সবুজ হোসেন নওগাঁ

বাড়িতে ঢুকতে না পেরে ফটকের সামনে বসে আছেন বৃদ্ধা বিলকিস আক্তার। সোমবার বিকেলে শহরের কাজীর মোড় এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন  

নওগাঁ শহরে স্বামীর রেখে যাওয়া বাড়িতে বৃদ্ধাকে ঢুকতে দিচ্ছেন না তাঁর একমাত্র ছেলে। জমিসংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে মাকে হুমকি ভাবছেন তিনি। মা যাতে ঘরে ঢুকতে না পারেন, সে জন্য বাড়ির সিঁড়িতে লোহার ফটকে দিয়েছেন তালা। সেখানে বসে আছেন ওই বৃদ্ধা। কিন্তু মন গলছে না ছেলের। রাত আটটা ১৫ মিনিটের দিকেও ওই মা সেখানে বসেছিলেন।

ঘটনা ঘটেছে নওগাঁ শহরের কাজীর মোড় এলাকায়। ওই বৃদ্ধার নাম বিলকিস আক্তার (৬৮)। তাঁর এক ছেলে ও দুই মেয়ে। ছোট মেয়ে কানাডায় থাকেন। শহরের কাজীর মোড়ে বিলকিস আক্তারের স্বামী নিজের ১০ শতাংশ জমির ওপর প্রায় ৩০ বছর আগে দোতলা বাড়ি নির্মাণ করেন। ওই বাড়ির দোতলার একটি ফ্ল্যাটে তিনি বসবাস করে আসছিলেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২১ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর বসতবাড়ির জমি নিয়ে ছেলে মোস্তাফিজুল ইসলামের সঙ্গে মা বিলকিস আক্তারের বিরোধ সৃষ্টি হয়। স্বামীর মৃত্যুর পর আইন অনুযায়ী বিলকিস আক্তার ও তাঁর তিন সন্তান ওই বসতবাড়ির অংশীদার হন। কিন্তু মোস্তাফিজুল ইসলাম বসতবাড়ির পুরো সম্পত্তি দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু মা ও বোনেরা তাঁকে বসতবাড়ির জমি লিখে দিতে রাজি না হওয়ায় পারিবারিক বিরোধ দেখা দেয়। ছেলের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় বিলকিস আক্তার ২০২১ সাল থেকে অধিকাংশ সময় নওগাঁ শহরেই বড় মেয়ের বাড়িতে থাকছেন।

আজ সোমবার বেলা ১১টার দিকে নিজের বাড়িতে এসে দোতলার ফ্ল্যাটে ঢুকতে গিয়ে সিঁড়ির মুখে লোহার ফটকে তালা মারা দেখতে পান। তালা মারার বিষয়টি ছেলেকে মোস্তাফিজুলকে জানালে তিনি সাফ জানিয়ে দেন, মাকে বাড়িতে ঢুকতে না দেওয়ার জন্যই ফটকে তালা ঝুলিয়েছেন।

মাকে বাড়িতে ঢুকতে না দেওয়ার অভিযোগ স্বীকার করে ছেলে মোস্তাফিজুল ইসলাম জানান, বসতবাড়ি নিয়ে পারিবারিক কলহের জেরে মারামারি ও চাঁদাবাজির মামলা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাকে প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়েছিল। ওই ঘটনার পর মা স্বেচ্ছায় মেয়ের বাসায় বসবাস করে আসছেন। আদালতের নির্দেশে বড় বোনের জিম্মায় আছেন। এখন তিনি আমার জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই তাঁকে বাড়িতে ঢুকতে দিচ্ছি না। তিনি বাড়িতে থাকলে আবারও পারিবারিক কলহ ও মারামারি হতে পারে। তাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

বাড়িতে ঢুকতে না পেরে বাড়ির নিচতলায় দোতলায় ওঠার সিঁড়ির সামনে গ্যারেজে বসে রয়েছেন বিলকিস আক্তার। বিকেল পাঁচটার দিকে ওই বাড়িতে গিয়ে কথা হয় বিলকিস আক্তারের সঙ্গে। তিনি জানান, স্বামীর মৃত্যুর পর একমাত্র ছেলে তাঁর দেখাশোনা করেন না। বোনদের সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করেন। ছেলের কথা বসতবাড়ির আমার ও মেয়েদের অংশ তাঁকে লিখে দিতে হবে। কিন্তু তাঁকে জমি লিখে দিতে তাঁরা কেউ রাজি হননি। এটা নিয়ে বিরোধ শুরু।

বিলকিস আক্তার বলেন, ‘ছেলের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় স্বামীর মৃত্যুর পর বড় মেয়ের বাড়িতেই থাকি। মাঝেমধ্যে নিজের বাড়িতেও থাকি। আজ বেলা ১১টার দিকে ফ্ল্যাটে ঢুকতে গিয়ে দেখি, দোতলার সিঁড়িতে কাঁচি গেট লাগিয়েছে এবং তালা ঝোলানো। আমি ছেলেকে তালা খুলতে বললে সে আমাকে বলে, “তুই তো দুই আনার মালিক, তুই গিয়ে পাথারে গিয়ে থাক। এই বাড়িতে তোর জায়গা হবে না।” আমি আজ রোজা আছি। বেলা ১১টা থেকে বসে আছি। আমি আমার নিজের বাড়িতে ঢুকতে চাই। আমার বড় মেয়ে এসেছিল, তাকেও বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।’

স্বামীর স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়িতে জীবনের বাকিটা সময় কাটাতে চান উল্লেখ করে বিলকিস আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী এই বাড়ি করে আছেন। এটা আমার স্বামীর স্মৃতি। জীবনের বাকিটা সময় এই বাড়িতে কাটাতে চাই। এই বাড়িতে আমার মালিকানা কম বলে ছেলে এর আগেও কটাক্ষ করেছে। মেয়েরা আমার অপমান সইতে না পেরে তাদের অংশ আমাকে লিখে দিয়েছে। এই বাড়িতে কাগজে-কলমে আমার অংশই বেশি। কিন্তু আমার ছেলে পুরো সম্পত্তি হাত করার জন্য আমাকে বাড়িতে ঢুকতে দিতে চায় না।’

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় বিলকিস আক্তারের বড় মেয়ের স্বামী চিকিৎসক আবুজার গাফফারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার শ্যালক এর আগেও শাশুড়িকে নির্যাতন করেছে। এমনকি গায়ে হাতও তুলেছে। এটা নিয়ে মামলাও রয়েছে। আমার শ্যালকের মধ্যে মানবতা বলে কিছু নেই। নিজের মাকে বলে, 'তুই দুই আনার মালিক, তুই গিয়ে পাথারে থাক।” এই কথা শুনে ২০২৩ সালে আমার স্ত্রী ও শ্যালিকা বসতবাড়ির তাদের অংশের জমি মায়ের নামে লিখে দিয়েছে। কাগজে-কলমে আমার শ্বাশুড়ি এখন বসতবাড়ির প্রায় ৭০ শতাংশের মালিক। অথচ তাঁকেই এখন বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।’