[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

পুকুরে ডুবছে নওগাঁর উর্বর জমি

প্রকাশঃ
অ+ অ-

নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কৃষিজমিতে কাটা হচ্ছে পুকুর। সম্প্রতি নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার দ্বীপগঞ্জ গ্রামে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

নওগাঁর রানীনগর উপজেলার ধনপাড়া গ্রামের কৃষক ইয়াছিন আলীর আবাদযোগ্য জমি মাত্র দুই বিঘা। ঠিক যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'দুই বিঘা জমি' কবিতার উপেনের কাহিনী। সেকালের উপেনের মতোই ইয়াছিন আলীও তার জমি হারানোর দ্বারপ্রান্তে।

তিনি জানান, ‘শুরুতে আমি কোনোভাবেই পুকুরের জন্য জমি দিতে রাজি ছিলাম না। কিন্তু আমার চারপাশে পুকুর হওয়ায় বাধ্য হয়ে জমি দিতে হয়েছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আট বছর আগে ইয়াছিনের জমির পাশে আত্রাই উপজেলার খয়বর রহমান প্রথম পুকুর খনন করেন। পরে আরও দুটি পুকুর খনন করেন। পুকুরগুলোর উঁচু পাড়ের কারণে ইয়াছিন আলীর তিন ফসলি জমিতে পানি আটকে থাকত, ধান ও আমন খারাপ হতো। শেষ পর্যন্ত তিনি ৩৩ শতক জমি বছরে ২০ হাজার টাকায় খয়বরকে ইজারা দিতে বাধ্য হন।

এখন ইয়াছিন আলীকে চাল, সবজি, গোখাদ্য খড়—সবই কিনতে হয়। তিনি বলেন, ‘খালি মাছ খ্যায়ে কি আমাদের পেট ভরবে?’ সংসার চালাতে দিনমজুরি করছেন।

কৃষি দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ধান-চালের জেলা নওগাঁয় ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪ শতাংশ তিন ফসলি জমি পুকুরের জন্য হারিয়েছে। পাশের জমিগুলোও জলাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে বিল ও পুকুর খননের কারণে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, জলাবদ্ধতা স্থায়ী হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে পরিবেশ ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায়।

গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জেলার ১০টি এলাকা ঘুরে বিষয়টি অনুসন্ধান করেছেন প্রতিবেদক। কৃষক, মাছচাষি, বিশেষজ্ঞ এবং প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ অন্তত ৬০ জনের সঙ্গে কথা বলা হয়। সবাই বলছেন, যত্রতত্র পুকুর খনন হওয়ায় কৃষকরা ফসলি জমি হারাচ্ছেন, কৃষিমজুরেরা কাজ হারাচ্ছেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক এ বি এম মহসিন বলেন, ‘কোন এলাকায় কতগুলো পুকুর দরকার এবং এগুলোর পরিবেশের ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে, তা বিবেচনা করে পুকুর খননের অনুমোদন দেওয়া উচিত।’ 

রানীনগর উপজেলায় কালিকাপুর বেড়িবাঁধের দুই ধারে বিল মনসুর, কালিকাপুর বিল ও ধনপাড়া তিন ফসলি মাঠে ২৬ আগস্ট গিয়ে দেখা যায়, অসংখ্য পুকুর জালের মতো বিছানো। কোথাও একটি পুকুরের পাড়ের সঙ্গে আরও কয়েকটি পুকুর লাগানো।

আতাইকুলা থেকে বেড়িবাঁধের ৩ নম্বর স্লুইসগেট পর্যন্ত বিল মনসুরের পূর্ব অংশে রাস্তার দুই পাশে এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে স্থানীয়রা গুনে ৬৮টি পুকুর পেয়েছেন। বিলজুড়ে ৮০টিরও বেশি পুকুর রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, এগুলো গত ১০ বছরে খোঁড়া হয়েছে। এ অঞ্চলে ১৫০ বিঘা পর্যন্ত আয়তনের পুকুরও রয়েছে।

নওগাঁয়ে ২০১৪ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ফসলি জমিতে সবচেয়ে বেশি পুকুর খনন হয়েছে রানীনগর ও আত্রাই উপজেলায়। কৃষকরা অভিযোগ করেছেন, স্থানীয় প্রভাবশালীরা আওয়ামী লীগের দুজন সাবেক সংসদ সদস্যের সমর্থনে এই কাজ করেছেন।

আত্রাই উপজেলার শুটকিগাছা গ্রামের মাছচাষি খয়বর রহমান বলেন, ‘পুকুর খননে প্রশাসন বাধা দিলে সাবেক সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলমের কাছে গেলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত।’ পরবর্তী সংসদ সদস্য আনোয়ার হোসেনও পুকুর খোঁড়ার পক্ষে ছিলেন। ‘তাঁদের সময় প্রশাসন কোনো সমস্যা করত না,’ তিনি যোগ করেন।

সদর উপজেলার বক্তারপুর ইউনিয়নের চকতারতা, মোক্তারপাড়া, শ্যামপুর, আলাদাদপুরসহ অন্তত ১৫টি গ্রামে ফসলি মাঠের পানি নলগাড়া বিল দিয়ে চলে। বিলের ২০ একর খাসজমি দখল করে মাটি ব্যবসায়ী মনির হোসেন ছোট-বড় ১০টি পুকুর খনন করেছেন। স্থানীয় কৃষকরা জানান, বিলের মাঝ বরাবর পুকুর কাটার কারণে এবার অন্তত ৫০০ বিঘা জমিতে আমন ধান আবাদ করা যায়নি। অন্য বিল ও ফসলি মাঠেও জলাবদ্ধতার সমস্যা দেখা দিয়েছে।

বক্তারপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সারওয়ার কামাল বলেন, ‘একজন ব্যক্তির বাণিজ্যিক মাছ চাষের জন্য শত শত কৃষক ফসলের আবাদ করতে পারছেন না এবং বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন।’

বিলের তিন ফসলি জমি নষ্ট করে একের পর এক পুকুর খনন করে চলছে মাছ চাষ। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা পুকুরের এই চিত্র সম্প্রতি নওগাঁর রানীনগর উপজেলার মনসুর বিলের | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

মনির হোসেন জানান, এসব জমিতে সারা বছর পানি জমে থাকায় ফসল হতো না। তিনি জমির মালিকদের কাছ থেকে ২০ বছরের জন্য ইজারা নিয়ে পুকুর খনন করেছেন।

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইবনুল আবেদীন বলেন, ‘ওই বিলে নতুন কোনো পুকুর খনন হবে না, সে ব্যাপারে প্রশাসন শক্ত পদক্ষেপ নেবে।’

সমাজতান্ত্রিক ক্ষেতমজুর সমিতি নওগাঁ জেলা শাখার সদস্য জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘আমরা স্থানীয় প্রশাসন ও পুকুরে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটি সমঝোতার খবর শুনেছি।’

কৃষি অফিসের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালে জেলায় মোট তিন ফসলি জমি ছিল ২ লাখ ৭৪ হাজার ৬৮২ হেক্টর। ১০ বছরে সেখান থেকে কমেছে ১০ হাজার ৪৮২ হেক্টর। এর অর্ধেকের কম অংশ পুকুর হয়ে গেছে, যা জেলার মোট তিন ফসলি জমির প্রায় ৪ শতাংশ। বাকি জমির কিছু অংশে বাসাবাড়ি ও কলকারখানা হয়েছে।

জেলা মৎস্য অফিস জানিয়েছে, জেলায় বিল, প্লাবন ভূমি, নদী ও পুকুরসহ মোট প্রায় ৪৮ হাজার জলাশয় আছে। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৪৭ হাজারটি পুকুর। ১০ বছরে জেলায় পুকুরের সংখ্যা বেড়েছে ৩ হাজার ৩৩৬টি, যার আয়তন ২ হাজার ১৪৬ হেক্টর।

কিন্তু মৎস্যচাষি ও কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, মৎস্য অফিসের হিসাব ঠিক নয়। বাস্তবে পুকুরের সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি, কারণ পুকুরের সঠিক কোনো জরিপ হয়নি।

জেলায় মাছের উৎপাদন ১০ বছরে প্রায় সাড়ে ৩২ হাজার মেট্রিক টন বেড়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফেরদৌস আলী। তিনি বলেন, ‘মাছের চাহিদা পূরণের জন্য নতুন পুকুর খোঁড়া প্রয়োজন হতে পারে। তবে এর মানে এই নয় যে আমাদের তিন ফসলি বা দুই ফসলি জমিকে পুকুরে রূপান্তর করতে হবে। আমরা এ ধরনের কাজ নিরুৎসাহিত করি।’

ফসলি জমির নিচু অংশে পুকুর খোঁড়লে বর্ষার সময় পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয় এবং পানি দীর্ঘ সময় জমে থাকে। এখন কৃষকরা পুকুর ইজারার জন্য বছরে প্রতি বিঘায় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পান।

রানীনগরের মনসুর বিলের কৃষক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘তিন ফসলি জমি যদি এক ফসলি বা অনাবাদি হয়ে যায়, তাহলে পুকুর খননকারীদের কাছে ইজারা দেওয়ার চেয়ে অন্য উপায় থাকে না।’ 

কৃষি জমিতে পুকুর খনন করে মাছ চাষ করা হচ্ছে। সম্প্রতি নওগাঁর রাণীননগর উপজেলার ধনপাড়া মাঠে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, আবাদি জমি কমে যাওয়ায় কৃষিশ্রমিকেরা কাজ হারাচ্ছেন। বিশেষ করে কৃষির ওপর নির্ভরশীল ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন।

পত্নীতলার চকগোপাল গ্রামের অরুণ কুমার, কার্তিক, সুবল, রাজীবসহ ১২ জন কৃষিশ্রমিক বলেন, তাঁদের পাড়ার বেশির ভাগ মানুষের নিজের জমি নেই। অন্যের জমিতে কাজ করে জীবিকা চলে। এখন কাজও কমে গেছে, মজুরিও আগের চেয়ে অনেক কম। ষাটোর্ধ্ব বাবু টুডু বলেন, ‘কী আর করব দাদা, কাজ নেই। তাই বাড়ির উঠোনে বসে সময় কাটাই। অনেকে কাজের খোঁজে শহরে গিয়ে রিকশা চালাচ্ছে।’

সরকারি সংস্থা বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) জরিপে দেখা গেছে, বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বিপজ্জনকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। এর কারণ দীর্ঘদিনের খরা ও অতিরিক্ত পানি উত্তোলন। এ কারণে সরকার রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর ২৫টি উপজেলার ৪৭টি ইউনিয়নকে ‘অতি পানিসংকটাপন্ন’ এলাকা ঘোষণা করেছে।

বিএমডিএ নওগাঁ-১ অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘প্রায় ৭০ ভাগ ভূগর্ভস্থ পানি সেচের কাজে ব্যবহার হয়। এখন এই পানি তুলে পুকুরও ভরা হচ্ছে।’

চলতি বছর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) এক গবেষণায় রাজশাহী, নাটোর ও নওগাঁর ছয়টি উপজেলায় ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব এলাকায় লবণাক্ততা দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। পানিবিজ্ঞানী আনোয়ার জাহিদের নেতৃত্বে গবেষক দলটি ২০২৪ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে এই পরীক্ষা চালায়। গবেষণায় দেখা যায়, যেসব পুকুরে দীর্ঘদিন ধরে মাছ চাষ হয়, সেগুলোর আশপাশের ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ততা বেশি।

মাছচাষি খয়বর রহমান বলেন, ‘পুকুরের মাছের গায়ে ঘা দেখা দেয়। মৎস্য কর্মকর্তাদের পরামর্শে আমরা প্রতি বিঘা জলে মাসে ৫ কেজি করে লবণ দিই।’

নওগাঁর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সোহেল রানা বলেন, ফসলি জমিতে পুকুর খনন ঠেকাতে নির্দিষ্ট কোনো আইন বা নীতিমালা নেই। তবে ‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন ২০২৩’ অনুযায়ী অন্যের জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি বা জলাশয়ের পানিপ্রবাহে বাধা দেওয়া অপরাধ। অভিযোগ পেলে তাঁরা অভিযান চালান, কিন্তু পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় নিয়মিত নজরদারি সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, ‘অনেক সময় রাতারাতিই পুকুর খনন হয়ে যায়।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির মনে করেন, বিদ্যমান আইনেই প্রশাসন চাইলে ফসলি জমিতে পুকুর খোঁড়া বন্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) রাজশাহী অঞ্চলের সমন্বয়কারী তন্ময় সান্যাল বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী জমির শ্রেণি পরিবর্তন করতে হলে সরকারের অনুমোদন নিতে হয়। এ ছাড়া প্রস্তাবিত ‘কৃষিজমি সুরক্ষা আইন ২০১৬’-এ তিন ফসলি জমি রূপান্তরে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আইনটি দ্রুত পাস করা জরুরি।’ 

একটি মন্তব্য করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন