যাংকিং খাতের জন্য বড় ঝুঁকির ইঙ্গিত দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকগুলো লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণের প্রকৃত অবস্থা এখন সামনে আনতে হচ্ছে। ঋণ আদায় না করা সত্ত্বেও নিয়মিত হিসেবে দেখানোর সুযোগ আর দিচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিছু ব্যাংকের ঋণ তথ্য বিদেশি অডিট ফার্ম দিয়ে যাচাই করা হয়েছে। এতে বিশেষত একীভূতকরণের আওতায় থাকা পাঁচ ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ অনেক বেড়েছে। এছাড়া, গত এপ্রিল থেকে ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার তিন মাস পরই খেলাপি দেখানো হচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক নিয়ম। ২০১৯ সালের আগে এই সময়সীমা ছিল ছয় মাস। অনেক সময় বিশেষ সুবিধা দিয়ে এক বছর পর্যন্ত সুযোগ দেওয়া হতো।
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এই বেড়েছে—এটা খুব অস্বাভাবিক নয়। কারণ, সরকারি ব্যাংক, একীভূত হওয়া পাঁচ ব্যাংকসহ আরও কিছু সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকের বাস্তব চিত্র এখন সামনে এসেছে। ব্যবসায়িক পরিস্থিতি খারাপ হয়ে নতুন করে খেলাপির প্রবণতা তৈরি হয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়। যদিও অর্থনীতি দুর্বল, কিন্তু প্রবৃদ্ধি আছে। রপ্তানিও কিছুটা বেড়েছে। রেমিট্যান্স আসে বেশি। তাই শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারণে ঋণ না শোধ হওয়ার ব্যাখ্যা পুরোপুরি মিলছে না। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা থাকতে পারে। তবে নতুন সরকার আসার পরে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার জন্য কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ শোধ না করছে কি না, তা দেখা জরুরি।
খেলাপি ঋণ কমানোর উপায় জানতে চাইলে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, শুধু নীতি সহায়তা দিয়ে খেলাপি ঋণ কমানোর চেষ্টা আগেও ফল দেয়নি। উদ্বেগের বিষয় হলো—বাংলাদেশ ব্যাংক আবার পুনঃতপশিল ও অবলোপনে ছাড় দিয়ে আগের পথে হাঁটছে। এটা যেন মাদকাসক্তকে আবার মাদক দেওয়ার মতো। এতে ঋণ আদায় সফল হওয়ার সুযোগ কম। বরং ঋণ আদায় ব্যবস্থার দুর্বলতা কমাতে হবে। বিশেষ করে অর্থঋণ আদালতের মাধ্যমে আদায়ে যে বাধা আছে, তা দ্রুত ঠিক করা দরকার। খেলাপিদের নাম প্রকাশ করে সামাজিক চাপ তৈরি করাও একটি কার্যকর পদ্ধতি হতে পারে। পাঁচটি ব্যাংকের ক্ষেত্রে যেমন কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তেমনি অন্যদের ক্ষেত্রেও আদায় সম্ভব না হলে ব্যাংক নিষ্পত্তি আইনের আওতায় যেতে হবে।
খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণ জানতে চাইলে সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) আবিদুর রহমান বলেন, গত এপ্রিল থেকে কঠোর শ্রেণীকরণ নীতি কার্যকর ও তা অনুসরণের কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। শুধু দুর্বল নয়, আগে ভালো ব্যাংক বলেও পরিচিত কিছু ব্যাংকেও এই হার বাড়ছে। কয়েকটি ব্যাংকে বেক্সিমকো, এস আলম ও নাসা গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানের বড় খেলাপি ঋণ রয়েছে।
তিনি আরও জানান, খেলাপি ঋণের আকার বাড়লেও সব ব্যাংকে তা বাড়েনি। যেমন—গত ডিসেম্বরে সাউথইস্ট ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ছিল ১৪ দশমিক ৮১ শতাংশ, উদ্যোগ বাড়ানোয় তা এখন ১২ শতাংশের নিচে। নতুন করে খেলাপি ঋণ বাড়ছে কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা কম। কারণ ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। শুরুর দিকে আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে ব্যাংক পরিচালনা করা হলেও, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে বিশেষ সুবিধায় পুনঃতপশিল চালু হয়। এরপর নানা ছাড়ে খেলাপি ঋণ কম দেখানো হতো—অনেক ক্ষেত্রে ঋণ না শোধ করেও নিয়মিত রাখা, খুব অল্প ডাউনপেমেন্টে দীর্ঘমেয়াদি পুনঃতপশিল, এমনকি ভুয়া ঋণ নিয়ে দায় সারার সুযোগ ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিবছর খারাপ ঋণের হিসাব প্রকাশ করে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ২০২৪ সাল পর্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ বেড়ে হয়েছে ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা—যা মোট ঋণের ৪৪ দশমিক ২৬ শতাংশ। ২০২৩ সালের শেষে পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৯৭ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে খারাপ ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৫৫০ কোটি বা ৫২ শতাংশ।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকিন আহমেদ মনে করেন, শুধু লুকিয়ে রাখার কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে—এমন নয়। আগে ৯ মাস ঋণ পরিশোধ না করলে খেলাপি ধরা হতো, এখন দুই ধাপে তা ৩ মাসে নামানো হয়েছে। এতে অনেক ব্যবসায়ী খেলাপি হয়ে পড়ছেন।
তিনি বলেন, গত পাঁচ বছরে ব্যবসায়ীরা স্বস্তিতে ব্যবসা করতে পারেননি। করোনার ধাক্কায় ব্যবসা থমকে যায়। এরপর রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ সংকট বাড়ায়। আগের সরকার বারবার তেল-গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে। ডলার সংকট, ডলার দর সমন্বয়, জ্বালানি সংকটে ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছে। সুদের হার ছাড়িয়েছে ১৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে ব্যবসায়ীরা চাপে ছিলেন।
তাসকিন আহমেদ বলেন, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত ছিল সমস্যার গভীরে নজর দেওয়া। খেলাপি ঋণের অঙ্ক বাড়িয়ে লাভ নেই। ৯ মাসের বদলে ৩ মাসে শ্রেণীকরণকে ধাপে ধাপে আনা যেত। আগে জানানো হলে ব্যবসায়ীরা প্রস্তুতি নিতে পারতেন। পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে আসা সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে এমন কঠিন সিদ্ধান্ত তিনি আশা করেননি।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন