দেশের বাজারের চেয়ে কম দরে ভারতে কীভাবে ইলিশ রপ্তানি হচ্ছে
![]() |
| ইলিশের ভরা মৌসুম এখন। তবুও পাইকারি বাজারে সরববরাহ কম। ফলে দামও আকাশচুম্বী। শুক্রবার ভোরে বরিশালের পোর্টরোডের মৎস্য অবতরণকেন্দ্রের পাইকারি বাজারে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
ইলিশের রপ্তানি মূল্যের চেয়ে দেশের বাজারে দাম বেশি। ফলে রপ্তানির অনুমতি পাওয়া ব্যবসায়ীরা কীভাবে বেশি দামে ইলিশ কিনে কম দামে ভারতে পাঠাচ্ছেন, তা নিয়ে বরিশালে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা আলোচনা চলছে। কম মূল্যে ইলিশ রপ্তানির পেছনে হুন্ডির খেলা চলছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবার প্রতি কেজি ইলিশের ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য নির্ধারণ করেছে ১২ দশমিক ৫০ মার্কিন ডলার বা ১ হাজার ৫২৫ টাকা (প্রতি ডলার ১২২ টাকা ধরে)। রপ্তানির জন্য নির্ধারিত সাইজ হচ্ছে ৯০০ গ্রামের (এলসি সাইজ) ইলিশ। বরিশালের পোর্টরোডের পাইকারি মৎস্য অবতরণকেন্দ্রে গত বৃহস্পতিবার ১ মণ (৪২ কেজি) এলসি সাইজের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৭৬ হাজার টাকায়। সে হিসাবে প্রতি কেজি ইলিশের পাইকারি দাম দাঁড়াচ্ছে ১ হাজার ৭৮৮ টাকা। কিন্তু ভারতে রপ্তানি করা হচ্ছে কেজিপ্রতি আরও ২৬০ টাকার কমে—১ হাজার ৫২৫ টাকায়।
দুর্গাপূজা উপলক্ষে চলতি বছর ভারতে ১ হাজার ২০০ টন ইলিশ মাছ রপ্তানির নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ৮ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয় এ-সংক্রান্ত আদেশ জারি করে। গত বছর দুর্গাপূজা উপলক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রথমে ভারতে তিন হাজার টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পরে সেটি কমিয়ে ২ হাজার ৪২০ টন করা হয়। সেই তুলনায় এবার অর্ধেক ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
বরিশালের পোর্ট রোড ও বরগুনার পাথরঘাটা মোকামের একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, কাগজপত্রে ঠিকই মন্ত্রণালয়ের দরে রপ্তানি হচ্ছে। ভারতীয় আমদানিকারকেরা ব্যাংকের মাধ্যমে এই টাকা বাংলাদেশে পাঠাচ্ছেন। তবে ভারতের ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি হচ্ছে ওই দেশের বাজার দর অনুযায়ী। এই বাড়তি টাকা ভারতীয় ব্যবসায়ীরা নগদ বা হুন্ডি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের ফেরত পাঠাচ্ছেন। ফলে কাগজে লোকসানের মতো দেখা গেলেও বাস্তবে রপ্তানিকারকেরা অবৈধ পথে বাড়তি অর্থ পাচ্ছেন।
এবার অনুমোদিত ১ হাজার ২০০ মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানির আড়ালে শুধু বাড়তি মূল্য (প্রতি কেজিতে ২৬৩ টাকা) হিসাব ধরলেও প্রায় ৩১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা হুন্ডি মাধ্যমে লেনদেন হওয়ার আশঙ্কা আছে। আর ভারতের বাজার দর অনুযায়ী যদি আরও অর্থ যোগ হয়, তাহলে এই অবৈধ পন্থায় অর্থ আদান-প্রদানের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলেও জানান কয়েকজন ব্যবসায়ী।
বরিশাল ইলিশ মোকামের ব্যবসায়ী জহির সিকদার বলেন, ‘মৌসুমে মোকামে যেখানে ২ থেকে ৩ হাজার টন ইলিশ আসে, সেখানে এবার দিনে ১০০ টনও আসছে না। এমন পরিস্থিতিতে রপ্তানিকারকেরা ইলিশ সংগ্রহে নামলে দেশের বাজারে আর দেখা মিলবে না ইলিশের। সেই সঙ্গে দামও চলে যাবে নাগালের বাইরে। দেশের বাজারেই যেখানে এলসির ৯০০ গ্রাম ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ ১ হাজার ৭৮৮ টাকায় পাইকারি বিক্রি হচ্ছে, সেখানে ভারতে রপ্তানি করা হচ্ছে ১ হাজার ৫২৫ টাকায়। এটা অবিশ্বাস্য। এত কম দামে ইলিশ রপ্তানি কীভাবে করা হচ্ছে, বুঝতে পারছি না। নিশ্চয়ই কোনো ঘাপলা আছে। হুন্ডির বিষয়টি শোনা যায়, তবে সত্য–মিথ্যা জানি না।’
বরগুনা জেলা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘আমার মাথায় কিছুতেই বিষয়টির হিসাব মিলছে না। দেশে বাড়তি দামে ইলিশ কিনে কীভাবে কম দামে ইলিশ রপ্তানি করা হচ্ছে। সবই রহস্যজনক লাগছে।’
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ক্যাবের বরিশাল জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রনজিৎ দত্ত বলেন, ‘ভরা মৌসুমে ইলিশের আকাশচুম্বী দামে ক্ষুব্ধ ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই। আমরা নিজেরাই খেতে পারছি না, এর মধ্যে রপ্তানি করলে ব্যবসায়ীরা আরও দাম বাড়াবে। সরকারের উচিত ছিল সাধারণ মানুষের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা।’
চলতি বছর রপ্তানির অনুমতি পাওয়া দেশের ৩৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বরিশালের ৪টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলো হলো মেসার্স মাহিমা এন্টারপ্রাইজ, নাহিয়ান এন্টারপ্রাইজ, এ আর এন্টারপ্রাইজ ও তানিসা এন্টারপ্রাইজ। চারটি প্রতিষ্ঠানই নীরব হোসেন ওরফে টুটুলের মালিকানাধীন। তিনি কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের বরিশাল মহানগর শাখার শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক এবং সাবেক মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
নীরব হোসেনের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছর নীরব হোসেন কলকাতায় চলে যান। কিন্তু তিনি কলকাতায় অবস্থান করলেও তাঁর ঘনিষ্ঠদের মাধ্যমে রপ্তানি ব্যবসা ও কলকাতার আমদানি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করছেন। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে ইলিশ রপ্তানির সিন্ডিকেট তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিল। এবারও তাঁর চারটি প্রতিষ্ঠান অনুমতি পেয়েছে।
পোর্ট রোডের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, নীরব হোসেনের মামা পরিচয়ে মো. বাবর নামের এক ব্যক্তি তাঁর ব্যবসা পরিচালনা করছেন। জানতে চাইলে মো. বাবর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বলেন, তাঁদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ৩০ টন করে ইলিশ ভারতে রপ্তানি করবে। তবে মাছ না থাকায় তিন দিন আগে দুটি ছোট ট্রাকে এক টন মাছ রপ্তানি করতে পেরেছেন। বেশি দামে মাছ কিনে কম দামে রপ্তানির বিষয়ে তিনি বলেন, ব্যবসা করতে হলে লাভ-লোকসান থাকবেই। করার তো কিছু নেই। কলকাতার আমদানিকারকেরা কি নির্ধারিত রপ্তানি মূল্যের বাইরেও বাড়তি অর্থ পরিশোধ করেন, এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।’
২০১৫ সালের জাতীয় রপ্তানি নীতিতে প্রথমবারের মতো শর্তসাপেক্ষে ইলিশকে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে ইলিশ রপ্তানি শুরু হয় ২০১৯ সালে। সে বছরই প্রথম তিনটি চালান ভারতে পাঠানো হয়। এর পর থেকে প্রতিবছর দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের ইলিশ মাছ নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। গত পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ ইলিশ রপ্তানি হয়েছে, তা মোট উৎপাদনের মাত্র শূন্য দশমিক ২৯ শতাংশ। এ ছাড়া সরকার যে পরিমাণ রপ্তানির অনুমোদন দেয়, তার কম ইলিশ যায় ভারতে। যেমন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত বছর ৭৯টি প্রতিষ্ঠানকে ৩ হাজার ৯৫০ টন রপ্তানির অনুমতি দিলেও বেনাপোল ও আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে সব মিলিয়ে ইলিশ রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৮০২ টন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৭৬ টন বা ৪ লাখ ৭৬ হাজার কেজি ইলিশ রপ্তানি করা হয়। এতে আয় হয় সাড়ে ৩৯ লাখ ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮০২ টন ইলিশ রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশের আয় হয়েছে ৮০ লাখ ডলার। তখন প্রতি কেজি ইলিশ মাছের রপ্তানি মূল্য ছিল ১০ ডলার বা ১ হাজার ৯৮ টাকা।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ইলিশ আহরণ কমেছে ৪২ হাজার টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আহরণ হয়েছিল ৫ লাখ ৭১ হাজার টন, গত অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ৫ লাখ ২৯ হাজার টনে। ধারাবাহিকভাবে দ্বিতীয়বারের মতো এ বছরও উৎপাদন কমার আশঙ্কা আছে।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে বরিশালের বাংলা বাজার এলাকায় কথা হয় বেসরকারি চাকরিজীবী নাইমুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলনে, ‘পরিবারে সবাই ইলিশ খাওয়ার আবদার করে আসছিল অনেক দিন। বাজারে কয়েকবার গিয়েছি, কিন্তু দাম শুনে মাথা ঘুরে যাওয়ার অবস্থা। খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে। ভেবেছিলাম, মৌসুমের শেষ দিকে হয়তো দাম কিছুটা কমবে। এর মধ্যে আবার সরকার ভারতে রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন আর খাওয়ার কোনো আশা রইল না।’

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন