মমতাজের স্বাবলম্বী গল্প
![]() |
| বাড়ির উঠোনে চৌবাচ্চায় কাজ করছেন মমতাজ আক্তার। চালুনি দিয়ে জৈব সার বের করছিলেন। সম্প্রতি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কালীতলা দুর্গাপুর গ্রামে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
বিয়ের পর মমতাজ আক্তার জানতে পারেন, তাঁর স্বামী বেকার। শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে দেখেন, থাকার ঘরও নেই—বৃষ্টির দিনে ঘরের চাল দিয়ে পানি পড়ে, বেড়ায় টাঙানো পলিথিন। এমন দুর্দিনে একসময় তাঁদের সংসার থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়। শুরু হয় অভাব-অনটনের জীবন।
সেই মমতাজ এখন সফল উদ্যোক্তা। ভার্মি কম্পোস্ট বা জৈব সার তৈরি করে বদলে ফেলেছেন নিজের ভাগ্য। জরাজীর্ণ ঘর থেকে এখন তিনি আধাপাকা বাড়ি, ৫ শতাংশ জমির বসতভিটা ও তিন বিঘা আবাদি জমির মালিক। আছে গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগিসহ একটি সমন্বিত কৃষি খামার—নাম দিয়েছেন ‘মেসার্স আলিফ সমন্বিত কৃষি খামার’। এসব সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে রংপুর বিভাগে ‘সফল আত্মকর্ম’ ক্যাটাগরিতে সম্প্রতি জাতীয় যুব পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
মমতাজ আক্তারের (৩৩) বাড়ি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার দরবস্ত ইউনিয়নের কালীতলা দুর্গাপুর গ্রামে। গতকাল সোমবার বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, মমতাজের কর্মযজ্ঞ। বাড়ির উঠানে চৌবাচ্চায় ভর্তি জৈব সার। মমতাজ এক চৌবাচ্চা থেকে চালুনি দিয়ে সার বের করছেন। এর ফাঁকে গৃহপালিত পশু-পাখিকে খাবারও দিচ্ছেন। এসব কাজে তাঁকে সহায়তা করছিলেন আরেক নারী।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালে কালীতলা দুর্গাপুর গ্রামের বেলাল হোসেনের সঙ্গে একই উপজেলার বড় জামালপুর গ্রামের মশিউর রহমানের মেয়ে মমতাজ আক্তারের বিয়ে হয়। বিয়ের সময় স্বামী বেকার থাকলেও মমতাজের উদ্যোগে বেলাল এখন ভাঙারি ব্যবসা করছেন। তাঁদের এক ছেলে আছে। সংসার সামলিয়ে মমতাজ এইচএসসি পাস করেছেন। সম্প্রতি তিনি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন।
![]() |
| রংপুর বিভাগে ‘সফল আত্মকর্ম’ ক্যাটাগরিতে সম্প্রতি জাতীয় যুব পুরস্কারে ভূষিত হন মমতাজ আক্তার | ছবি: সংগৃহীত |
মমতাজ আক্তারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ৫ শতাংশ জমি ছাড়া তাঁর স্বামীর কোনো সম্পদ ছিল না। অনাহারে–অর্ধাহারে কাটত তাঁদের দিন। একসময় বাবার বাড়ি থেকে একটি গাভি এনে সংসারের হাল ধরেন মমতাজ। পরে গরুর সংখ্যা বাড়ে, দুধ বিক্রি করে ধীরে ধীরে সংসারের খরচ চালাতে শুরু করেন।
এর মধ্যে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের একটি প্রশিক্ষণে অংশ নেন মমতাজ। সেখানে কেঁচো ও গোবর দিয়ে জৈব সার তৈরির পদ্ধতি শেখেন। বাড়িতে ফিরে ২০১৮ সালের শুরুর দিকে স্বামী বেলাল হোসেনকে নিয়ে শুরু করেন ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরির কাজ। বগুড়া থেকে ৩০০ টাকায় ২০০ গ্রাম কেঁচো কেনেন তাঁরা। এসব কেঁচো একটি ছোট চৌবাচ্চায় ৩০ কেজি গোবরের মধ্যে ছেড়ে দেন। ২৫ দিন পর ২৫ কেজি জৈব সার তৈরি হয়। এতে খরচ পড়ে ৩৬০ টাকা, আর বিক্রি হয় ৭২০ টাকায়। প্রথম উদ্যোগেই দ্বিগুণ লাভ হয়। এরপর বড় পরিসরে জৈব সার তৈরির উদ্যোগ নেন মমতাজ।
পরের বছর বাড়ির উঠোনে ৯টি বড় চৌবাচ্চা তৈরি করেন মমতাজ। আট কেজি কেঁচো ও সাত টন গোবর দিয়ে ৪০ দিনে তৈরি হয় ছয় টন সার। খরচ হয় ৩০ হাজার টাকা, বিক্রি হয় ৬০ হাজার টাকায়। এখন এই খাত থেকে প্রতি মাসে তাঁর আয় প্রায় ৩০ হাজার টাকা।
মমতাজ আক্তার জৈব সার উৎপাদনের আয় দিয়ে বর্তমানে ৫টি গরু, ২২টি ছাগল, ৫০টি হাঁস ও ৪৩টি মুরগি পালন করছেন। গরুর দুধ বিক্রি করার পাশাপাশি ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন করে তাঁর মাসে প্রায় ২১ হাজার টাকা আয় হয়।
তাছাড়া তিন বিঘা জমিতে তিনি ঔষধি, ফলদ ও বনজ গাছের চারা উৎপাদন করছেন। এখন তাঁর নার্সারিতে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ২০ হাজার গাছের চারা আছে। নার্সারি থেকে তাঁর মাসিক গড় আয় ২০ হাজার টাকা।
এই সব খাত মিলিয়ে মমতাজের মাসিক গড় আয় ৭০ হাজার টাকা।
মমতাজের স্বামী বেলাল হোসেন বলেন, 'কৃষিকাজে মমতাজের আগ্রহ প্রচণ্ড। আমি সব সময় তাকে উৎসাহ দিই। পাশাপাশি কাঁচামাল সংগ্রহ ও উৎপাদিত মালামাল বিক্রিতে সাহায্য করি। তাকে নিয়ে আমি গর্ববোধ করি।'
![]() |
| গৃহপালিত গরুকে খাওয়াচ্ছেন মমতাজ আক্তার | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
মমতাজের খামারে কালীতলা দুর্গাপুর গ্রামের আটজন নারী কাজ করছেন। তাঁদের একজন আতিকা বেগম বলেন, স্বামীর আয়ে সংসার চলত না। এখন এই খামারে কাজ করে তিনি মাসে ১৫ হাজার টাকা আয় করেন। একই গ্রামের আমিনুল ইসলাম জানান, আগে দিনমজুর হিসেবে অনিশ্চিত জীবন কাটলেও এখন মমতাজের খামারে কাজ করে সংসারে সচ্ছলতা এসেছে।
মমতাজের কৃষি উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন দরবস্ত ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৩ নম্বর ওয়ার্ডের (কালীতলা দুর্গাপুর) সদস্য আল মামুন সরকার। তিনি বলেন, মমতাজ পরিশ্রম করে নিজে স্বাবলম্বী হয়েছেন, এলাকার অনেককে স্বাবলম্বী করেছেন। তিনি এলাকায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন।
মাটির স্বাস্থ্য ও গুণ রক্ষা করার জন্য জৈব সার অপরিহার্য বলে জানিয়েছেন গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মেহেদী হাসান। তিনি বলেন, রাসায়নিক সার কম বা বেশি দিলে মাটির স্বাস্থ্য ও গুণ খারাপ হয়। জৈব সার ব্যবহার করলে এই সমস্যা হয় না। এতে মাটির পানি ধরে রাখার ক্ষমতা বাড়ে, তাপমাত্রার ভারসাম্য রক্ষা হয় এবং মাটির কাজকর্ম ঠিক থাকে। এ ক্ষেত্রে মমতাজ আক্তারের ভূমিকা অনন্য। তাঁকে পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
মমতাজ আক্তার নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি ১০ জন দরিদ্র নারীকে নার্সারি তৈরি করে দিয়েছেন। এ পর্যন্ত তিনি ৪০ হাজার গাছের চারা বিতরণ করেছেন। কালীতলা দুর্গাপুর গ্রামে তিনি ‘মমতাজ পল্লী উন্নয়ন যুব ক্লাব’ গড়ে তুলেছেন। এই ক্লাবে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন ও নার্সারি বিষয়ে ২৫০ জন বেকার যুবক-যুবতীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে মমতাজ বলেন, তিনি ভবিষ্যতে বড় আকারে সমন্বিত কৃষি খামার গড়ে তুলবেন। এ জন্য দিনরাত কাজ করছেন। তাঁর ভাষ্য, 'ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রম করলে বেকারত্ব কোনো অভিশাপ নয়, যে কেউ সাফল্য অর্জন করতে পারে। আমি নিজেই তার প্রমাণ।'



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন