সত্য-মিথ্যার প্রতীকী অন্তর্ভুক্তির কর্পোরেট ফাঁদ
![]() |
| ‘বাজি’ বাজে, আড়ালে পড়ে লাকিংমের নৃশংস মৃত্যু আর কল্পনা চাকমার নিখোঁজ হওয়ার সত্য | ছবি: সংগৃহীত |
‘আবার আমি গিয়েছিলাম/ নীল সাগরের জল/ সাগরের কন্যারই মন/ পাইনে সে অতল/ জল,/ কেন চোখে জল?/ চঞ্চল/ মেয়ে তুই বল/ জল,/ কেন চোখে জল?’
হ্যাঁ, বলছি কোক স্টুডিও বাংলার ‘বাজি’ গানটির কথা। এই বাজি আদিবাসী নারীকে পাওয়া না-পাওয়ার আখ্যান, তার জীবনের সত্যিকারের লড়াইয়ের গল্প নয়।
প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো, আমি এই গানের কোনো সরল ব্যাখ্যা করতে বসিনি। সঙ্গীত তো শুরুতে সাহিত্য হিসেবে রচিত হয়। তবে সাহিত্যের সত্য, মিথ্যা, প্রতীক ও চিত্রকল্পের সঙ্গে যখন কর্পোরেটের সত্য, মিথ্যা এবং তথাকথিত অন্তর্ভুক্তির ফাঁদ পাতা হয়, তখন সকলই গরলে পরিণত হতে পারে, সাধারণত হয়ে থাকে।
‘বাজি’ গানের দৃশ্যকল্প পাহাড় থেকে এসে যুক্ত হয়েছে ‘সাগরের কন্যা’র সঙ্গে। এই চিত্রকল্প সহজেই পটুয়াখালীর সাগরকন্যা কুয়াকাটার সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যায়। কেননা কুয়াকাটাকে ‘সাগরকন্যা’ বলা হয়ে থাকে। সাগর কন্যা মানেই বাংলাদেশের আপামর মানুষের কাছে কুয়াকাটা। কুয়াকাটা মানেই তাদের কাছে সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত। পর্যটনের চাদরে ঢেকে রাখা হয় সেখানকরা রাখাইন জনগোষ্ঠীর দীর্ঘ বঞ্চনা, জমি হারানো এবং টিকে থাকার সংগ্রামের কথা। সঙ্গীত কারও কাছে নিছক প্রেমের গল্প হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে এই গানটি আদিবাসী নারীর চোখে প্রতিদিনকার বঞ্চনা, শোষণ ও ইতিহাসের দায় শোধের চেষ্টা হয়ে ধরা দিতে পারত।
দেয়নি কেন, তার জন্য এই ‘সাগরের কন্যা’র আদি ইতিহাস বিবৃত করি। কুয়াকাটার আদি নাম ‘ক্যাংছাই’—রাখাইন ভাষায় ‘ক্যাং’ মানে ‘ভাগ্য’ এবং ‘ছাই’ মানে ‘কূল’, অর্থাৎ, ‘ভাগ্যকূল’। নিরাশ্রিত রাখাইনদের হয়তো কুয়াকাটা একদা ভাগ্যকূল হয়ে ধরা দিয়েছিল। তবে একই সঙ্গে যে মন্দভাগ্যেরও ছিল, এ নিয়ে একটি জনশ্রুতি রয়েছে, এই জায়গায় মিষ্টি পানির খোঁজে কূপ বা কুয়া খনন করা হতো। কিন্তু প্রায়শই দেখা যেত, কুয়া কাটলে বা খনন করলে বালির বাঁধ ভেঙে পড়ে, ফলে রাখাইনরা বারবার দুর্ভোগের মুখে পড়ত। এই কারণেই অনেকে একে রাখাইন ভাষায় ‘ক্যাওয়েছাই’ (অর্থাৎ ‘ভাগ্যমন্দ’) নামে ডাকা হতো।
এক পর্যায়ে ‘ক্যাওয়েছাই’ বা ‘ক্যাংছাই’ ভাষার বিবর্তনে পরিবর্তিত হয়ে বাংলায় ‘কুয়াকাটা’ হয়ে গেল। একটু পেছনে ফেরা যাক; রাখাইনরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং তাদের প্রাচীন আবাসভূমি ছিল আরাকান (বর্তমান মিয়ানমার রাখাইন রাজ্য)। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২৫ সাল থেকে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আরাকান ছিল একটি স্বাধীন রাজ্য। অষ্টাদশ শতকে রাজদরবারের অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রে রাজা মহাথামাদা বর্মী রাজা বোদোপায়ার কাছে পরাজিত হন। বর্মীরা আরাকান দখল করে এবং সেখানে নিষ্ঠুর দমনপীড়ন চালায়।
এই দমনপীড়নের মুখে পড়ে, ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে, শীতল এক অন্ধকার রাতে ১৫০টি রাখাইন পরিবার পিতৃভূমি ত্যাগে বাধ্য হয়। ব্রিগেডিয়ার তেমনগ্রী, পিইউ অং, ক্যাপ্টেন উম্রাচো, ক্যাপ্টেন মংগ্রীর নেতৃত্বে ৫০টি নৌযানযোগে তারা পাড়ি জমায় বিক্ষুব্ধ সমুদ্র পথে, এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে।
নৌকায় কাটানো দীর্ঘ ১১ দিন ক্ষুধা, তৃষ্ণা আর ক্লান্তির সঙ্গে সংগ্রাম করে শেষে তারা এসে পৌঁছায় গলাচিপা উপজেলার রাঙ্গাবালি দ্বীপে এবং ভোলার চর কুকরি-মুকরি দ্বীপে। এখান থেকেই শুরু হয় তাদের নতুন জীবনের সংগ্রাম। পরবর্তী প্রায় ৪৮ বছর ধরে তারা বিভিন্ন স্থান ঘুরে এক সময় বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী এক অঞ্চল আবিষ্কার করে। সেই স্থানটির নাম রাখে ক্যাংছাই। রাখাইন জনগোষ্ঠীর এই দীর্ঘ, বেদনায়ক কিন্তু সাহসিকতায় ভরা ইতিহাস।
এটি কুয়াকাটার জন্মগাথা। আজকের বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির পরিপূর্ণ চিত্র আঁকতে এই অধ্যায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। রাখাইনদের সংগ্রামের গল্প। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী, কলাপাড়া এবং বরগুনার তালতলী এলাকায় আবাস গড়ে তোলেন তুলেছিলেন আমার পূর্ব প্রজন্মের নারী-পুরুষ। শ্বাপদসংকুল বনবাদাড় আর দুর্যোগপ্রবণ এই অঞ্চলকে তারা চাষবাসের উপযোগী করে তুলেছিলেন।
ফিরে আসি, কোক স্টুডিওতে। কোক স্টুডিও কোনো ছোট উদ্যোগ নয় এটি বৈশ্বিক, কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত একটি প্ল্যাটফর্ম। বাংলাদেশে, যেখানে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংগ্রাম সম্পর্কে অনেকেই সামান্যই জানে বা কম জানানো হয় সেখানে এই দৃশ্য, নৃত্য-গীত ও কাস্টিং কোটি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে।
‘বাজি’ গানটিতে আদিবাসী সংস্কৃতির কেবল শর্টকাট প্রতীক—বাঁশ নাচ, একটি লোকগানের অংশবিশেষ এবং একজন বাঁশিবাদকের বাঁশি—টোকেন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। অথচ আদিবাসী শিল্পীরা সিদ্ধান্তগ্রহণে কোথাও নেই। কিয়ো উ প্রু মারমার বাঁশি এবং তার নানি ম্রাকোইচিং মারমা গান মাত্রা এনেছে। ভিডিওতে আদিবাসী নারী তার সম্পূর্ণ বাস্তবতা নিয়ে অনুপস্থিত; নারী হয়ে ওঠে নিছক বাজির বস্তু।
ফলে এটা আর অন্তর্ভুক্তির টোকেনইজমে সীমাবদ্ধ থাকে না। বাস্তবে যখন আদিবাসী নারীরা সহিংসতা ও অবহেলার শিকার, তখন তাদের নীরব প্রতীক বানানো কেবল সংস্কৃতির নয়, বরং কাঠামোগত সহিংসতার।
এ ধরনের কর্পোরেট উদ্যোগ যখন উপনিবেশ, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা ও ইতিহাসের গল্প ধার করে, তখন প্রেক্ষাপট বাদ দিলে আসল সত্য আড়াল হয়ে যায়। যেমনটা আড়াল পড়েছিল এবার ঢাকায় চারুকলার বর্ষবরণের আনন্দ শোভাযাত্রায়। আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের জন্য ডেকে আনা হয়েছিল সেই প্রতীকী অন্তর্ভুক্তির টোকেনিজম খেলা। বৈচিত্র্যের দাবি মেটানোর জন্য কেবল লোক দেখানোর খাতিরে প্রতীকী পদক্ষেপ। প্রকৃত পরিবর্তন আনার জন্য আন্তরিক ও কাঠামোগত উদ্যোগ না নিয়ে, দৃশ্যমানতা বাড়ালে বাস্তব সংগ্রাম চাপা পড়ে।
আমাদের কয়জনের জানা আছে লাকিংমের কথা। সেই লাকিংমে, কক্সবাজারের যে মেয়েটি অপহরণের পর জোরপূর্বক ধর্মান্তরে বাধ্য হয়। ধর্ষণের পরিণতিতে সন্তানও জন্ম দিয়েছিল যে লাকিংমে তাকে হত্যা করা হয়েছে। যদিও আতাউল্লার পরিবার দাবি করে, লাকিংমে স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছিল এবং পরে বিষপানে আত্মহত্যা করেছে। হাসপাতালের হিমঘরে ২৬ দিন ধরে পড়ে ছিল লাকিংমে চাকমার মরদেহ। ১৫ বছর বয়সী এই কিশোরী টেকনাফ উপজেলার সমুদ্র উপকূলীয় ইউনিয়ন বাহারছড়ার দক্ষিণ শিলখালী এলাকার বাসিন্দা ছিল। মেয়ের খোঁজ না পেয়ে কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছিলেন লাকিংমের বাবা লালা অং চাকমা। তারপর প্রায় ১১ মাস কেটে যায়। এ সময় তিনি সর্বত্র মেয়ের সন্ধান করেছেন। অবশেষে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে মেয়ের খোঁজ পান লাকিংমের মা-বাবা; তবে জীবিত নয়, মৃত অবস্থায় কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে। লাকিংমের বয়স যেহেতু মাত্র ১৫ বছর, আইন অনুযায়ী তার ধর্মান্তরিত হওয়া বা বিয়ে উভয়ই অবৈধ। তাই দীর্ঘ ২৬ দিন পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার মরদেহ বাবার কাছে হস্তান্তর করেছে।
দেশের প্রায় সব পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল লাকিংমের মর্মন্তুদ মৃত্যুর আখ্যান। তবে কতটা গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়েছিল, সেই প্রশ্ন রয়েই যায়। এক লাকিংমে নয় এভাবে অনেক লাকিংমের ওপর বিচারহীন জুলুম, অন্যায় পাহাড় থেকে সমতল ঘটছে সর্বত্র। শেরপুরে হাজং জনগোষ্ঠী দেখেছে বহিরাগত বাঙালির অভিবাসন আর একের পর এক জমি দখলের ইতিহাস। বিচারহীনতা এমন এক সংস্কৃতি তৈরি করেছে, যেখানে আদিবাসী নারী দ্বিগুণ প্রান্তিকতায় জীবনযাপন করে। প্রান্তিকতার প্রান্তিক অবস্থানে থাকা আর বিচারহীনতার সংস্কৃতির প্রলয়ে পড়ে মেঘের মতোই উড়ে যায় কোথাও কোনো অজানায়। তারা ভুলে যায় বিচার আদৌও পাওয়া যায়?
২০২৫ সালের পাঠ্যবইয়ে একটি গ্রাফিতির ছবি যোগ করা হয়েছিল, বছরের জানুয়ারিতে পাঠ্যবই থেকে ‘আদিবাসী” শব্দ সম্বলিত একটি চিত্রকর্ম সরিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে বিক্ষোভ জানাতে গিয়ে রক্তাক্ত হয় আদিবাসী শিক্ষার্থীদের অনেকেই।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এই মুছে ফেলার রাজনীতি শুধু শব্দ নয়, আদিবাসী মানুষের বাস্তব সংগ্রামকেও অদৃশ্য করে দেয়। কর্পোরেট বিজ্ঞাপন বা মিডিয়ায় দৃশ্যমানতা থাকলেও, বাস্তবে আদিবাসীদের ভূমি বেদখল, সহিংসতা ও বঞ্চনা চলমান। এর ফলে সমাজে মিথ্যা স্বস্তি তৈরি হয় যেন দৃশ্যমান হলেই পুনর্মিলন সম্পন্ন। অথচ সত্য হলো, এটি আসলে প্রতীকী অন্তর্ভুক্তির ফাঁদ।
আদিবাসী নারীরা প্রতিনিয়ত ভয়াবহ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে জীবন যাপন করে। তাই তাদের চোখে শুধু জলই থাকে, ছল নয়। হাশিম মাহমুদ হয়তো তার লেখা গানে ছন্দের দ্যোতনা ঠিক রাখতে গিয়ে জলের সঙ্গে ছল মিলিয়ে দিয়েছেন। আসলে চোখের জল ছল নয়, স্ফূলিঙ্গ হয়। তবে চোখের জলকে যারা স্ফুলিঙ্গে রূপান্তর করে, তাদের বাঁচতে দেওয়া হয় না। সেই সাহসী, নির্ভীক ও আপসহীন কল্পনা চাকমাকে রাষ্ট্র আজও খুঁজে বের করতে পারেনি, নিখোঁজ হওয়ার ২৯ বছর পরও। এই সত্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় শুধু গান, বিজ্ঞাপন বা প্রতীকী উদ্যোগ দিয়ে নয়, বরং আদিবাসীদের ভূমি, অধিকার, সাংবিধানিক স্বীকৃতি, নিরাপত্তা ও ন্যায়ের প্রশ্নে দায়বদ্ধতার মাধ্যমেই সত্যিকারের পুনর্মিলন সম্ভব।
● লেখক: নাট্যতত্ত্ববিদ ও আদিবাসী অধিকার কর্মী।
*মতামত লেখকের নিজস্ব

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন