[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

এবার চুনারুঘাটে চা-বাগানের ছড়া থেকে লুট হচ্ছে সিলিকা বালু

প্রকাশঃ
অ+ অ-
হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার দেউন্দি চা-বাগানের পাশের গিলানী ছড়া থেকে এভাবেই প্রতিদিন বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে ছড়াটি এখন বিশাল খাদে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি পাশের সেতুটিও ঝুঁকিতে পড়েছে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সবুজ চা-বাগানের ভেতর ছড়িয়ে থাকা ছড়া থেকে প্রতিদিন রাতের আঁধারে অবৈধভাবে মূল্যবান সিলিকা বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। অভিযোগ আছে, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় একাধিক সিন্ডিকেট এই প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করছে।

চুনারুঘাটের বিভিন্ন চা-বাগানের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা ছোট ছড়াগুলো প্রকৃতির প্রাণধারা। পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নেমে আসা স্বচ্ছ জলের এই ছড়া চারপাশের সবুজ টিলার সঙ্গে মিলিয়ে চা-বাগানের মূল সৌন্দর্য তৈরি করে। এ জলাধার টিকিয়ে রেখেছে এলাকার জীববৈচিত্র্য। কিন্তু বালু উত্তোলন ও নির্বিচার মাটি কেটে নেওয়ার কারণে সেই সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে।

সিলিকা বালু মূল্যবান। এর রাসায়নিক ও ভৌত বৈশিষ্ট্যের কারণে কাচ তৈরি, নির্মাণ সামগ্রী ও কৃত্রিম ঘাসের মতো বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহার হয়।

স্থানীয়দের অভিযোগ, চা-বাগানের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ছড়াগুলো থেকে দীর্ঘদিন ধরে কিছু প্রভাবশালী চক্র বালু উত্তোলন করছে। তারা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় এই কাজ করছে। ফলে ছড়ার প্রাকৃতিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তলদেশ গভীর হচ্ছে, দুই তীর ভেঙে যাচ্ছে। এতে আশপাশের বৃক্ষরাজি ও বসতবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

গত শনিবার সকালে উপজেলার দেউন্দি চা-বাগানের পাশের গিলানী ছড়ায় দেখা যায়, একদল শ্রমিক বেলচা দিয়ে বালু উত্তোলন করে ট্রাক্টরে উঠাচ্ছেন। কয়েকজন নারী শ্রমিকও এতে জড়িত ছিলেন। গণমাধ্যম কর্মীর উপস্থিতি টের পেয়ে তারা দ্রুত পালিয়ে যান। চারপাশ ঘুরে দেখা যায়, ছোট ছড়াটি এখন বিশাল খাদে পরিণত হয়েছে। নির্বিচার বালু উত্তোলনের কারণে আশপাশের উঁচু–নিচু টিলা ভেঙে ছড়ার মধ্যে পড়ছে, ফলে ছড়ার প্রশস্ততা বেড়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা বলরাম জানান, “দুপুরে যেমন-তেমন থাকে, রাত হলেই বালু ব্যবসায়ীদের আনাগোনা বেড়ে যায়। ভয়ে কারও কথা বলার সাহস নেই।”

গিলানী ছড়ার মতো চুনারুঘাট উপজেলার আরও ১৫ থেকে ২০টি স্থানে সিলিকা বালু উত্তোলন করছে কয়েকটি চক্র। এর মধ্যে পাইকপাড়া ইউনিয়নের বদরগাজী ও আমপারা ছড়া উল্লেখযোগ্য। এখানে বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত আছেন জসিম মিয়া ও তাঁর ভাগনে সাবেক ইউপি সদস্য রমজান আলী।

আহমেদাবাদ ইউনিয়নের নালুয়া ও আমু চা-বাগানের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া সুতাং ছড়ার কালিশিরী ও ঘনশ্যামপুর থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এখানে কাজ করছেন সাব্বির আহমেদ চৌধুরী ও রুমেল আহমেদ।

গাজীপুর ইউনিয়নের ইসালিয়া সেতুর কাছাকাছি স্থান থেকে বালু উত্তোলন করছেন শাকিল আহমেদ, তপু মাস্টার ও কাজল মিয়া। মিরাশী ইউনিয়নের বড়জুষ বাজারের জনকুরা এলাকার করাঙ্গী নদী থেকে বালু উত্তোলন করছেন আবুল কালাম ও আখলাছ মিয়া।

রানীগাঁও ইউনিয়নের পারকুল চা-বাগান জিবধর ছড়া মনিপুর ব্রিজের পাশে বালু উত্তোলন করছেন মিজানুর রহমান নামের একজন ইউপি সদস্য। 

হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার বদরগাজী এলাকায় একটি চা-বাগানের ছড়া থেকে আজ রোববার ভোরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সময় উপজেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়ে ১৪ জনকে আটক করে। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাঁদের এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন | ছবি: উপজেলা প্রশাসনের সৌজন্যে 

স্থানীয়দের অভিযোগ, বালু উত্তোলনকারীদের অধিকাংশই নিজেদের বিএনপির সমর্থক হিসেবে পরিচয় দেন। তবে তাঁদের কোনো পদ বা দায়িত্ব নেই।

অভিযুক্তদের সঙ্গে কথা বললে প্রত্যেকেই বালু উত্তোলনের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছেন।

চা-বাগানের শ্রমিকরা জানান, আগে এসব ছড়ার পানি তাঁরা দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করতেন। এখন পানি ঘোলা হয়ে গেছে, কোথাও কোথাও শুকিয়ে গেছে। ফলে দূর থেকে পানি আনতে হচ্ছে। বালু উত্তোলনের কারণে ছড়ার পাশের টিলাগুলো ভেঙে পড়ায় শ্রমিকদের কিছু বস্তুও ঝুঁকিতে পড়েছে।

গিলানী ছড়া এলাকার চা-শ্রমিক জয়ন্ত কৈরী বলেন, 'আমরা ছোটবেলা থেকেই এই ছড়াগুলোতে মাছ ধরতাম, স্নান করতাম। এখন শুধু বালু খনন আর মেশিনের আওয়াজ শোনা যায়। নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, গাছ মরে যাচ্ছে।' 

চুনারুঘাটের দেউন্দি চা-বাগানের পাশের গিলানী ছড়া থেকে এভাবে বালু উত্তোলন করে ট্রাক্টরে করে নিয়ে যাওয়া হয় বিভিন্ন স্থানে। রাত হলে বালু উত্তোলনের মাত্রা বেড়ে যায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন  

 পরিবেশবিদরা বলছেন, এসব ছড়া শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উৎস নয়, এগুলো চা-বাগানের পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বালু উত্তোলনের কারণে মাটি ক্ষয় হচ্ছে, জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়ছে এবং টেকসই বাগান চাষ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাঁরা প্রশাসনের কার্যকর উদ্যোগে অবৈধ কর্মকাণ্ড বন্ধ করার দাবি করেছেন।

পরিবেশকর্মী তোফাজ্জল সোহেল বলেন, 'আগেও আমরা সিলেটের ভোলাগঞ্জে দেখেছি কীভাবে সাদাপাথরের সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে। চুনারুঘাটের ছড়া ও নদী থেকেও যদি এমনভাবে সিলিকা বালু উত্তোলন চলতে থাকে, তবে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।' তিনি আরও বলেন, 'বাংলাদেশ খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর অনুমোদন ছাড়া সিলিকা বালু উত্তোলন সম্পূর্ণ অবৈধ। এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে আমাদের বড় মূল্য দিতে হবে।' 

চুনারুঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, 'সিলিকা বালুর মহালগুলো জেলা প্রশাসন থেকে কাউকে ইজারা দেওয়া হয়নি। অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে প্রশাসন বিভিন্ন সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে আসছে। বালু ও গাড়ি জব্দ, লোকজন আটক করে সাজা ও জরিমানা করা হয়েছে। তবে এলাকাটি প্রত্যন্ত হওয়ায় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। অপরাধীরা সুযোগ পেলেই বালু উত্তোলন চালাচ্ছে। তবু প্রশাসন সতর্ক রয়েছে এবং অপরাধ বন্ধে সবসময় নজর রাখছে।' 

একটি মন্তব্য করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন