হোঁচট খেয়ে এগোচ্ছে এনসিপি, নেতাদের অভিযোগ মিডিয়া ট্রায়াল
মহসীন কবির ঢাকা
তবে আগস্টের শুরু থেকে নানা কারণে দলটি বিতর্কের মুখে পড়েছে। বিশেষ করে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে একাধিক নেতার পদত্যাগ, চাঁদাবাজির অভিযোগ ও বহিষ্কার, জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠের দিন পাঁচ শীর্ষ নেতার কক্সবাজার ভ্রমণ ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সমাবেশে নেতাকর্মীদের কম উপস্থিতি—এসব বিষয় এনসিপিকে ইমেজ সংকটে ফেলেছে কিনা, রাজনৈতিক মহলে এমন প্রশ্ন উঠছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও হচ্ছে নানা আলোচনা।
জুলাইয়ের এক-দেড় মাস আগেও এনসিপিতে কমবেশি অস্থিরতা চলছিল বলে জানা যায়। তবে দেশব্যাপী জুলাই পদযাত্রায় মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ ইতিবাচক ভাবমূর্তি এনে দেয়। বিশেষ করে দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৯টিতেই তরুণ-তরুণীদের ব্যাপক উপস্থিতি যোগ করে নতুনমাত্রা। ৫টি জেলায় পদযাত্রা হয়নি (ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর)। কিন্তু আগস্টে এসে অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে এনসিপির কর্মকাণ্ড নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ।
জেলা পর্যায়ে পদত্যাগের ঘটনা
দলের অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে অভিযোগ এনে ও ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে কয়েকজন নেতা স্বেচ্ছায় করেন। এর মধ্যে গত ২ আগস্ট পদত্যাগ করেন শরীয়তপুর জেলা সমন্বয় কমিটির যুগ্ম সমন্বয়কারী তারিকুল ইসলাম ও সদস্য পলাশ খান।
গত ৭ আগস্ট পদত্যাগ করেন সিলেট জেলা সমন্বয়ক কমিটির যুগ্ম সমন্বয়কারী আবুল আহসান জাবুর। তিনি ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সিলেট নগরের বন্দরবাজার এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত সাংবাদিক এটি এম তুরাবের বড় ভাই।
পরদিন ৮ আগস্ট ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলা কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন ১ নম্বর যুগ্ম সমন্বয়কারী আরফান উদ্দিন মাসুদ। তিনি দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনেন।
সর্বশেষ ৯ আগস্ট মাদারীপুরের শিবচরের উপজেলা সমন্বয় কমিটি থেকে সংবাদ সম্মেলন করে একসঙ্গে পদত্যাগ করেন চার নেতা। তারা হলেন— উপজেলা যুগ্ম সমন্বয়কারী শাকিল খান, সদস্য মো. রিয়াজ রহমান, মহিউদ্দিন ও কাজী রফিক। তারাও ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে দল সরে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
এনসিপি থেকে পদত্যাগের এসব পরিসংখ্যান শুধু চলতি আগস্ট মাসের। এর বাইরে গত মাসেও একাধিক নেতা পদত্যাগ করেছেন। অনেকে বিষয়টিকে দলের জন্য অশনি-সংকেত হিসেবে দেখছেন।
চাঁদাবাজির অভিযোগে বহিষ্কার
এনসিপির নাম ভাঙিয়ে ইতোপূর্বে রাজধানীর বনানীসহ বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজিতে অভিযুক্ত কয়েকজনের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে দলটি। এরপর কিছু দিন চাঁদাবাজির বিষয়টি আড়ালে থাকলেও গত ৯ আগস্ট চট্টগ্রামের এক নেতার বিরুদ্ধে আবারও চাঁদাবাজির বড় অভিযোগ ওঠে। ওই নেতার নাম নিজাম উদ্দিন। তিনি এনসিপির নগর সমন্বয় কমিটির যুগ্ম সমন্বয়কারী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চাঁদাবাজি সংক্রান্ত তার একটি মন্তব্যের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে—যেখানে তিনি তার আরেক সহযোগীকে বলছেন—‘দেখো ওর কাছ থেকে আরও ৫ লাখ টাকা নিতে পারো কিনা।’ অভিযোগ আছে, চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক আন্দোলন দমাতে ওই নেতা কারও পক্ষ হয়ে চাঁদা চেয়েছিলেন। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচনা হয়।
সর্বশেষ ১১ আগস্ট দিবাগত রাত ২টায় অভিযুক্ত নেতা নিজাম উদ্দিনকে এনসিপি থেকে সাময়িক বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় কমিটি।
শীর্ষ নেতাদের কক্সবাজার ভ্রমণ নিয়ে গুজব
জুলাই গণঅভ্যুত্থান থেকে গড়ে ওঠায় শুরু থেকেই ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ দাবি করে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য রাখেন এনসিপির প্রায় সব নেতা। দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে ঘোষণাপত্র দিতে সরকারকে আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ৫ আগস্ট মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ থেকে ঘোষণা দেওয়ার কথা জানানো হয়। জুলাই আন্দোলনের অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে এনসিপি থেকে ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেন নাহিদ ইসলাম ও আখতার হোসেন।
তবে সেদিন দুপুরে গণমাধ্যমে খবর আসে— কক্সবাজারে একটি বিলাসবহুল হোটেলে বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে গোপন বৈঠকে বসছেন এনসিপির ৫ শীর্ষ নেতা। তারা হলেন দলের দক্ষিণাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, উত্তরাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ ও তার স্ত্রী সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা এবং মুখ্য সমন্বয়কারী নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। এ খবরে হোটেলের সামনেই স্থানীয় বিএনপির বিক্ষোভের মুখে পড়েন তারা।
দেশব্যাপী এ নিয়ে শুরু হয় নানা সমালোচনা। বিশেষ করে শেখ হাসিনার পতনের এক বছর ও জুলাই ঘোষণার দিনে তাদের সেখানে যাওয়াকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। যদিও পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি ছিল গুজব, যা পরে প্রমাণিত হয়।
শোকজ নোটিশ
কক্সবাজারকাণ্ডে ব্যাপক বিতর্কের মুখে পরদিন ৬ আগস্ট দলের পাঁচ শীর্ষ নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় এনসিপি। এতে বলা হয়, দলের রাজনৈতিক পর্ষদকে না জানিয়ে কক্সবাজার ভ্রমণে গিয়ে তারা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন। তাই আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্য সচিব আখতার হোসেনের কাছে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সশরীরে হাজির হয়ে এ বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে হবে। আলোচিত পাঁচ নেতা যথাসময়ে ব্যাখ্যা দেন।
তবে দলীয় শোকজ ও তার জবাব নিয়েও এক ধরনের বাহাসে জড়িয়ে পড়েন নেতারা। দল থেকে ভ্রমণের বিষয়টি কেন্দ্রকে অবহিত না করার কথা বলা হলেও অভিযুক্ত নেতারা বলেছেন, দলের হাইকমান্ডকে জানিয়েই তারা সেখানে গিয়েছেন।
শোকজের জবাবে দক্ষিণাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ অভিযোগ করেন— জুলাই ঘোষণাপত্রে জনপ্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি। তাই নীরব প্রতিবাদের অংশ হিসেবেই তারা কক্সবাজার গিয়েছেন। অথচ দলের পক্ষ থেকে মিডিয়া ট্রায়াল ও গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে কিছু না বলে আমাদের শোকজ নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
দলের এমন ভূমিকার কারণে একই সমালোচনা করেন মুখ্য সমন্বয়কারী নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। শোকজের জবাব পেলেও এ নিয়ে দলীয় ফোরাম থেকে এখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। নেতাদের এমন পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে দলে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে বলে জানা গেছে।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সমাবেশে কম উপস্থিতি নিয়ে সমালোচনা
জুলাই আন্দোলনের শেষ মুহূর্তে ২০২৪ সালের ৩ আগস্ট ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শেখ হাসিনার পতনের এক দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তৎকালীন আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। সেদিন শিক্ষার্থীদের ডাকে সেখানে ছুটে যান বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। সেই দিনটির বর্ষপূর্তিতে এবার ৩ আগস্ট একই স্থানে নতুন ‘বাংলাদেশের ইশতেহার’ নামে সমাবেশের আয়োজন করে এনসিপি। এতে সভাপতিত্ব করেন দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় নেতারা। সেখান থেকে ২৪ দফা ইশতেহার ঘোষণা করেন নাহিদ। তবে সমাবেশে উপস্থিতির সংখ্যা নিয়ে নানা ট্রলের শিকার হয় দলটি। কারণ, সারা দেশের নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণেও উপস্থিতি প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি বলে বিভিন্ন মহল থেকে কথা ওঠে। এ নিয়ে গণমাধ্যমগুলোতেও বিশেষ আলোচনা হয়। তবে এনসিপির নেতারা দাবি করেন, সরকারি-বেসরকারি অফিস ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দিনে কর্মসূচি হওয়ায় ঢাকার বাইরে থেকে অনেকেই আসতে পারেননি।
যা বলছেন বিশ্লেষক ও রাজনীতিবিদরা
সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাসুদ কামাল বলেন, ‘তরুণদের দল হিসেবে এনসিপির প্রতি আমি নিজেও আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু কতিপয় নেতার কর্মকাণ্ডে দলটির গ্রহণযোগ্যতা কিছুটা হলেও কমেছে। আমি মনে করি, এর জন্য সরকারও দায় এড়াতে পারে না। কারণ, শুরুতেই সরকার তাদের বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা দিয়েছে। এতে দলটির নেতারা কিছুটা স্বেচ্ছাচারী হয়েছেন। যা এখন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে গেছে। তারপরও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, এটা ভালো দিক। শহীদ মিনারে লোকসমাগম কম হওয়ার পেছনে ইমেজ সংকট কাজ করতে পারে।’ আর এই সময়ে কক্সবাজারে ভ্রমণ শীর্ষ নেতাদের অপরিপক্বতা বলে মনে করেন তিনি।
এনসিপি নেতাদের প্রতি পরামর্শ দিয়ে মাসুদ কামাল বলেন, 'তারা যে ‘কিংস পার্টি’ না, এটি তাদের নিজেদেরই প্রমাণ করতে হবে। আর দলকে সামনে নিয়ে যেতে অবশ্যই নিজেদের আচরণগত পরিবর্তন আনতে হবে।’
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)-এর সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটকে ধারণ করে তরুণদের রাজনৈতিক দল গঠনকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি। কারণ, তরুণরা রাজনীতিতে না আসলে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হবে। তারা একটি আদর্শ লালন করবে, আর আমরা আরেকটি করবো—এটি সমস্যা নয়। তবে এনসিপির মূল আদর্শ কী—তা আগে নির্ধারণ করতে হবে। তারা গঠনতন্ত্র করেছে কিনা, তা আমার জানা নেই। বিষয়টি তাদেরই পরিষ্কার করতে হবে। কারণ তাদের দলে ডান, বাম ও মধ্যমপন্থার তরুণরা যুক্ত হয়েছে।’
সাম্প্রতিক ঘটনায় দলটির কিছুটা ইমেজ সংকট হলেও তারা শুধরে উঠুক, এটা চাই। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সহনশীলতা ও দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।’
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘এনসিপিতে যুক্ত তরুণরা আওয়ামী লীগ ও ভারতবিদ্বেষ থেকে জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে। ফ্যাসিবাদের পতনে তারা সফলও হয়েছে। তবে আন্দোলন পরবর্তীকালে রাজনৈতিক দল গঠন করলেও তারা সেভাবে রাজনৈতিক সংগঠন হতে পারেনি। তাই মাঝে-মধ্যে তাদের নিয়ে বিতর্ক হয়। ইতোমধ্যে তারা ‘কিংস পার্টি’ হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে।’
‘তাই তাদের প্রতি আমার পরামর্শ—আগে রাজনীতি নিয়ে ভাবতে হবে। বর্তমানে রাজনীতির মূল দাবি কী তা নিজেরা অনুধাবন করতে হবে।’
সমালোচনাকে যেভাবে দেখছেন এনসিপি নেতারা
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, 'অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের তাগিদ থেকে আমরা দল গঠন করেছি। এতে বিভিন্ন পথ ও মতের লোকের সমন্বয় ঘটেছে। তাই অনেক সময় দুই-একজন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। এক্ষেত্রে হয়তো তাদের যাচাই-বাছাই করে দলে নেওয়া সম্ভব হয়নি। তারপরও যেকোনও অপকর্মের বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্স। টপ-টু বটম কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। কিছু নেতার পদত্যাগের বিষয়টি নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা হচ্ছে।’'
শীর্ষ নেতাদের সাম্প্রতিক কক্সবাজার ভ্রমণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘'সেখানে গোয়েন্দা সংস্থা ও কতিপয় মিডিয়া দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। এটি দুঃখজনক।'
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘নতুন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই এনসিপির যাত্রা। তবে শুরু থেকেই আমরা মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার। কক্সবাজার সফর নিয়েও আমাদের নেতাদের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালানো হয়েছে।’

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন