প্রতিনিধি মৌলভীবাজার
![]() |
সাজিয়ে রাখা হয়েছে হাওরের তাজা মাছ। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কাউয়াদীঘি হাওরপারের করমউল্লাপুর কালভার্ট ঘাটে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
তখন বেলা পড়ে এসেছে। কালো রঙের চীনা হাঁসের মতো চিপচিপে গলা বাড়িয়ে তরতর করে জলের নালা পেরিয়ে আসছে একেকটি নৌকা। তাতে দু–একজন করে লোক। কেউ নৌকা বাইছেন, কেউ বসে আছেন। সব কটি নৌকাতেই কমবেশি মাছ। তাঁরা মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওর থেকে মাছ ধরে দিনের শেষে একটি অস্থায়ী ঘাটে ফিরছেন। সেখানে অপেক্ষায় মাছের পাইকার আর ক্রেতা।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার একাটুনা ও আখাইলকুরা ইউনিয়নের সংযোগস্থল কাউয়াদীঘি হাওরপারের কালাইপুরা এলাকার একটি কালভার্টের ওপর এই হাট বসেছে। সকালে ও বিকেলে কাউয়াদীঘি হাওরে মাছ ধরে মৎস্যজীবীরা এ ঘাটে মাছ বিক্রি করতে আসেন। খুচরা মৎস্য ব্যবসায়ীরা ওখান থেকে পাইকারি দরে মাছ কিনে ছড়িয়ে পড়েন ছোট-বড় গ্রামীণ হাটের দিকে, শহরের দিকে। শ্রাবণ থেকে কার্তিক মাস—এ সময়ে এই অস্থায়ী হাট বসে। এখানে শুধু কাউয়াদীঘি হাওরের তাজা মাছই ওঠে।
![]() |
হাওরের তাজা মাছ পেতে যেতে হবে কাউয়াদীঘি হাওরপারের করমউল্লাপুর কালভার্ট ঘাটে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
কাউয়াদীঘি হাওরপারের গ্রাম কালাইপুরা। ওখানে গিয়েই দেখা মেলে এই হাটের। হাট বলতে সাধারণত যে চেহারাটা ধরে নেওয়া হয়, এ হাটে সে রকম কিছু নেই। এখানে শুধু ছোট ছোট বাঁশ–বেতের পাত্রে সাজিয়ে রাখা আছে মাছ। নৌকা থেকে মাছ নামানোর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় টানাটানি, দামাদামি। এবার পানি কম, মাছও কম। হাওরের মাছের চাহিদা বেশি থাকে, তাই দামটাও অনেক চড়া।
মাছ নিয়ে আসা কালাইপুরার মাসুম মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তিনি সকাল বেলা ৫০০ টাকার মাছ বিক্রি করেছেন। বিকেলে যে মাছ পেয়েছেন, তা হয়তো ৪০০ টাকায় বিক্রি করতে পারবেন।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে করমউল্লাপুর কালভার্টে এই অস্থায়ী হাট বসছে। আগে এখানে কোনো হাট ছিল না। যাঁরা মাছ ধরতেন, তাঁরা নিজেরাই কাছের হাটবাজারে, নয়তো মৌলভীবাজার শহরে গিয়ে মাছ বিক্রি করতেন। অস্থায়ী হাট হওয়ায় এখানেই বেচে দেন।
![]() |
হাওরে মাছ ধরে নৌকায় করে ঘাটে ফিরছেন মৎস্যজীবীরা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
এখানে যাঁরা মাছ নিয়ে আসেন, তাঁদের বেশির ভাগই কালাইপুরা গ্রামের। এটি মৎস্যজীবী–অধ্যুষিত একটি গ্রাম। দুই বেলাতেই এখানে এখন হাট বসে। রাতে যাঁরা হাওরে মাছ ধরেন, তাঁরা সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে সাতটার মধ্যে এই ঘাটে মাছ নিয়ে আসেন। সকাল আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে বেচাকেনা শেষ, হাটও শেষ। দুপুরের পরে যাঁরা হাওরের দিকে মাছ ধরতে যান, তাঁরা বিকেল পাঁচটার দিকে হাটে আসেন। সন্ধ্যাতেই হাট শেষ। হাটে ছোট মাছই বেশি ওঠে। একদম তাজা মাছ, হাটে নিয়ে আসার পরও অনেক মাছ নড়াচড়া করে। পুঁটি, টেংরা, মলা, ভেদা, চান্দা–জাতীয় মাছই বেশি। মাঝেমধ্যে রুই–জাতীয় ছোট আকারের কিছু মাছ পাওয়া যায়। প্রতিদিন শুধু কালাইপুরা গ্রাম থেকেই অর্ধশতাধিক মানুষ হাওরে মাছ ধরতে যান। প্রতিদিন এই অস্থায়ী ঘাটে ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকার মাছ বেচাকেনা হয়।
![]() |
জেলেদের কাছ থেকে মাছ কিনে গুছিয়ে নিচ্ছেন একজন খুচরা বিক্রেতা। সেই মাছ বিক্রি করবেন শহরে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
মো. আমির নামের এক ক্রেতা বলেন, তিনি প্রায়ই এখানে মাছের জন্য আসেন। এক হাজার টাকার ছোট মাছ কিনে বললেন, ‘হাওরের তাজা মাছের স্বাদই আলাদা।’
![]() |
মাছ নিয়ে চলছে দরদাম | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
কালাইপুরা গ্রামের আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘১০ থেকে ১৫ বছর ধরে এখানে হাট বসছে। আগে এখানে এ রকম বেচাবিক্রি হতো না। প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০ জন হাওরে মাছ ধরতে যান। তাঁরাই ঘাটে মাছ এনে বিক্রি করেন। সকাল ও বিকেলে হাট বসে। শ্রাবণ মাস থেকে হাট শুরু হয়েছে, কার্তিক মাস পর্যন্ত যত দিন হাওরে পানি থাকবে, তত দিন চলবে।’