প্রতিনিধি ময়মনসিংহ
![]() |
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাধাকানাই ইউনিয়নের রঘুনাথপুর দুগঙ্গা বাজারের পাশে লাঠিখেলার আয়োজন করে অনির্বাণ ছাত্র সংঘ। বৃহস্পতিবার বিকেলে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
লাঠির ঘূর্ণি, রামদার ঝলক, বাদ্যের তালে তালে লাঠিয়ালের শরীরী কসরত—একসময় গ্রামীণ জনপদের প্রাণ ছিল এই লাঠিখেলা। আধুনিকতার জোয়ারে সেই খেলাই আজ বিলুপ্তির পথে। তবে হারিয়ে যেতে বসা ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার প্রাণান্ত প্রয়াস দেখা গেল ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার রঘুনাথপুর গ্রামে। ‘অনির্বাণ ছাত্র সংঘ’ নামের একটি সংগঠনের এক যুগ পূর্তিতে আয়োজিত জমজমাট লাঠিখেলায় ফিরে এল সেই পুরোনো দিনের উত্তেজনা, গ্রামবাংলার রঙিন ছায়া আর ঐতিহ্যের শিকড়ের টান।
![]() |
লাঠিখেলায় শারীরিক কসরত দেখাচ্ছেন দুই লাঠিয়াল | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
বৃহস্পতিবার উপজেলার রাধাকানাই ইউনিয়নের রঘুনাথপুর দুগঙ্গাবাজারের পাশে আয়োজিত খেলায় সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক এ কে এম নজরুল ইসলাম। অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ তার ও টেলিফোন বোর্ডের অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী জয়নাল আবদীন। খেলার উদ্বোধন করেন রাধাকানাই ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আমিনুল এহসান।
বিকেল চারটায় লাঠিখেলা শুরুর কথা থাকলেও গরমের কারণে শুরু হয় সাড়ে পাঁচটায়। তার আগেই বিভিন্ন বাদ্য বাজাতে থাকে লাঠিয়াল দলের বাদক দল। গ্রামের নবীন-প্রবীণ সব বয়সের মানুষ জড়ো হন। আখালিয়া ও খিরু নদীর সংযোগস্থলে আয়োজিত লাঠিখেলা দেখতে ভিড় করেন নানা বয়সী মানুষ।
পলাশতলী গ্রামের কৃষক দেলোয়ার হোসেন আট বছর বয়সী ছেলে জোবায়ের হোসেনকে নিয়ে লাঠিখেলা দেখতে আসেন। দেলোয়ার বলেন, এক দশক আগেও গ্রামে নিয়মিত লাঠিখেলা হতো। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে হচ্ছে না। খেলা দেখতে গ্রামে মানুষের ঢল নামত। আজ লাঠিখেলা হওয়ায় ছেলেকে নিয়ে দেখতে এসেছেন। তাঁরা চান গ্রামীণ সংস্কৃতির এসব খেলা যেন না হারিয়ে যায়।
অনির্বাণ ছাত্র সংঘের সহসভাপতি আজিজুল হক বলেন, ‘আমাদের সংগঠনের এক যুগ পূর্তি উপলক্ষে ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলার আয়োজন করা হয়। খেলাটি এখন বিলুপ্তপ্রায়। বর্তমান প্রজন্ম মুঠোফোনে আসক্ত। নতুন প্রজন্মের কাছে লাঠিখেলার ঐতিহ্য তুলে ধরতে এই আয়োজন।’
লাঠিখেলায় অংশ নেয় রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়ন থেকে আসা আনুহাদি একতা যুব সংঘ লাঠিবাড়ি ক্লাবের লাঠিয়াল দল ও রঘুনাথপুর গ্রামের নূরুল ইসলামের দল। নূরুল ইসলামের দলের নেতা আয়নাল হক (৫৮) বলেন, লাঠিখেলাটি এখন বিলুপ্তির পথে। গ্রামীণ এই খেলা টিকিয়ে রাখা উচিত।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রায় দেড় শ বছর ধরে ফুলবাড়িয়ার বিভিন্ন গ্রামে লাঠিখেলা চলে আসছে। শীত মৌসুম থেকে শুরু হয়ে খেলা চলতে থাকত। এখনো ফুলবাড়িয়ার বিভিন্ন এলাকায় টুকটাক এ খেলার আয়োজন করা হয়। খেলার দিন রং-বেরঙের পোশাক পরে শারীরিক কসরত দেখিয়ে লাঠিয়ালরা দর্শকদের বিনোদন দেন। বাজনার তালে তালে চলে খেলা।
লাঠিখেলায় অংশ নেওয়া কয়েকজন জানান, লাঠিয়াল দলে একজন করে ওস্তাদ থাকেন। দলে সাধারণত ২৫ থেকে ৩০ জন লাঠিয়াল দরকার হয়। এখন খেলোয়াড় কমে যাওয়ায় ১০ থেকে ১৫ জনে খেলা হয়। মূলত ৯টি ধাপে খেলা হয়। প্রথম ধাপে দুজন খেলোয়াড় (এক গ্রুপ) আড়াই হাত লম্বা একটি করে লাঠি নিয়ে খেলেন। দ্বিতীয় ধাপে দুজন খেলোয়াড় একই মাপের পাঁচটি করে লাঠি নিয়ে খেলা দেখান। তৃতীয় ধাপে চারজন (দুই গ্রুপ) একটি করে লাঠি নিয়ে খেলা দেখান। চতুর্থ ধাপে চার থেকে সাড়ে চার হাত লম্বা লাঠি নিয়ে দুই গ্রুপের চারজনকে খেলতে হয়। পঞ্চম ধাপে প্রতি খেলোয়াড় দুই হাতে দুটি করে লাঠি নিয়ে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খেলা দেখান।
লাঠিখেলার বিশেষ আকর্ষণ থাকে ষষ্ঠ ধাপে; একজন খেলোয়াড় দুই হাতে দুটি রামদা নিয়ে এলোপাতাড়ি ঘোরাতে থাকবেন। একই লাঠিয়াল আরও একটি খেলা দেখান, যার নাম চরকা বানডি; যেখানে চারটি ধারালো চাকু কাঠির সাহায্যে বেঁধে একই ভঙ্গিমায় ঘোরাতে থাকেন। সর্বশেষ ধাপে সব লাঠিয়াল একত্র হয়ে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নৃত্যের মাধ্যমে যে যাঁর মতো করে খেলা প্রদর্শন করেন।
আনুহাদি একতা যুব সংঘের লাঠিবাড়ি ক্লাবের সদস্য মোহাম্মদ শাহজাহান (৬০) ২৫ বছর ধরে লাঠিখেলা দেখান। তিনি বলেন, গ্রামের বিয়ে, সুন্নতে খতনাসহ নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে এ খেলা হতো। শীতকালে খেলা বেশি হলেও ফসল ওঠার পর অবসর সময়েও গ্রামে খেলা হয়। এই খেলা দিন দিন কমে যাচ্ছে। নতুন করে খেলোয়াড় তৈরি হয় না। তাঁরা কোনোমতে টিকিয়ে রেখেছেন।
অনির্বাণ ছাত্র সংঘের সভাপতি খাইরুল ইসলাম বলেন, শুধু লাঠিখেলা নয়, হাঁড়িভাঙা ও বালিশ খেলার আয়োজন ছিল। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাটি সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের আগ্রহ কম। খেলার আগ্রহ বাড়াতে তাঁদের এই আয়োজন।