বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি জুলাই সনদে স্বাক্ষরের পথে
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি, বিশেষ করে গণভোটের সময়সূচি নিয়ে কিছু মতবিরোধ থাকলেও বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সনদে স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। সনদে কারা স্বাক্ষর করবেন, সেটিও দলগুলো ঠিক করে রেখেছে। তবে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক নেতারা জানিয়েছেন, তাঁরা ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’-এর চূড়ান্ত কপি দেখে তারপরই সইয়ের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, দলটি জুলাই সনদে স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত। দলের পক্ষে দুজন নেতা স্বাক্ষর করবেন—মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় বিএনপির পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছেন সালাহউদ্দিন আহমদ। দলের স্থায়ী কমিটি তাঁদের মনোনয়ন চূড়ান্ত করে আরও আগেই নাম পাঠিয়েছে ঐকমত্য কমিশনে।
বিএনপির নেতাদের মতে, জুলাই সনদ সংবিধান ও রাষ্ট্র সংস্কারের নতুন ভিত্তি তৈরি করবে। গণভোটের সময় নিয়ে তারা বাস্তবসম্মত পন্থায় ঐকমত্য চান। দলের নেতারা মনে করেন, জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোট হলে সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা যে প্রস্তাব দিয়েছি—জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোট—এর চেয়ে সহজ, ভারসাম্যপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক আর কিছু হতে পারে না। এর সঙ্গে প্রায় সবাই একমত।’
এদিক জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকেও জুলাই সনদে স্বাক্ষরের জন্য দুজন শীর্ষ নেতার নাম ঠিক করা হয়েছে। তাঁরা হলেন দলের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এবং সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় জামায়াতের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
জামায়াত বলছে, জুলাই ঘোষণাপত্রে তাদের দাবিগুলো উপেক্ষিত হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে এবার তারা অনেক বেশি সতর্ক। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, জুলাই সনদে কীভাবে ঐকমত্য ও ভিন্নমতগুলো স্থান পাচ্ছে, গণভোটের রূপ ও সময় কীভাবে নির্ধারিত হচ্ছে—এসব বিষয় জানার পরই তাঁরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
জামায়াত সংসদের উভয় কক্ষেই সংখ্যানুপাতিক (প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন বা পিআর) পদ্ধতি অন্তর্ভুক্তির দাবি জানিয়েছে। এ বিষয়েও তারা সনদে কীভাবে প্রতিফলন ঘটছে, তা দেখতে চায়। শিগগিরই দলের শীর্ষ নেতারা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেন।
আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘জুলাই সনদে কী আছে, তা আগে দেখে তারপরই আমরা স্বাক্ষর করব।’
অন্যদিকে জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) জুলাই সনদে স্বাক্ষরের জন্য নিজেদের প্রতিনিধিদের নাম ঠিক করে রেখেছে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, তারা হলেন আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্যসচিব আখতার হোসেন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় এনসিপির প্রতিনিধিত্ব করেছেন যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন। তিনি বলেন, ‘জুলাই সনদের চূড়ান্ত কপি এখনো আমরা পাইনি। পাশাপাশি এটি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া সম্পর্কেও এখনো জানানো হয়নি। ঐকমত্য কমিশন কী সিদ্ধান্ত নেয়, তার ওপর ভিত্তি করে এনসিপি পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করবে। যদি এনসিপি সনদে স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্যসচিব আখতার হোসেন স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যাবেন।’
এনসিপির পাশাপাশি নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন ও এবি পার্টিও সনদে স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নিয়েছে। নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না ও সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার; গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসান রুবেল; এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু ও জেনারেল সেক্রেটারি আসাদুজ্জামান ফুয়াদ স্বাক্ষর করবেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘আমাদের নাম পাঠানো হয়েছে। তবে সনদ হাতে পাওয়ার পরই আমরা স্বাক্ষরের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।’
১৫ অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান
১৫ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ স্বাক্ষর অনুষ্ঠিত হবে। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ওই অনুষ্ঠানের নেতৃত্ব দেবেন।
যদিও স্বাক্ষরের তারিখ ঠিক করা হয়েছে, সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি, বিশেষ করে গণভোটের সময়সূচি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
এক বছর ধরে আলোচনায় থাকা সংবিধান ও রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের প্রস্তাবের সারমর্ম হলো এই ‘জুলাই জাতীয় সনদ’। জনগণের সম্মতিক্রমে সনদকে বৈধ করার জন্য গণভোট আয়োজনের বিষয়ে দলগুলো একমত হলেও, কবে এবং কীভাবে গণভোট হবে তা নিয়ে প্রধান দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে।
বিএনপি ও তার মিত্ররা জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোট করার পক্ষে। তাদের মতে, একই দিনে ভোট হলে সময়, অর্থ ও প্রশাসনিক ব্যয় কমবে। অন্যদিকে জামায়াত, এনসিপি ও আরও কয়েকটি দল মনে করে, নির্বাচনের আগে গণভোট হলে জনগণের মনোযোগ ও অংশগ্রহণ বেশি থাকবে।
জামায়াতের মতে, একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট করলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। এতে যে উদ্দেশ্যে গণভোট করা হচ্ছে, তা জাতীয় নির্বাচনের কোলাহলে গুরুত্ব হারাতে পারে।
অন্যদিকে বিএনপির নেতারা আশঙ্কা করছেন, আগে গণভোট আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিলে জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচি বিলম্বিত করার অজুহাত তৈরি হতে পারে।
রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আগামী এক-দুই দিনের মধ্যেই জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়া হাতে আসবে। তখনই দলগুলো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে।
সব পক্ষের লক্ষ্য এখন একটাই—জুলাই সনদ যেন রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রতীক হয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। তবে গণভোটের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে সমঝোতা না হলে সেই ঐকমত্য কতটা দৃঢ় হবে, সেটিই এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন