বিশ্ববাজারে দাম কমছে, দেশে উল্টো বাড়ছে নিত্যপণ্য
![]() |
বাংলাদেশের বাজারে চাল, ডাল, তেল থেকে শুরু করে মাছ-মাংস ও সবজির দাম উল্টো ঊর্ধ্বমুখী | ফাইল ছবি |
বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দামে কিছুটা স্বস্তি দেখা গেলেও তার প্রভাব এখনো বাংলাদেশের বাজারে পড়েনি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) জানিয়েছে, সেপ্টেম্বরে বৈশ্বিক খাদ্য মূল্যসূচক সামান্য কমে দাঁড়িয়েছে ১২৮ দশমিক ৮ পয়েন্টে, যা আগের মাসে ছিল ১২৯ দশমিক ৭ পয়েন্ট। বিশ্ববাজারে চিনি, দুগ্ধজাত পণ্য, গম ও চালের দাম কমেছে। কিন্তু দেশে উল্টো চাল, ডাল, তেল, মাছ, মাংস ও সবজির দাম বেড়েই চলেছে। এতে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের কষ্ট আরও বেড়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও দেশের বাজারে এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, দেশে উৎপাদন ব্যয়, জ্বালানি খরচ ও পরিবহন খরচ এখনো অনেক বেশি। তাই বাজার স্থিতিশীল রাখতে এসব খরচের কাঠামো নতুনভাবে ভাবতে হবে।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বাইরের বাজারে দাম কমলেও দেশের বাজারে তা টের পাওয়া যায় না। কারণ, আমদানি করা পণ্য বাজারে আসার পর মধ্যসত্ত্বভোগীরা নিয়ন্ত্রণ নেয়। তাই শুধু আন্তর্জাতিক বাজার দেখলেই হবে না, অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনায়ও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমায় দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা কমার সম্ভাবনা আছে। তবে এই সুফল ভোক্তারা পেতে হলে সরকারের নজরদারি বাড়াতে হবে, বাজার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনতে হবে।’
মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, নীতিনির্ধারকরা যদি এসব নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে অচিরেই ভোক্তারা বাজারে কিছুটা স্বস্তি অনুভব করবেন।
অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশে শিল্প ও পরিবহন খাতে উৎপাদন ব্যয় বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ গ্যাস, বিদ্যুৎ ও ডিজেলের দাম। এসব খাতে ব্যয় কমাতে পারলে বাজারে পণ্যের সরবরাহ ও দাম নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রতিযোগিতা, তদারকি ও নীতিগত স্বচ্ছতা না থাকলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও দেশের ভোক্তারা কোনো স্বস্তি পাবেন না।
বিশ্ববাজারে সরবরাহ বেড়ে খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশে এর উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মৌসুমি প্রভাব, আমদানিনির্ভরতা, সীমান্ত বাণিজ্যে বাধা এবং বাজারে অস্বচ্ছ প্রতিযোগিতা—এসব কারণেই দেশে দাম কমছে না।
তাঁদের মতে, বৈশ্বিক প্রবণতার সঙ্গে মিল রাখতে হলে সরকারের কার্যকর বাজার তদারকি, পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা ও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ জরুরি। তা না হলে বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশের ভোক্তারা তার সুফল থেকে বঞ্চিত হবেন।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) জানিয়েছে, সেপ্টেম্বরে বিশ্ববাজারে চিনির দাম ৪ দশমিক ১ শতাংশ কমেছে, যা ২০২১ সালের পর সবচেয়ে কম। ব্রাজিলে উৎপাদন বেড়ে যাওয়া এবং ভারত ও থাইল্যান্ডে ভালো ফলনের সম্ভাবনা দাম কমার কারণ। একই সময়ে দুগ্ধজাত পণ্যের দামও ২ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে, মূলত মাখনের দাম পড়ায়।
এছাড়া গম, ভুট্টা ও চালের দামও কমেছে সরবরাহ বাড়া ও চাহিদা কমার কারণে। তবে গরু ও ভেড়ার মাংসের দাম বেড়েছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে চাহিদা বেশি থাকায়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২৫ সালে বৈশ্বিক শস্য উৎপাদন ২ দশমিক ৯৭১ বিলিয়ন মেট্রিক টনে পৌঁছাতে পারে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি—এটি ২০১৩ সালের পর সবচেয়ে বড় প্রবৃদ্ধি হবে।
আগস্টে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশে, যা তিন বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে কম। তবে খাদ্যপণ্যের দাম তখনও বাড়ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আশা করেছিলেন, সেপ্টেম্বরে তা ৭ শতাংশের নিচে নামবে। কিন্তু বাস্তবে বাজারে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র—উৎসব আর মৌসুমি অজুহাতে নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বেড়েছে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর তথ্য বলছে, গত বছরের তুলনায় এবার চাল, ডাল, আটা-ময়দা, তেল, মাছ ও মাংসের দাম বেড়েছে। কিছুটা স্বস্তি মিলেছে শুধু পেঁয়াজ, রসুন ও ডিমে।
বাজারে এখন চিকন চাল কেজিতে ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৬৪ থেকে ৮০ টাকা। ছোট দানার মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়, গত বছর ছিল ১২৫ থেকে ১৩৫ টাকা। খোলা সয়াবিন তেল লিটারপ্রতি ১৭০ থেকে ১৭৮ টাকা, বোতলজাত তেল ১৮৮ থেকে ১৯০ টাকা, আর ৫ লিটার বোতলের দাম ৯০০ টাকার বেশি।
মৌসুমে ইলিশও সাধারণের নাগালের বাইরে। ছোট ইলিশ কেজিতে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা, আর বড় ইলিশ ১,০০০ থেকে ২,৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রুই-কাতলা বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায়। খাসির মাংস কেজিতে ১,০০০ থেকে ১,২০০ টাকা, গরুর মাংস ৭৫০ টাকা।
রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, শাকসবজি ও মসলার দাম ক্রমেই বাড়ছে। কাঁচা মরিচ কেজিতে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগেও ছিল ১৮০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে। গোল বেগুন কেজিতে ২২০ টাকা, গাজর ১২০, টমেটো ১৪০, বরবটি ১০০ টাকা। শিম এক সপ্তাহে ১৫০ টাকা থেকে বেড়ে ২৪০ টাকায় উঠেছিল, পরে কিছুটা কমে ১৬০ টাকায় নেমেছে।
বিক্রেতাদের দাবি, পূজার কারণে সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে পণ্য আসা বন্ধ রয়েছে। তার সঙ্গে টানা বৃষ্টিতে ফসলের ক্ষতি হওয়ায় বাজারে সরবরাহ কমে গেছে। তবে সাধারণ ক্রেতাদের অভিযোগ, বাজারে কোনো কার্যকর তদারকি নেই, ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছে।
এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘বিশ্ববাজারে অনেক খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও তার প্রভাব দেশের বাজারে দেখা যাচ্ছে না। এর প্রধান কারণ সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণে উদাসীনতা।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্ববাজারে দাম কমলেও ব্যবসায়ীরা দেশে তা সমন্বয় করছেন না। বরং তারা দাম বাড়ানোর দিকেই বেশি মনোযোগী। ট্যারিফ কমিশনও দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে যতটা সক্রিয়, দাম কমানোর ক্ষেত্রে ততটাই চুপচাপ। ব্যবসায়ীরাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে বলে সরকারও তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয় না।’
নাজের হোসাইন আরও বলেন, ‘উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—বিশ্ববাজারে গম, আটা ও ময়দার দাম অনেক দিন ধরেই কম, কিন্তু দেশে তার কোনো প্রভাব নেই। আবার সয়াবিন তেলের দাম সামান্য বাড়লেই ব্যবসায়ীরা সরবরাহ কমিয়ে দেন এবং সরকারকে দাম বাড়ানোর অনুমোদনের জন্য চাপ দেন।’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘দাম বাড়লেই সরকার আমদানি শুল্ক ও কর কমিয়ে নানা নীতিগত সহায়তা দেয়। কিন্তু সেই সুবিধা সাধারণ ক্রেতাদের কাছে যায় না—ব্যবসায়ীরাই লাভ তুলে নেয়।’
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন