[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

থমথমে খাগড়াছড়ি, তিনজনের মৃত্যু

প্রকাশঃ
অ+ অ-

খাগড়াছড়ির গুইমারার রমেসু বাজারের কয়েকটি দোকানে আগুন দেওয়া হয়। বাজারে পুড়ে যাওয়া একটি মোটরসাইকেল। রোববার দুপুরে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

খাগড়াছড়িতে এক কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে প্রতিবাদে পাঁচ দিন ধরে উত্তেজনা বিরাজ করছে। বুধবার থেকে রোববার পর্যন্ত চলা সড়ক অবরোধের সময় সংঘর্ষ ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রশাসন অবশেষে অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করেছে।

এই উত্তেজনার মধ্যেই খাগড়াছড়ি সদরের পাশের গুইমারা বাজারে আগুন দেওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। রোববার বিকেলে গুলিতে তিনজন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন সেনাবাহিনী ও পুলিশসহ অন্তত ২০ জন।

বর্তমানে খাগড়াছড়ি জেলা শহর থমথমে। সব দোকানপাট বন্ধ, শহরের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তবে পুলিশ বলছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অন্যদিকে, জুম্ম ছাত্র-জনতা তাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের সড়ক অবরোধসহ কর্মসূচি চালিয়ে যাবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।

জুম্ম ছাত্র-জনতা নামের ফেসবুক পেজে প্রকাশিত বিবৃতিতে তারা আট দফা দাবি জানিয়েছে।

ঘটনার সূত্রপাত ঘটে গত মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে। প্রাইভেট পড়ার পর ফেরার পথে কিশোরীটি দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। রাত ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় তাকে একটি খেত থেকে উদ্ধার করেন স্বজনরা। ধর্ষণের ঘটনায় কিশোরীর বাবা মামলা দায়ের করেন। পুলিশ ওই মামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে শয়ন শীল (২১) নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করেছে। আদালত তাকে ছয় দিনের রিমান্ডের আদেশ দিয়েছে।

পরবর্তী দিন বুধবার থেকে জুম্ম ছাত্র-জনতা ধর্ষণের প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু করে। বৃহস্পতিবার তাদের ডাকে আধাবেলা সড়ক অবরোধ হয়। শুক্রবার নারী নিপীড়নবিরোধী সমাবেশ পালন করা হয়। ওই দিন কোনো অবরোধ বা সংঘর্ষ হয়নি।

খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ করে সচেতন ছাত্র-যুব-নাগরিক সমাজ। রোবববার বিকেল ৫টায় চট্টগ্রাম নগরের চেরাগী পাহাড় মোড় এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন
 
শনিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আবারও সড়ক অবরোধের কর্মসূচি পালিত হয়। সদর উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে অবরোধকারীদের সঙ্গে স্থানীয় একটি পক্ষের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এতে উভয়পক্ষের চারজন আহত হয়েছেন। পরে নিরাপত্তা বাহিনী এসে পরিস্থিতি সামাল দিলেও বিকেল চারটার দিকে শহরের মহাজনপাড়া এলাকায় আবারও সংঘর্ষ বেধে যায়। মহাজনপাড়া, নারকেলবাগানসহ বিভিন্ন এলাকায় দোকানপাটে ভাঙচুর চালানো হয়। শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সদরের চারটি স্থানে দফায় দফায় সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রশাসন শনিবার বেলা দুইটার পর সদর, পৌর এলাকা ও গুইমারায় ১৪৪ ধারা জারি করে।
 
অবরোধের কারণে চলেনি কোনো যানবাহন। রোববার সকালে খাগড়াছড়ির চেঙ্গী স্কয়ার এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

এদিকে ধর্ষণের প্রতিবাদে ‘জুম্ম-ছাত্র জনতা’ ব্যানারে চলমান সড়ক অবরোধের সময় রোববার বেলা একটার দিকে গুইমারার রামেসু বাজারে আগুন দেওয়া হয়েছে। আগুনে বাজারের কয়েকটি দোকান পুড়ে গেছে। পাশাপাশি বাজারের পাশে থাকা কিছু বসতঘরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গুইমারা বাজার চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি সড়ক থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে অবস্থিত।

আগুন দেওয়ার ঘটনা ধারণকৃত ভিডিও ও ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, আগুনে বাজারের দোকানপাট জ্বলছে। দোকানমালিকদের অধিকাংশ পাহাড়ি বলে জানা গেছে।

ঘটনার পর গুইমারা উপজেলায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এলাকাজুড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী টহল দিচ্ছিল। এর আগে দুপুরে অবরোধের সমর্থকরা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ঘটেছে। ওই সময় গুলির শব্দও শোনা গেছে।

খাগড়াছড়ি সদরে খোলেনি কোনো দোকানপাট। রোববার সকালে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রত্যক্ষদর্শী মংসাজাই মারমা ও কংজরী মারমা জানিয়েছেন, তারা অবরোধের সমর্থনে খাদ্যগুদামের সামনের সড়কে দাঁড়িয়ে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করছিলেন। এই সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এসে তাঁদের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি করেন। কথাকাটাকাটির এক পর্যায়ে, তাদের অভিযোগ, বাহিনী তাদের ওপর গুলি চালায়। গুলির পরপরই লোকজন ভয়ে চারদিকে ছড়িয়ে যায়। পরবর্তীতে ২০-২৫ জন লোক রামেসু বাজার ও পাশের বসতবাড়ি লুটপাট করে এবং যাওয়ার সময় আগুন ধরিয়ে দেয়। এদের মধ্যে কিছু মানুষ মুখোশ পরেছিল। এই ঘটনায় দোকানপাট, বসতবাড়ি এবং কয়েকটি মোটরসাইকেলও আগুনে পুড়ে যায়।

গুলিতে তিনজন নিহত হওয়ার বিষয়টি চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপুলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি) আহসান হাবিব পলাশ নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, 'গুলিতে তিনজন নিহত হয়েছেন। লাশগুলো হাসপাতালে আছে। তবে কার গুলিতে কীভাবে মারা গেছে, তা এখনও নিশ্চিত নয়। এ ছাড়া আরও তিনজন আহত হয়েছেন।' 

খাগড়াছড়ি জেলা সিভিল সার্জন মোহাম্মদ সাবের জানিয়েছেন, 'গুইমারার তিনজন পুরুষের লাশ খাগড়াছড়ি জেলা হাসপাতালে আনা হয়েছে এবং মর্গে রাখা হয়েছে। সোমবার সকালে ময়নাতদন্ত করা হবে। এছাড়া হাসপাতালে গুইমারা থেকে আনা আহত চারজন চিকিৎসাধীন আছেন।'

আহত তিনজনের পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন বিকাশ ত্রিপুরা (২৬), চিংকেউ মারমা (২৬) ও উগ্য মারমা (২২)। তাদের খাগড়াছড়ি জেলা হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে। চিংকেউ মারমা বাঁ পায়ের হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এবং গুলি অপর পাশে বের হয়েছে। হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, তিনজনের অবস্থাই স্বাভাবিক রয়েছে।

সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধকারীদের অবস্থান। শনিবার সকালে চেঙ্গী ব্রিজ এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারা উপজেলায় দুষ্কৃতকারীদের হামলায় তিনজন পাহাড়ি নিহত হয়েছেন। এছাড়া মেজরসহ ১৩ জন সেনাসদস্য, গুইমারা থানার ওসিসহ তিনজন পুলিশ সদস্য এবং আরও অনেকে আহত হয়েছেন।

মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গভীর দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো অপরাধীকেই ছাড় দেওয়া হবে না।

এছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধৈর্য ধরে শান্ত থাকার জন্য অনুরোধ করেছে। 
 
‘তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন’ দেখছেন পার্বত্য উপদেষ্টা  
খাগড়াছড়িতে চলমান উত্তেজনার পেছনে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা। তিনি এই মন্তব্য করেছেন রোববার দুপুরে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত মতবিনিময় সভায়।

রোববার খাগড়াছড়িতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন
 
সুপ্রদীপ চাকমা বলেন, 'আন্দোলনের নামে সহিংসতা তৈরি করে একটি পক্ষ নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব। নতুন নতুন ইস্যু তৈরি করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে দেওয়া হবে না। প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া কেউ মিছিল বা মিটিং করতে পারবে না।' 

সভায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সুশীল সংগঠনের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।
 
বাস যাত্রায় দুর্ভোগ, শহরে থমথমে অবস্থা
সড়ক অবরোধের ফলে আটকা পড়েছেন অনেক মানুষ | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন   
 
রোববার বিকেল সাড়ে চারটা। চট্টগ্রামের অক্সিজেন এলাকায় বাস কাউন্টারের সামনে মানুষ অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। কাউন্টারের সামনে বাসের জন্য প্রহর গোনা হচ্ছে, কিন্তু কখন গাড়ি ছাড়বে তা কেউ জানে না। এ নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে কাউন্টারের কর্মীদের মধ্যে বচসাও হয়। 
 
মাটিরাঙ্গার সাখাওয়াত হোসেনও এখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি কৃষিকাজ করেন এবং তিন দিন আগে মেয়ের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। রোববার গ্রামের বাড়ি মাটিরাঙ্গা ফেরার জন্য কাউন্টারে এসেছিলেন।

সাখাওয়াত বলেন, 'আড়াই–তিন ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি। বাস আসবে–আসবে বলছে, কিন্তু আসে না। গুইমারায় মারামারি হচ্ছে, তাই কেউ ঠিকমতো বলতে পারছে না গাড়ি যাবে কি যাবে না। তারপরও অপেক্ষা করছি। আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করব। গাড়ি না পেলে মেয়ের বাসায় ফিরে যাব।' 

কাউন্টারে থাকা একজন কর্মকর্তা জানান, 'খাগড়াছড়িতে ঝামেলা হচ্ছে। পথে পথে ব্যারিকেড বসানো হয়েছে, গাছ ফেলে দেওয়া হয়েছে। এই অবস্থায় গাড়ি পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও চেষ্টা করছি।' 

এক দম্পতিও গ্রামের পূজার জন্য মাটিরাঙ্গা ফেরার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তবে পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছিল, যাওয়া সম্ভব হবে না। শেষ পর্যন্ত তারা গ্রামের বাড়ি যেতে পারেননি।

অন্যদিকে খাগড়াছড়ি শহরে রোববার সকাল থেকে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। শহরের মোড়ে মোড়ে নিরাপত্তা বাহিনী অবস্থান নিয়েছে। বাজার ও আশপাশের সব দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। যারা প্রয়োজনীয় কাজে বের হচ্ছেন, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে নিরাপত্তা বাহিনী। 
 
অবরোধ ও ১৪৪ ধারার কারণে খাগড়াছড়ি শাপলা চত্ত্বর রোববার ফাঁকা ও নীরব | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

একটি মন্তব্য করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন