নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা
দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের আন্দোলনের কারণে সার্বিক আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম তথা ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে। এ অবস্থায় দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের উদ্দেশে ব্যবসায়ীরা বলেন, ‘আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। দেশের ব্যবসা বাঁচান। আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সমস্যার সমাধান করুন।’
এনবিআরের উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে দেশের শীর্ষস্থানীয় ১৪টি ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে যৌথভাবে আয়োজিত জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়। দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষস্থানীয় ১৪টি সংগঠনের সাবেক ও বর্তমান নেতারা এ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
অর্থনীতির লাইফলাইন হচ্ছে এনবিআর। অথচ এক মাসের বেশি এ প্রতিষ্ঠান অস্থিতিশীল থাকবে; এরপর একদল বলবে সব কাজ বন্ধ করে দিলাম। কোনো পরিস্থিতিতেই এটা মেনে নেওয়া যায় না।
সংবাদ সম্মেলনে সব সংগঠনের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কলমবিরতি ও শাটডাউন কর্মসূচির কারণে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা আমদানি করা কাঁচামাল সময়মতো খালাস করতে পারছেন না। ফলে রপ্তানির ‘লিড টাইম’ আরও বাড়ছে। ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন কার্যক্রম। এনবিআর সৃষ্ট এ জটিলতার কারণে কিছু বিদেশি ক্রেতা এরই মধ্যে রপ্তানি আদেশ বাতিলের হুমকি দিয়েছেন। পণ্য খালাসে বিলম্বের কারণে গুনতে হচ্ছে বাড়তি মাশুল। তাতে ব্যবসার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এ জন্য উদ্ভূত সমস্যা নিরসনে আর দেরি না করে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নেতৃত্বে অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ (বিডা) সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে দ্রুত আলোচনায় বসা উচিত।
সেই সঙ্গে দেশের অর্থনীতির স্বার্থে বিনা শর্তে কলমবিরতি ও শাটডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহারের জন্য আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিও আহ্বান জানানো হয়। ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, সমস্যার সমাধান করতে হবে আলোচনার মাধ্যমে। এভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও দেশের অর্থনীতির ক্ষতি করে দাবি আদায়কে ব্যবসায়ীরা সমর্থন করেন না।
এনবিআর সংস্কার হওয়া উচিত; এ বিষয়ে আমাদের পুরোপুরি সমর্থন রয়েছে। তবে প্রক্রিয়াটা কী হবে, তা নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটা সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান, বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, বাংলাদেশ বস্ত্রকল সমিতির (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর। এ সময় উপস্থিত ছিলেন মেট্রো চেম্বারের সভাপতি কামরান টি রহমান, সিরামিকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিসিএমইএর সভাপতি মঈনুল ইসলাম, বিটিএমএর সাবেক সভাপতি এ মতিন চৌধুরী, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, মেট্রো চেম্বারের সহসভাপতি ও ট্রান্সকম গ্রুপের গ্রুপ সিইও সিমিন রহমান, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান, নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান, তৈরি পোশাকশিল্পের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও মোড়ক পণ্য সরবরাহকারী কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএপিএমইএর সভাপতি মো. শাহরিয়ার প্রমুখ।
গত ১২ মে রাতে রাজস্ব খাত সংস্কারের অংশ হিসেবে এনবিআর ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগকে (আইআরডি) বিলুপ্ত করে নতুন দুটি বিভাগ চালুর প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। এর পর থেকে সরকারের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এরই অংশ হিসেবে নানা কর্মসূচিও পালন করছেন আন্দোলনকারীরা। গতকাল ‘মার্চ টু এনবিআর’ ও ‘শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন শুরু করেন আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এতে দেশজুড়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দেয়। এরই প্রতিবাদে ব্যবসায়ীরা জরুরি এ সংবাদ সম্মেলন করেন।
চেয়ারম্যানের অপসারণে ‘না’
সংবাদ সম্মেলনে ব্যবসায়ীরা জানান, একটি দক্ষ, হয়রানিমুক্ত এনবিআর গড়ার লক্ষ্যে সংস্থাটির সার্বিক সংস্কার ও আধুনিকায়নকে সমর্থন করেন তাঁরা। তবে সে ক্ষেত্রে এনবিআরের চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবি সমর্থন করেন না তাঁরা। ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, এনবিআরের চেয়ারম্যানকে অপসারণ কোনোভাবে কাম্য নয়। এটি কোনো ধরনের সফলতা নিয়ে আসবে না।
আইসিসি বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, অর্থনীতির লাইফলাইন হচ্ছে এনবিআর। অথচ এক মাসের বেশি এ প্রতিষ্ঠান অস্থিতিশীল থাকবে; এরপর একদল বলবে, সব কাজ বন্ধ করে দিলাম। কোনো পরিস্থিতিতে এটা মেনে নেওয়া যায় না। এনবিআরের কর্মকর্তারা কোনো ট্রেড ইউনিয়নের নেতা-নেত্রী নন। ফলে তাঁরা ট্রেড ইউনিয়নের মতো নোটিশ দিয়ে কর্মবিরতি পালন করতে পারেন না। শ্রমিক আন্দোলনের মতো তাঁরা অন্যদের আন্দোলনে যেতে উত্তেজিত করতে পারেন না; বরং সমস্যা সমাধানে আলাপ-আলোচনা ও দর–কষাকষিই হতে পারে একমাত্র বিকল্প।
সংকট সমাধানের তাগিদ দিয়ে মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, ‘আমরা এখানে সরকারের নীতিনির্ধারক কিংবা এনবিআরে যাঁরা আন্দোলন করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার জন্য আসিনি। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাচ্ছে। আমাদের আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেলে পুরো অর্থনীতি বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে ব্যবসা বাঁচাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ সমস্যার সমাধান জরুরি।’
অর্থ উপদেষ্টার সমালোচনা
গত বুধবার সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত ও অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, এনবিআরের সংস্কার প্রক্রিয়াকে ‘বাধাগ্রস্ত’ করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনের পেছনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কার কিছু সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীর ইন্ধন থাকতে পারে। গতকালের সংবাদ সম্মেলনে ব্যবসায়ী নেতাদের কাছে এ প্রসঙ্গে জানতে চান সাংবাদিকেরা।
জবাবে বিসিআইয়ের সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী বলেন, ‘এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে অর্থ উপদেষ্টা (এনবিআরের আন্দোলনের পেছনে ইন্ধনদাতা হিসেবে) ব্যবসায়ীদের দোষারোপ (ব্লেইম) করেছেন। যেখানে আমরা নানা সংকটের মধ্যেও ব্যবসা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি; সেখানে অর্থ উপদেষ্টার এ ধরনের বক্তব্য অত্যন্ত দুঃখজনক।’
বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘অর্থ উপদেষ্টা যদি বলে থাকেন যে আন্দোলনের পেছনে ব্যবসায়ীদের ইন্ধন রয়েছে—আমি মনে করি সেটি ভুল মন্তব্য। কারণ, আমরা ব্যবসায়ী সমাজ এখানে বসেছি সমাধানের পথ খোঁজার জন্য। যদি নির্দিষ্ট কোনো ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর প্রতি এ অভিযোগ থাকে, তাহলে তাঁকে (অর্থ উপদেষ্টা) তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে হবে।’
সভায় এনবিআরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ‘প্রকৃত ব্যবসায়ীরা সব সময় এনবিআর-কাস্টমসের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে ব্যবসা পরিচালনার চেষ্টা করেন। কারণ, বাস্তবতা হলো আমরা তাদের কাছে জিম্মি। আজকে যেটা আপনারা লক্ষ্য করছেন, এটা কিছুই নয়। এটা ক্ষমতা ও টাকাপয়সার বণ্টন নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে। মাঝপথে আমরা হচ্ছি বিপদগ্রস্ত। এরা সারা জীবন আমাদের জ্বালিয়েছে। এখন সরকারকে জ্বালাচ্ছে। সেই সঙ্গে পুরা জাতিকে জ্বালাবে।’
দ্রুত সমাধানের তাগিদ
এলএফএমইএবির সভাপতি ও অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘বিশ্বকে আমরা কী বার্তা দিচ্ছি, একটা দেশে পুরো কাস্টমস এভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আমার জানা মতে, পৃথিবীর কোনো দেশে এ রকম উদাহরণ নেই, একমাত্র যুদ্ধ পরিস্থিতি ছাড়া। সুতরাং এটা হতে পারে না। এটা একটা বড় বিপর্যয় আমাদের জন্য। এ জন্য আজকে ব্যবসায়ী নেতারা সম্মিলিতভাবে এখানে এসেছি। এটা আমাদের অস্তিত্বের (সারভাইভালের) প্রশ্ন।’
নাসিম মঞ্জুর আরও বলেন, ‘এনবিআর সংস্কার হওয়া উচিত; এ বিষয়ে আমাদের পুরোপুরি সমর্থন রয়েছে। তবে প্রক্রিয়াটা কী হবে, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটা সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। কোনো পূর্বশর্ত ছাড়া সব পক্ষকে আলোচনায় বসতে হবে, কথা শুনতে হবে, কিছু ছাড় দিতে হবে।’
বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘আমরা কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে এখানে আসিনি। এটা আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। আমরা চাই সমস্যার সমাধান। সরকার এটার গুরুত্ব হয়তো সঠিকভাবে বুঝছে না। কারণ, সরকার আগামী মঙ্গলবার এ বিষয়ে সভা ডেকেছে। কিন্তু সরকারের উচিত আজকেই সভার জন্য সব পক্ষকে নিয়ে বসা।’
বাংলাদেশ চেম্বারের সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী বলেন, সরকার ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে যোগাযোগের দূরত্ব রয়েছে। এনবিআরের কর্মকর্তারাও চান সংস্কার হোক। তাঁদেরও নিশ্চয়ই কিছু যৌক্তিক দাবি আছে। সরকারের সেগুলো যথাযথভাবে শুনতে হবে; কিন্তু কাজ বন্ধ রাখা যাবে না।