বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে জুলাই আন্দোলনের হুমকির অডিও ফাঁস, শিক্ষককে বরখাস্ত
![]() |
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রক্টরকে বহিষ্কার করা হয়েছে |ছবি: সংগৃহীত |
শিক্ষার্থীদের জুলাই আন্দোলনে অংশ নিলে ছাত্রত্ব বাতিলের ‘হুমকির অডিও’ ফাঁসের জেরে রাজশাহীর নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রক্টর এ জে এম নূর-ই-আলমকে সব ধরনের কার্যক্রম থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। শুক্রবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ আজিবার রহমান স্বাক্ষরিত এক আদেশে এ তথ্য জানা যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ আজিবার রহমান বলেন, গত মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয় গঠিত পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক চাকরি বিধিমালা ধারা-৮ অনুযায়ী নূর-ই-আলমকে সব ধরনের পদ থেকে স্থায়ীভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এই আদেশ মঙ্গলবার থেকেই কার্যকর হয়েছে।
তবে বহিষ্কারাদেশের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বহিষ্কৃত শিক্ষক এ জে এম নূর-ই-আলম। তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়নি বলে তিনি দাবি করেন। এ ব্যাপারে উপাচার্য বলছেন, ‘মবের জন্য তাড়াহুড়া করেছি।’
এ জে এম নূর-ই-আলম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও প্রক্টর ছিলেন। গত সোমবার বিকেলে বিভিন্ন ফেসবুক আইডিতে তাঁর সঙ্গে এক শিক্ষার্থীর কথোপকথন দাবি করা একটি অডিও প্রকাশ পায়, যেখানে তিনি জুলাই আন্দোলনে যোগ দিলে ছাত্রত্ব বাতিলের হুমকি দেন। যদিও ওই শিক্ষক অডিওটিকে ‘এডিট করা’ বলে দাবি করেন।
ওই ঘটনার পর সোমবার রাত সাড়ে আটটার দিকে নগরের চৌদ্দপাই এলাকায় ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে দুই পাশে যান চলাচল বন্ধ করে দেন। রাত সাড়ে ৯টার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য সেখানে উপস্থিত হয়ে শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করলে রাত সোয়া ১০টার দিকে অবরোধ প্রত্যাহার করা হয়। শিক্ষার্থীরা ওই শিক্ষকের অপসারণের জন্য পরদিন মঙ্গলবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত আলটিমেটাম দেন। পরদিন উপাচার্য স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে নূর-ই-আলমকে সাময়িক বহিষ্কার করে বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য তিনজন ছাত্র প্রতিনিধিসহ সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল।
এ বিষয়ে বহিষ্কৃত শিক্ষক নূর-ই-আলম দাবি করেন, তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়নি। মঙ্গলবার তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ২টা ৭ মিনিটে তাঁর কাছে প্রথম ই-মেইল আসে। এতে ১১টি অভিযোগ তুলে ধরে দুই ঘণ্টার মধ্যে অর্থাৎ বিকেল চারটার মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়। তিনি ফিরতি ই-মেইলে সময় আবেদন করলে কমিটি আজ সকাল ১০টা পর্যন্ত সময় দেয়। অথচ গতকাল বেলা ৩টা ২০ মিনিটেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে উপাচার্য তাঁর স্থায়ী বরখাস্তের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, তারা তাঁর বক্তব্য না শুনে বহিষ্কার করেছে। তিনি এই আদেশের বিরুদ্ধে আইনগতভাবে লড়বেন। তাঁর অভিযোগ, তাঁকে বহিষ্কারের বিষয়টি যথাযথ প্রক্রিয়ায় হয়নি।
জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. মকসুদুর রহমান বলেন, নূর-ই-আলমের বক্তব্য চেয়ে আজ সকাল ১০টা পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি বক্তব্য দেননি। তাই কমিটি সুপারিশ করেছে। তিনি বলেন, একটি বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় সময় বেশি দেওয়া যায়নি।
তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা না দেওয়ায় গতকাল বিকেলে আবার ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় উত্তেজিত শিক্ষার্থীদের থামাতে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য আনসার উদ্দিন হ্যান্ডমাইকে বক্তব্য দেন। তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলতে থাকেন, ‘শোনো, কমিটির যে সভাপতি সে আমাকে বলেছে যে তারা তাঁকে স্থায়ী বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আইনগত সমস্যার জন্য আমরা অফিশিয়ালি ঘোষণাটা কালকে (আজ শুক্রবার) দেব।’
শিক্ষার্থীরা লিখিত ঘোষণার দাবি করলে উপাচার্য তাঁদের বলেন, ‘এইটাই তোমরা ভিডিও করে রাখো। এইটাই অফিশিয়াল ঘোষণা। তাঁকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়েছে, এইটাই কমিটি আমাকে বলেছে। আইনগত কিছু জটিলতার জন্য আমাদের একটু সময় লাগবে। আমি ভিসি হিসেবে তোমাদের বলছি।’ এরপর শিক্ষার্থীরা ‘সন্তুষ্ট’ হয়ে সেখান থেকে চলে যান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ক্যাম্পাসে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তাতে শিক্ষকেরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তা না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ক্ষতি হতে পারত।’ তিনি দাবি করেন, ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ওঠা অধিকাংশ অভিযোগ সত্য।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য মো. আনসার উদ্দীন আজ বিকেলে বলেন, ‘আমরা মবের জন্য একটু তাড়াহুড়া করেছি। আমরা তাঁকে প্রথমে দিয়েছিলাম মাত্র দুই ঘণ্টা সময়। পরে তিনি আবার চিঠি দিয়েছেন যে “না, এত কম সময়ে আমি পারব না।” তারপর আমরা আজকে সকাল ১০টা পর্যন্ত সময় দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি বলেছেন, “আমার আরও সময় লাগবে।” আমরা লিখেছিলাম, সকাল ১০টার মধ্যে যদি আপনি জবাব না দেন, তাহলে আমরা একতরফাভাবে তদন্ত রিপোর্ট দেব। সেই হিসেবে তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দিয়েছে। উনি সময় চেয়েছিলেন। তবে সেই সময় আমরা দিতে পারিনি বাস্তবতার কারণে।’
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে হ্যান্ডমাইকে ঘোষণার বিষয়ে উপাচার্য বলেন, ‘ওইটা তো ওখানে তাৎক্ষণিক মবের জন্য দিতে হলো আরকি। আন-অফিশিয়ালি দেওয়া হয়েছিল। অফিশিয়ালি আজকে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ঠান্ডা করার জন্য আরকি।’
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন