আবদুস সাত্তার আইনী

পৃথিবীর সব ধর্মেই অতিথি বা মেহমানের সমাদর, যত্নআত্তি ও আপ্যায়ন করার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কেবল ধর্মীয় নির্দেশ মেনে পুণ্য অর্জনের জন্য নয়, মানবিক কারণেও মানুষ অতিথিসেবা ও মেহমানের আপ্যায়ন করে থাকেন। অতিথি বলতে কেবল আত্মীয়স্বজন বোঝায় না, বরং মুসাফির ও আগন্তুকেরাও সংশ্লিষ্ট এলাকার অতিথি। আতিথেয়তার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য হাজার বছরের পুরোনো। প্রাচীন গ্রিক সভ্যতায় অতিথির প্রয়োজন পূরণ এবং তাঁকে সেবাদান করা ঐশ্বরিক বিধান হিসেবে পালিত হতো।

মুসলমানদের ধর্মপিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.) মেহমান ব্যতীত কখনো খাবার গ্রহণ করতেন না। মেহমান না থাকলে তিনি কোনো দরিদ্র মানুষকে নিয়ে আসতেন এবং তাঁকে আপ্যায়ন করাতেন। প্রাচীন ভারতে অতিথিকে দেবতা জ্ঞান করা হতো এবং বর্তমানেও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে অতিথি ব্যক্তি দেবতা হিসেবে বিবেচিত হন। এস্কিমো জাতিগুলোর মধ্যে অতিথিসেবার জন্য অদ্ভুত এক প্রথা প্রচলিত আছে—তারা অতিথিকে সেবাদানের জন্য ঘরের নারীকেও পরিবেশন করে। আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে মুসাফির ও আগন্তুককে অতিথি হিসেবে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা পর্যন্ত হয়ে থাকে।

এখানে বিভিন্ন ধর্ম ও জাতির আতিথেয়তা সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো।

মুসলমানদের ধর্মপিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.) মেহমান ব্যতীত কখনো খাবার গ্রহণ করতেন না। মেহমান না থাকলে তিনি কোনো দরিদ্র মানুষকে নিয়ে আসতেন এবং তাঁকে আপ্যায়ন করাতেন।

ইসলাম

ইসলামে আতিথেয়তার গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি এবং বলা যায় তা আবশ্যক। এটি সর্বোত্তম চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ও সব নবীর সুন্নত। পবিত্র কোরআনে অতিথির সম্মান ও সেবা সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, ‘তারা আমার মেহমান, তাদের অসম্মান করো না। (সুরা হিজর: ৬৮) তারা বলল, সালাম, তিনিও বললেন, সালাম। তিনি অবিলম্বে এক কাবাবকৃত গোবৎস পরিবেশন করলেন।’ (সুরা হুদ: ৬৯)

রাসুল (সা.)-এর অতিথিপরায়ণতা সর্বজনবিদিত। তিনি বলেন, ‘কেউ যদি আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস পোষণ করে থাকে, সে যেন তার মেহমানের সম্মান করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬০১৮) অর্থাৎ মেহমানের সম্মান করা ইমানের অংশ। অন্য একটি হাদিসে তিনি বলেন, ‘মেহমানের পুরস্কার এক দিন ও এক রাত। অতিথি আপ্যায়ন হলো তিন দিন; এর বেশি হলে তা হবে সদকা।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৪৬১০) এই হাদিসের দ্বারা মেহমানদারির নির্দিষ্ট সময়সীমা বোঝা যায়। অন্য হাদিসে আছে, ‘তোমার ওপর তোমার মেহমানদের রয়েছে অধিকার।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,১৩৪; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,১৫৯) ইসলামী উক্তি

📖 ইসলামী উক্তি
‘মেহমানকে সম্মান করার অর্থ হলো, হাসিখুশি চেহারায় সুন্দরভাবে তাঁর সঙ্গে কথা বলা, দরিদ্রভাব প্রকাশ না করা এবং নিজ হাতে আপ্যায়ন করা।’
- আল্লামা ইবনে হিব্বান (রহ.), রাওযাতুল উকালা ও নুযহাতুল ফুযালা, পৃ. ২৬১
 

আল্লামা ইবনে হিব্বান (রহ.) বলেন, ‘মেহমানকে সম্মান করার অর্থ হলো, হাসিখুশি চেহারায় সুন্দরভাবে তাঁর সঙ্গে কথা বলা, দরিদ্রভাব প্রকাশ না করা এবং নিজ হাতে আপ্যায়ন করা।’ (রাওযাতুল উকালা ও নুযহাতুল ফুযালা, পৃ. ২৬১)

তাই মেহমানের উচিত মেজবানের জন্য এই কথা বলে দোয়া করা, ‘হে আল্লাহ, যিনি আমার খাবারের ব্যবস্থা করেছেন, তুমি তার খাবারের ব্যবস্থা করো। আর যিনি আমাকে পান করালেন, তুমি তাকে পান করাও।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,০৫৫)

মুসলিম জাতি, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানগণ বেশ গুরুত্বের সঙ্গে অতিথি আপ্যায়ন করে থাকেন। বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে ঈদ, বিয়ে ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে ব্যাপকভাবে অতিথি আপ্যায়নের রীতি রয়েছে।

ধর্মগ্রন্থ বেদে এটাও বলা আছে যে শত্রুও যদি অতিথি হিসেবে আসে, তাহলে তাঁকেও সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। যাতে তিনি শত্রুতা ভুলে যান।

সনাতন ধর্ম

সনাতন (হিন্দু) ধর্মের ধর্মগ্রন্থ বেদে উল্লেখ আছে যে অতিথি দেবতুল্য। তাই সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ অতিথিকে দেবতা মনে করেন এবং তাঁকে যথার্থ সম্মান করেন। অতিথি ও আগন্তুককে আপ্যায়ন করা এবং রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা করা হিন্দু ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সন্ন্যাসী, ব্রাহ্মণ ও সম্মানিত ব্যক্তিবর্গকে অতিথিসেবা প্রদান করা প্রায় আবশ্যক বিষয়। গৃহকর্তা ধনী হোক আর দরিদ্র হোক, অতিথির জন্য তিনটি জিনিসের ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে—খাবার (এমনকি এক গ্লাস জল হলেও), বসার জায়গা এবং সুন্দরভাবে কথা বলা।

অতিথিকে ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করা তাঁদের সংস্কৃতি এবং এটা সম্মান ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। তাঁরা অতিথিকে বিনয়ের সঙ্গে চমৎকার পাত্রে খাবার পরিবেশন করেন। পূজা ও বিয়েতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীগণ ব্যাপকভাবে অতিথি আপ্যায়ন করেন থাকেন। ধর্মগ্রন্থ বেদে এটাও বলা আছে যে শত্রুও যদি অতিথি হিসেবে আসে, তাহলে তাঁকেও সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। যাতে তিনি শত্রুতা ভুলে যান। ‘অতিথি হলেন দেবতা’ এটি বর্তমানে ভারতের পর্যটন মন্ত্রণায়ের স্লোগান।

খ্রিষ্টান-অধ্যুষিত কোনো কোনো অঞ্চলে প্রতিটি বাড়িতে প্রতি মাসে একবার অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা এবং সব প্রতিবেশীকে এতে নিমন্ত্রণ করা হয়।

খ্রিষ্টধর্ম

ম্যাথু রচিত বাইবেলে বলা হয়েছে, যিশু ঈসা (আ.) তাঁর শিষ্যদের বাইরে পাঠানোর সময় তাঁদের নির্দেশ দিলেন, যতক্ষণ তাঁরা শহরে থাকবেন, একজন ভালো মানুষের সন্ধান করে তাঁর বাড়িতে অবস্থান করবেন এবং কারও কাছ থেকে সোনা বা রুপা গ্রহণ করবে না (ম্যাথু, ১০:১০-১৩০। যিশুখ্রিষ্টের শিষ্যগণকে অতিথিসেবা প্রদান এবং তাঁদের আপ্যায়ন করা ছিল তৎকালীন যুগের আবশ্যক রীতি। বাইবেলের শিক্ষা অনুসারে, আগন্তুক ও মুসাফিরকে অতিথি হিসেবে গ্রহণ করা খ্রিষ্টানদের আতিথেয়তার প্রধান অনুষঙ্গ।

পিটার রচিত বাইবেলে বলা হয়েছে, ‘আমরা প্রত্যেকে একে অপরকে ভালোবাসব, কারণ, আমরা ভালোবাসার ওপর টিকে আছি। ভালোবাসার অর্থ হলো অন্নহীনকে অন্নদান এবং গৃহহীনকে গৃহদান’ (পিটার, ৪:৮-১০)। খ্রিষ্টান-অধ্যুষিত কোনো কোনো অঞ্চলে প্রতিটি বাড়িতে প্রতি মাসে একবার অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা এবং সব প্রতিবেশীকে এতে নিমন্ত্রণ করা হয়। ধর্মীয় গুরু, প্রবীণ ও সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের সম্মানে তাঁরা ভোজের আয়োজন করে থাকেন। অতিথিকে আনন্দিত ও খুশি রাখা, তিনি যেন কোনোভাবে কষ্ট না পান, সে ব্যাপারে খেয়াল রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

ইহুদি ধর্মগুরু র‍্যাবাইদের জারি করা বিধান হলো, ‘কোনো ইহুদি যেন একথা বলতে না পারেন আমি জেরুজালেমে রাতযাপনের জায়গা পাইনি।’

ইহুদি ধর্ম

ইহুদি ধর্মে অতিথিকে সম্মান প্রদর্শন এবং আগন্তুককে অতিথি হিসেবে গ্রহণ করতে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ‘হাসিখুশি চেহারায় অতিথিকে অভ্যর্থনা জানাতে হবে’, এটাই হলো তাঁদের ধর্মগ্রন্থ তালমুদের শিক্ষা। কেউ যদি জানতে পারেন যে কোথাও কোনো গৃহহীন ক্ষুধার্ত ব্যক্তি আছেন, তবে তাঁকে আশ্রয় দেওয়া এবং আপ্যায়ন করার ব্যাপারে ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

সাধারণ অতিথিদের কেবল আপ্যায়ন করিয়ে সন্তুষ্ট করলেই হবে না, বরং তাঁদেরকে সঙ্গ ও সময় দিতে হবে। ইহুদি ধর্মগুরু র‍্যাবাইদের জারি করা বিধান হলো, ‘কোনো ইহুদি যেন একথা বলতে না পারেন আমি জেরুজালেমে রাতযাপনের জায়গা পাইনি।’ ইহুদিদের অতিথিপরায়ণতা অবশ্য নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

ধর্মমত ও জাতিসত্তার বাইরে এসেও এ কথা উচ্চারণ করা যায় যে আতিথেয়তা ও অতিথিপরায়ণতা একটি সর্বোত্তম মানবিক গুণ, যা অন্য গুণাবলিকেও বিকশিত করে।