এবার বিরোধিতায় বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা
![]() |
সাত কলেজকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় করার প্রতিবাদে আজ মঙ্গলবার কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে বেগম বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ছাত্রীরা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
ঢাকার সাতটি সরকারি কলেজের জন্য প্রস্তাবিত কাঠামোয় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় করার উদ্যোগের প্রতিবাদ জানিয়েছে বেগম বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ছাত্রীরা। তাঁরা আশঙ্কা করে বলেছে প্রস্তাবিত কাঠামোয় বিশ্ববিদ্যালয় হলে নারী শিক্ষার এই প্রতিষ্ঠানটি সংকুচিত হবে এবং নারী শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ জন্য তাঁরা চান প্রস্তাবিত ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ নতুন জায়গায় করা হোক। সেটি পূর্বাচল, কেরানীগঞ্জ বা ঢাকার পার্শ্ববর্তী অন্য কোনো এলাকায় করতে হবে, কিন্তু বিদ্যমান মহিলা কলেজকে সংকুচিত করে নয়।
সাত কলেজকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় করার প্রতিবাদে আজ মঙ্গলবার কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে বেগম বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ছাত্রীরা। পরে অধ্যক্ষের মাধ্যমে স্মারকলিপি দিয়ে নিজেদের পাঁচ দফা দাবির কথা তুলে ধরে ছাত্রীরা। ‘কলেজের স্বতন্ত্র কাঠামো ও ঐতিহ্য নষ্ট করে আসন্ন ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নামে নীতিমালা বা অধ্যাদেশ বা আইন জারির চেষ্টা, উচ্চশিক্ষা সংকোচন, নারী উচ্চ শিক্ষা সংকোচন এবং শিক্ষাকে বাণিজ্যকরণের প্রতিবাদে’ এ কর্মসূচি পালিত হয়। অবস্থান কর্মসূচি থেকে ‘কলেজ কেন বিশ্ববিদ্যালয় হবে জবাব দাও, জবাব চাই, নারী শিক্ষা সংকোচন চেষ্টা রুখে দাও’ ইত্যাদি স্লোগান দেয় ছাত্রীরা। এ বিষয়ে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও এসব কথা জানানো হয়।
আগের দিন গতকাল সোমবার সংবাদ সম্মেলন করে প্রস্তাবিত কাঠামোয় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় করার উদ্যোগ নিয়ে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছিল ঢাকা কলেজের উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ছাত্ররা। কলেজের ১৮৪ বছরের ঐতিহ্যের কথা উল্লেখ করে শিক্ষার্থীরা হুঁশিয়ার করেছে-বিদ্যমান একাডেমিক কাঠামোর কোনো পরিবর্তন বা সংকোচন যা উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তা তারা মেনে নেবে না। এ নিয়ে আজ কলেজে ক্যাম্পাসে মানববন্ধনও করেছে কলেজটির ছাত্ররা।
এর পাশাপাশি বেগম বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ছাত্রীরা ঢাকার সাতটি সরকারি কলেজের জন্য প্রস্তাবিত কাঠামোয় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় করার বিরোধিতা করে নামে নামল।
বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ছাত্রীরা বলেছে ঐতিহ্যবাহী সাতটি কলেজকে একত্র করে ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ করার ঘোষণা আপাতদৃষ্টিতে ইতিবাচক মনে হলেও শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষাবিদদের মধ্যে এ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, সিদ্ধান্তটি কি আসলেই শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়ন ঘটাবে, নাকি উল্টো দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা একটি জনবান্ধব শিক্ষাপ্রবাহকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে? শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসি উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। উচ্চমাধ্যমিক রেখে বিশ্ববিদ্যালয় কতটুকু যুক্তিযুক্ত হবে সেটাও বিবেচনায় আনা হয়নি। সরকার যদি চায় নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে পারবে কিন্তু সক্ষমতা থাকলে একটি ঐতিহ্য বা শতবর্ষী কলেজ সৃষ্টি করে দেখাক।
![]() |
সাত কলেজকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় করার প্রতিবাদে বেগম বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ছাত্রীদের হাতে নানা ধরনের প্ল্যাকার্ড | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
ছাত্রীরা বলেছে ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ একটি ঐতিহ্যবাহী নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বর্তমানে উচ্চমাধ্যমিকে সাড়ে চার হাজারেরে বেশি ছাত্রীসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তরসহ মোট ১৫ হাজার ছাত্রী অধ্যয়নরত। কলেজটিতে নারী শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে নির্মিত অবকাঠামোতে ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে অধ্যয়ন শুরু করলে নারী শিক্ষার্থীদের অসুবিধা হবে।
জানা গেছে, ছাত্রীরা কলেজের বাইরে যেতে চাইলে শিক্ষক, পরিদর্শন দল কলেজের ফটক বন্ধ করে দেয়। এ সময় শিক্ষকেরা বোঝানোর জন্য বক্তব্য দিতে গেলে ছাত্রীরা কলেজের ফটক খুলে খুলে রাস্তায় চলে আসে এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান নিতে দেখা যায়। কলেজশিক্ষকের চেষ্টায় তারা কলেজ ক্যাম্পাসে ফিরে আসে।
বেলা একটার দিকে ছাত্রীদের একটি প্রতিনিধি দল অধ্যক্ষের কাছে স্মারকলিপি দেয়। তাতে পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো হলো—
এক. বেগম বদরুন্নেসা মহিলা কলেজকে ‘হাইব্রিড’ বানানোর অপচেষ্টা থেকে সরে আসতে হবে।
দুই. নারী শিক্ষার এই প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিত কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় করার সব ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে। সে জন্য বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের কোনো অবকাঠামো ব্যবহার না করে স্বতন্ত্র জায়গায় স্বতন্ত্র নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
তিন. উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় একসঙ্গে চলতে পারে না। এতে উচ্চমাধ্যমিক বা বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সে জন্য বেগম বদরুন্নেসাকে কলেজকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা বন্ধ করতে হবে।
চার. ‘হাইব্রিড’ বিশ্ববিদ্যালয় নই, হাই কোয়ালিটি স্বতন্ত্র জায়গায় গবেষণা ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় করা হোক।
পাঁচ. শিক্ষার মানোন্নয়নে বেগম বদরুন্নেসার সরকারি মহিলা কলেজের অবকাঠামো উন্নয়ন, আবাসন সুবিধা বৃদ্ধি, যাতায়াত সুবিধা বৃদ্ধিতে বাস বাড়াতে হবে।
ঢাকার এই সাত কলেজ একসময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ছিল। ২০১৭ সালে এগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। সরকারি সাত কলেজ হলো ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ, বাঙলা কলেজ ও তিতুমীর কলেজ। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত জানুয়ারিতে এই সাত কলেজকে আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা করার কথা জানায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পরে সাত কলেজের জন্য নতুন বিশ্ববিদ্যালয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনকার মতো প্রতিটি কলেজে সব বিষয় পড়ানো হবে না। সাতটি কলেজকে চারটি স্কুলে (অনুষদের মতো) বিভক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০ শতাংশ ক্লাস হবে অনলাইনে আর ৬০ শতাংশ ক্লাস হবে সশরীর।
এ বিষয়টি নিয়ে এখন ত্রিমুখী অবস্থান নিতে দেখা গেছে। এ নিয়ে গত বুধবার ঢাকার এ সাতটি কলেজের কয়েক শ শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সামনে মানববন্ধন করেন এবং ইউজিসি চেয়ারম্যানের কাছে স্মারকলিপি জমা দেন। শিক্ষকেরা কলেজগুলোর জন্য প্রস্তাবিত কাঠামোয় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় চান না। তাঁদের আশঙ্কা, এই কাঠামো বাস্তবায়িত হলে কলেজগুলোর শিক্ষাব্যবস্থা ক্ষতির মুখে পড়বে। শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ কমে যাবে, শিক্ষকদের পদ-পদবি নিয়েও জটিলতা দেখা দেবে। ইডেন মহিলা কলেজ ও বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজে নারীশিক্ষার সুযোগও হুমকির মুখে পড়বে। এ জন্য শিক্ষকেরা বলছেন, সাতটি কলেজ ক্যাম্পাসকে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ দেওয়ার পরিবর্তে পৃথক ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয় (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো) স্থাপন করে কলেজগুলোকে এর অধিভুক্ত করা উচিত। যাতে বর্তমান ব্যবস্থা বহাল থাকে। নাম ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ থাকলেও আপত্তি নেই।
অন্যদিকে, প্রস্তাবিত কাঠামোয় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় করতে দ্রুত অধ্যাদেশ জারির দাবিতে আন্দোলন করছেন বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে আন্দোলন করে আসা ওই সব কলেজের শিক্ষার্থীরা। আর উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরাও নিজেদের উদ্বেগ জানিয়েছে মাঠে নেমেছে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন