নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা
![]() |
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে করমর্দন করছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গতকাল লন্ডনের হোটেল ডরচেস্টারে | ছবি: প্রেস উইংয়ের কাছ থেকে পাওয়া |
লন্ডনে বহুল প্রতীক্ষিত বৈঠকে বসলেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান; খবর এল তাদের খোলামনে আলোচনার। উভয়পক্ষই অনড় অবস্থান থেকে সরলেন, ভোটের সময় নিয়ে পৌঁছালেন একই বিন্দুতে।
ভোটের পথনকশার দাবিতে কিছু দিন থেকে বিএনপি নেতাদের উত্তাপ ছড়ানো কথাবার্তা এখন অতীত হয়ে গেল বলে মনে করা হচ্ছে। দেড় ঘণ্টার এ বৈঠকের মাধ্যমে দেশের রাজনীতিকে নতুন উত্তাপের আঁচ থেকে দূরে সরিয়ে আনলেন তারা।
দুই নেতা একমত হলেন, ‘সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রোজা শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও’ অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে।
এই বৈঠকে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে বিএনপির গত কয়েক মাসের বাড়তে থাকা বিরোধ মিটমাট হয়ে যাওয়ায় অনিশ্চয়তা কাটল বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
আগেভাগে ভোটের দাবিতে সরব থাকা বেশ কয়েকটি দলও এ সিদ্ধান্তকে খুশি মনে স্বাগত জানিয়েছে। তাদের আশা নির্বাচনের সময়কে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে যে উত্তেজনার আঁচ বাড়তে শুরু করেছিল তা এখন কেটে যাবে।
এতদিন ধরে আপাত দৃষ্টিতে অনড় অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপি লন্ডনের এ বৈঠকের পর সন্তুষ্টির সুরে বলেছে। সরকারের যে উপদেষ্টার পদত্যাগের জোরালো দাবি তুলেছিল বিএনপি সেই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানকে পাশে নিয়েই এ সন্তুষ্টির কথা বলেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। উপদেষ্টা খলিলও বলেছেন, সবাই একমত হয়েছে বলেই যৌথ ঘোষণা এসেছে।
তবে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এ বৈঠক নিয়ে তাদের অসন্তুষ্টির কথা প্রকাশ করেছে। এ সিদ্ধান্তের পর দলটি অভিযোগ করেছে, 'সরকার একটি দলের দাবিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে।'
অপরদিকে একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষকের দৃষ্টিতে এ বৈঠক বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ‘অনুপস্থিত’ একটি ধারায় পরিবর্তনের হাওয়া লাগল। তার মতে, সংলাপের মাধ্যমে সঙ্কট সমাধানে নতুন বার্তা দেবে এটি।
তবে সংস্কার কার্যক্রমের চলমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের সম্ভাব্য এ সময় নিয়ে চ্যালেঞ্জের কথাও বলেছেন একজন বিশ্লেষক। তার মতে, নির্বাচন ব্যবস্থার অত্যাবশ্যকীয় সংস্কারের মাধ্যমে জুলাই সনদের পাঁচ মাসের মাথায় নির্বাচন আয়োজন সহজ হবে না।
স্বাধীনতার পর দেশের ১২টি জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে এর আগে ফেব্রুয়ারিতে ভোট হয়েছে তিনটি। এরমধ্যে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন হয় ২৮ ফেব্রুয়ারি (১৯৭৯), পঞ্চম সংসদ নির্বাচন ২৭ ফেব্রুয়ারি (১৯৯১) এবং ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন হয় ১৫ ফেব্রুয়ারিতে (১৯৯৬)। এ তিনটি নির্বাচনেই জয়ী হয বিএনপি। এর বাইরে ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপি সরকার গঠন করেছিল।
ক্রমিক নং | জাতীয় সংসদ নির্বাচন | তফসিল ঘোষণার তারিখ | ভোটগ্রহণের তারিখ | পার্থক্য (দিন) |
---|---|---|---|---|
১ | প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-১৯৭৩ | ০৭-০১-১৯৭৩ | ০৭-০৩-১৯৭৩ | ৬০ |
২ | দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন-১৯৭৯ | ০১-১২-১৯৭৮ ২৭-১২-১৯৭৮ | ১৮-০২-১৯৭৯ | ৫৪ |
৩ | তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন-১৯৮৬ | ০২-০৩-১৯৮৬ ২২-০৩-১৯৮৬ | ০৭-০৫-১৯৮৬ | ৪৭ |
৪ | চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন-১৯৮৮ | ২৬-০২-১৯৮৮ | ০৩-০৩-১৯৮৮ | ৬ |
৫ | পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-১৯৯১ | ০৫-১২-১৯৯০ ০৭-০১-১৯৯১ | ২৭-০২-১৯৯১ | ৫২ |
৬ | ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন-১৯৯৬ | ০২-১২-১৯৯৫ ০৯-১২-১৯৯৫ ৩০-১২-১৯৯৫ ০৭-০১-১৯৯৬ | ১৫-০২-১৯৯৬ | ৩৯ |
৭ | সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-১৯৯৬ | ২৭-০৪-১৯৯৬ | ১২-০৬-১৯৯৬ | ৪৭ |
৮ | অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-২০০১ | ০১-০৮-২০০১ | ০১-১০-২০০১ | ৬২ |
৯ | নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-২০০৮ | ০২-১১-২০০৮ ২৩-১১-২০০৮ ২৪-১১-২০০৮ | ২৯-১২-২০০৮ | ৩৭ |
১০ | দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-২০১৪ | ০৫-১১-২০১৩ | ০৫-০১-২০১৪ | ৬২ |
১১ | একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন-২০১৮ | ০৮-১১-২০১৮ | ৩০-১২-২০১৮ | ৪৮ |
১২ | দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন-২০২৪ | ১৮-১১-২০২৩ | ০৭-০১-২০২৪ | ৫২ |
এতদিন ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে, অর্থাৎ জুনের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের কথা বলে আসছিল ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দায়িত্বে আসা অন্তর্বর্তী সরকার।
সরকারপ্রধান ইউনূসসহ উপদেষ্টাদের নানা বক্তব্যে আশ্বস্ত না হয়ে নির্বাচনের পথনকশা (রোডম্যাপ) চাওয়ার পাশাপাশি চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ভোটের দাবি জানিয়েছিল বিএনপি।
ভোটের তারিখ নিয়ে বিরোধের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারবিরোধী অবস্থান প্রকাশ করে আসছিল বিএনপি; মাঠের শক্তিও দেখাচ্ছিল বিভিন্নভাবে।
এর মধ্যে কোরবানি ঈদের আগের দিন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনের সময়সীমা কিছুটা এগিয়ে আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের সময় ঘোষণা করেন প্রধান উপদেষ্টা।
জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) বিভিন্ন দল তার এই বক্তব্যকে স্বাগত জানালেও বিএনপি আগের অবস্থানেই অনড় থাকে। তাদের দাবি ছিল চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের।
আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চে রোজার মধ্যে নির্বাচনি প্রচার এবং পরে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষাকে এপ্রিলে নির্বাচন হওয়ার পথে বাধা বলে তুলে ধরেন দলটির নেতারা।
মাঠে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে এমন প্রেক্ষাপটে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে বিরোধপূর্ণ অবস্থার কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার এবং জুলাই হত্যাযজ্ঞের বিচারিক কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছিলেন বিশ্লেষকরা।
এমন অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে শুক্রবার লন্ডনে দুই নেতার বৈঠককে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে ভাবা হচ্ছিল; বৈঠককে ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হতে পারে আভাস দিয়েছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে নির্বাচন এগিয়ে আসার সিদ্ধান্ত হওয়ার পর বিফ্রিংয়ে বৈঠকটিকে ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে আখ্যা দেন তিনি।
সংলাপে সমাধান, ‘রাজনীতিতে নতুন বার্তা’
লন্ডনে অনুষ্ঠিত ইউনূস-তারেক বৈঠকের মধ্য দিয়ে, সরকার ও বিএনপির মধ্যে বিদ্যমান মতবিরোধ অনেকটাই কমে এসেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান মনে করেন, এই বৈঠকের মাধ্যমে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো। তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের ধারা খুব একটা দেখা যায় না, সেখানে এই বৈঠক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'সরকার ও বিএনপি উভয়েই নতুন ধরনের রাজনীতির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ, এটা বোঝা গেছে আলোচনার ধরন থেকে। উভয় পক্ষ হাসিমুখে আলোচনা শুরু করেছে, শেষও করেছে হাসিমুখেই। পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ ছিল চোখে পড়ার মতো, যা প্রমাণ করে আলোচনা সফল হয়েছে এবং জাতির কাছে একটি ইতিবাচক বার্তা পৌঁছেছে।'
অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান মনে করেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হলো—নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে বিএনপির প্রস্তাবের দিকে সরকার কিছুটা আগ্রহ দেখিয়েছে। দুই পক্ষই তাদের আগের অনমনীয় অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছে।
তিনি বলেন, 'এই সরকারের আসল দায়িত্ব হলো একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা, যাতে গণতান্ত্রিক উত্তরণ সম্ভব হয়। দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার প্রয়োজন নেই তাদের।'
সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে তিনি বলেন, 'সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, যেখানে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের সামনে স্পষ্টভাবে জানাতে হবে—তারা কোন কোন বিষয়ে একমত হয়েছেন। পরবর্তী নির্বাচিত সরকার এসব বাস্তবায়ন করবে।' তিনি আরও বলেন, 'এবার এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কর্তৃত্ববাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি না ঘটে।'
বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'যদি কিছু বিচারের উদ্যোগ নেওয়া যায়, সেটা হবে ইতিবাচক। যদিও সব প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব নাও হতে পারে, তবুও বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।'
এদিকে নির্বাচন নিয়ে চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরেছেন নির্বাচন বিশ্লেষক এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলীম।
তিনি বলেন, 'জুলাই সনদের পাঁচ মাস পার না হতেই, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে।' জুলাইয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে সংস্কারের একটি সুপারিশনামা আসবে বলেও জানান তিনি।
আব্দুল আলীম বলেন, 'নির্বাচন কমিশনের জন্য সময়টি সংকুচিত হলেও অদম্য নয়। সরকার ও ইসি যদি অধ্যাদেশ আকারে দ্রুত সংস্কার কার্যক্রম শুরু করে, তাহলে কাজটি সম্ভব হবে। তবে এজন্য তাদের 'প্রো-অ্যাকটিভ' ভূমিকা নিতে হবে।'
তিনি সতর্ক করে বলেন, 'ইসি পুনর্গঠনের দাবি থেকে যদি জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (এনসিপি) সরে না আসে, তবে নতুন করে জটিলতা তৈরি হতে পারে।'
ভোটের তারিখ সামনে রেখে যেসব বিষয় চূড়ান্ত করা দরকার, তার মধ্যে রয়েছে—হালনাগাদ ভোটার তালিকা, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, সীমানা নির্ধারণ, পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যমের আচরণবিধি, ভোটকেন্দ্রের তালিকা, প্রবাসী ভোটারদের জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতি এবং একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ।
তার মতে, অতীতের মতো এবারও নির্বাচন গ্রহণযোগ্য, অবাধ ও সুষ্ঠু হবে—এই প্রত্যাশাই এখন প্রধান বিষয়।
বৈঠকে যা হল
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা এ বৈঠক বাংলাদেশ সময় শুক্রবার বেলা ২টায় পার্ক লেইনে ডরচেস্টার হোটেলে শুরু হয়। সফরকালে এ হোটেলে থাকছেন মুহাম্মদ ইউনূস।
প্রধান উপদেষ্টার যুক্তরাজ্য সফরের সূচি ঘোষণার পর থেকেই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের মধ্যে দেখা হওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা বাড়তে থাকে। বৈঠক শেষে ৩টা ৪০ মিনিটে হোটেল ত্যাগ করেন তারেক রহমান।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, রুদ্ধদ্বার বৈঠকে তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশে বলেন, তিনি তার রাজনৈতিক জীবনে একজন নতুন অভিভাবক পেয়েছেন। তিনি বলেন, যদি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে দেশ পরিচালনার সুযোগ পান, তাহলে তিনি তার মা খালেদা জিয়া এবং ড. ইউনূসের পরামর্শ অনুসরণ করে পথ চলবেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, 'বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ভবিষ্যতেও মুহাম্মদ ইউনূসের বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতাকে দেশের কল্যাণে কাজে লাগাতে চান। তারেক বলেন, ‘স্যার, আমরা চাই আপনি সবসময় আমাদের পাশে থাকুন। অনুগ্রহ করে কখনও আমাদের ছেড়ে যাবেন না’।'
এসময় প্রধান উপদেষ্টা তারেকের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। তিনি দেশ নিয়ে তারেকের চিন্তাভাবনা সবাইকে মুগ্ধ করেছে বলেও তুলে ধরেন।
এরপর বিভিন্ন বিষয়ে নিয়ে আলোচনার পর নির্বাচন বিষয়ে তারেক রহমান একটি প্রস্তাব দেন। তা পর্যালোচনা করে প্রধান উপদেষ্টা তার মত দেন, যা পরে যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত হয় বলে ওই কর্মকর্তা জানান।
বৈঠকে তারা ভোটের সম্ভাব্য দিনক্ষণ নিয়েও কথা বলেন। তবে তা ঘোষণার বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের একক এখতিয়ার হওয়ায় তা তাদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়।
বিএনপি নেতা তারেকের সঙ্গে লন্ডনে দেড় ঘণ্টাব্যাপী প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের এ বৈঠক হয়। প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠকের পর একান্তেও কথা বলেন তারা।
বৈঠক শেষে ৩টা ৪০ মিনিটে হোটেল ত্যাগ করেন তারেক। তিনি গাড়িতে ওঠার আগে হোটেলের সামনের সড়কে দাঁড়িয়ে থাকা নেতাকর্মীদের হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান।
বৈঠক শেষে যৌথ ব্রিফিং করেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
প্রথমে ইউনূস ও তারেকের যৌথ ঘোষণা পড়ে শোনান খলিলুর। এরপর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন তারা।
রোজা শুরুর আগে ভোট
যৌথ ঘোষণায় বলা হয়, ‘অত্যন্ত সৌহার্দ্যমূলক’ পরিবেশে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার কাছে আগামী বছরের রোজার আগে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব করেন। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও মনে করেন ওই সময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভালো হয়।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন যে তিনি আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।
তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার এই অবস্থানকে স্বাগত জানিয়েছেন তুলে ধরে বিফ্রিংয়ে খলিল বলেন, 'এবং দলের পক্ষ থেকে তাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। প্রধান উপদেষ্টাও জনাব তারেক রহমানকে ফলপ্রসূ আলোচনার জন্য ধন্যবাদ জানান।'
চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি রোজা শুরু হতে পারে। সে হিসাবে এ বৈঠকের পর ‘সংস্কার ও বিচারসহ’ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নির্বাচনের সব প্রস্তুতি শেষ হলে এর সপ্তাহ খানেক আগে ভোটের তারিখ ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন দেবে ভোটের তারিখ
বিফ্রিংয়ে ভোটের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণার বিষয়ে নির্বাচন কমিশন শিগগির তা ঘোষণা করবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, 'আজকে যৌথ বিবৃতিতে বলে দিয়েছি দুপক্ষই। নির্বাচন কমিশন আশা করি শিগগির একটা তারিখ ঘোষণা করবে। এপ্রিলের বদলে নির্বাচন এগিয়ে ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় এ ঘোষণায় আপনারা সন্তুষ্ট কি না এমন প্রশ্নের জবাবে এ বৈঠক নিয়ে খলিলুর ও খসরু ‘নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট’ বলে মন্তব্য করেন।
খসরু বলেন, 'আমরা তো বলছি, নির্বাচনের আগে নয় শুধু, নির্বাচনের পরেও দেশ গড়ার কাজে সবাই একক সাথে কাজ করতে হবে।'
খলিল বলেন, 'সন্তুষ্ট না হলে যৌথ ঘোষণায় আসার কথা নয় আমাদের।'
ব্রিফিংয়ে সংস্কার এগিয়ে নেওয়া, অভ্যুত্থানের সময়কার হত্যাকাণ্ডসহ চলমান বিচার কাজ, জাতীয় সনদে বিএনপির সই করাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়েও বৈঠকে তাদের মধ্যে ফলপ্রসু আলোচনা হওয়ার কথা তুলে ধরেন তারা দুজন।
কী বলছে দলগুলো
ইউনূস-তারেক বৈঠক নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এমন আলোচনা ও ঐকমত্যের সূচনাকে স্বাগত জানিয়ে সংস্কার ও বিচারের দৃশ্যমান অগ্রগতিতে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে তারা।
এ বৈঠকের পর নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কেটেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল।
বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, 'এই বৈঠকে আগামী রমজানের আগেই জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে যে ফলপ্রসূ ঐকমত্য হয়েছে, তা অনিশ্চয়তা কাটিয়ে দেশের মানুষের জন্য এনেছে স্বস্তির বার্তা, নতুন আশার আলো।'
ফখরুল বলেন, 'পুরো বাংলাদেশের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সংযোগ ঘটিয়ে, এপ্রিলের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত সময় থেকে সরে এসে নির্বাচনের জন্য একটি যৌক্তিক সময়সীমা নির্ধারণের জন্য প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ। তিনি জনগণের প্রত্যাশা উপলব্ধি করে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন- যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য।'
তবে শুধু একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার ‘সুযোগ নেই’ বলে মনে করছে জুলাই অভ্যুত্থানের নেতাদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এনসিপি।
জনপ্রত্যাশা ছাপিয়ে বিদেশের মাটিতে নির্বাচন নিয়ে ব্ঠৈক করে দেশকে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী।
এমন সিদ্ধান্তকে গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্খার সঙ্গে ’প্রতারণার সামিল’ বলেও অভিযোগ তার। প্রয়োজনে ‘নতুন একটি গণঅভ্যুত্থানের’ জন্ম দেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেন তিনি।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেছেন, 'রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার এবং আওয়ামী লীগের দৃশ্যমান বিচার সম্পন্ন হওয়ার পর যেকোনো সময় নির্বাচনে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। এটা অনেক আগে থেকেই আমরা বলে আসছি। তবে কেবল একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করার সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে অন্যান্য রাজনৈতিক দল, গণঅভ্যুত্থানে আহত ও নিহতদের পরিবারের সঙ্গে আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে এই তারিখ ঘোষণা করা যেতে পারে।'
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, 'নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা এবং সরকারের ইতিবাচক ভূমিকা ছাড়া রাজনৈতিক অচল অবস্থা দূর হবে বলে আমার মনে হয় না। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণার বিষয়ে, নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা দেখতে চাই। এটা দেখে এবং আমাদের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের সাথে কথা বলে আমাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাব।'
তিনি মনে করেন, 'গণঅভ্যুত্থানের সময়কার হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের কাজ দৃশ্যমান করা এবং অবাধ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার ডিসেম্বরের মধ্যে করে এ সময়ের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব।'
প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন সফরের খরচ ও বৈঠকে নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুরের উপস্থিতি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন এই বাম নেতা।
ডাকসুর সাবেক জিএস ও বাংলাদেশের জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. মুশতাক হোসেন মনে করেন, 'অনিশ্চয়তা, পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস অনেকখানি কেটে গেছে। আমরা আশাবাদী। রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি কাজ শুরু করেন, আমার মনে হয় একটা স্বস্তিকর জায়গায় আমরা যাব।'
এক যৌথ বিবৃতিতে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন বলেছেন, 'অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠক ও বিবৃতিতে আগামী বছরের রমজানের আগেই একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনার ওপর গুরুত্ব আরোপ, এবং তার পূর্বশর্ত হিসেবে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার ও ফ্যাসিস্ট সরকারের বিচারের প্রক্রিয়ায় দৃশ্যমান অগ্রগতি অর্জনের ঘোষিত প্রত্যয়ে রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।'
এ বৈঠককে ‘জাতির জন্য একটি স্বস্তির বার্তা’ হিসেবে অভিহিত করেছে ১২ দলীয় জোট।
এই বৈঠক যেন ‘শুধু কথার কথায় না থাকে’ প্রয়োজনীয় সংস্কার ও বিচার প্রক্রিয়ায় দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে চাওয়ার কথা বলেছেন জোটটির নেতারা।