প্রতিনিধি কুমিল্লা
![]() |
লাল সোনাইল ফুলের রঙে সেজেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। গত রোববার কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার কোরপাই এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশজুড়ে যেন এক রঙিন ফুলের রাজ্য। পিচঢালা মহাসড়কের বুকে বর্ণিলভাবে সেজে আছে লাল সোনাইল ফুল। দেখলে মনে হবে চলাচলকারীদের যেন অভ্যর্থনা জানাচ্ছে লালচে গোলাপি ও সাদার সংমিশ্রণযুক্ত ফুলগুলো। কাছে যেতেই যে কারও ইচ্ছা করে একমুহূর্তের জন্য হলেও থমকে দাঁড়াতে।
এমন চিত্র মহাসড়কের কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার কোরপাই এলাকার। শুধু লাল সোনাইলই নয়, ব্যস্ততম এই মহাসড়কে একই সঙ্গে রূপের পসরা সাজিয়ে ফুটেছে বেগুনি রঙের মায়াভরা জারুল ফুলও। আদর্শ সদর উপজেলার নাজিরা বাজার থেকে শুরু করে বুড়িচংয়ের কোরপাই এলাকা পর্যন্ত শত শত গাছে ফুটেছে মনোমুগ্ধকর বেগুনি আর নীলাভ রঙের জারুল ফুল। জারুলের বেগুনি মায়া আর লাল সোনাইলের গোলাপি আভায় মোহিত মহাসড়কে চলাচলকারী হাজারো পথচারী।
ঋতুচক্রে প্রকৃতিতে এখন গ্রীষ্মকাল। বাংলা বছর শুরুর এই মৌসুমে প্রকৃতিতে রংবেরঙের বাহারি ফুলের মনমাতানো সৌরভ, রাঙিয়ে তুলেছে নান্দনিক রূপে। তেমনই মহাসড়কের বিভাজকে জারুল-লাল সোনাইলের ফাঁকে ফাঁকে ফুটে আছে নানা প্রজাতির ফুলও। কোথাও সোনালু আবার কোথাও কৃষ্ণচূড়া, যার চোখজুড়ানো সৌন্দর্যে মুগ্ধ হচ্ছেন চলাচলকারীরা।
![]() |
জারুল ফুলের রঙে সেজেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। রোববার কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ডুবাইচর এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকা পড়েছে কুমিল্লা জেলা অংশে। গত রোববার ঘুরে দেখা যায়, মহাসড়কের কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার নাজিরা বাজার থেকে চান্দিনা উপজেলার কাঠেরপুল পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকায় শুধুই জারুল আর লাল সোনাইল ফুল শোভা ছড়িয়ে আছে। এর মধ্যে নাজিরা বাজার থেকে বুড়িচংয়ের কোরপাই পর্যন্ত জারুল এবং কোরপাই থেকে কাঠেরপুল পর্যন্ত লাল সোনাইলগাছে সারি সারি ফুলের মেলা। পিচঢালা এই মহাসড়কের পথ যেতে যেতে সারি সারি গাছে বর্ণিল ফুলের দৃষ্টিনন্দন রূপ দারুণভাবে মোহিত করছে মানুষকে।
বুড়িচংয়ের ডুবাইচর এলাকায় জারুল ফুলের সঙ্গে ছবি তুলছিলেন শাখাওয়াত হোসেন নামের এক তরুণ। তিনি বলেন, ‘গাড়ি চলাচলের সময় বাতাসে ফুলগুলো দুলতে থাকে। এ দৃশ্য কতটা সুন্দর, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমি পাশের এলাকার বাসিন্দা, মন খারাপ থাকলে সহাসড়কের বিভাজকে ছুটে আসি ফুলগুলো দেখার জন্য। এখানে এলেই মন ভালো হয়ে যায়।’
কোরপাই এলাকায় মোটরসাইকেল থামিয়ে লাল সোনাইল ফুলের অপরূপ সৌন্দর্য মন ভরে দেখছিলেন পারভেজ হোসেন নামের আরেক তরুণ। তিনি বলেন, ‘আমি ঢাকায় থাকি। প্রায়ই বাইকে করে কুমিল্লায় আসা-যাওয়া করি। কোরপাই এলাকাটিতে এলেই মনে হয় ইউরোপের কোনো দেশ এটা। সারি সারি গাছে গোলাপি আভার লাল সোনাইল ফুল ফুটে রয়েছে। একটু বাতাস এলেই ফুলের পাপড়িগুলো পিচঢালা মহাসড়কে ঝরে পড়ে। তখন মনে হয় চলাচলকারীদের স্বাগত জানাতে ফুলের গালিচা বিছিয়ে রাখা হয়েছে। প্রায় চার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই ফুল দেখে আমি মুগ্ধ।’
![]() |
নামে লাল সোনাইল বলা হলেও গোলাপি রঙের আভাই বেশি এই ফুলে। কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার কোরপাই এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
সানজিদা আক্তার নামের এক তরুণী কলেজ থেকে বাসায় ফেরার পথে জারুলসহ অন্যান্য ফুলের ভিডিও করছিলেন। মহাসড়কের সৈয়দপুর এলাকায় তিনি বলেন, ‘আমার খুব ইচ্ছা আমার ঘরের সামনে একটি জারুল এবং একটি করে সোনালু ও কৃষ্ণচূড়া গাছ লাগাব। জারুল আমার প্রিয় ফুলগুলোর একটি। তাই বাসায় ফেরার পথে ফুলের ভিডিও করছি। ঝড়বৃষ্টিতে অনেক পাপড়ি ঝরে গেছে, কয়েক দিন আগে অনেক ফুল ছিল প্রতিটি গাছে।’
সরেজমিনে ওই এলাকাটি ছাড়াও মহাসড়কের আরও বিভিন্ন স্থানে জারুল ও লাল সোনাইল ফুলের মেলা দেখা গেছে। মহাসড়কের আলেখারচার, চৌদ্দগ্রামের মিয়ার বাজার এলাকার আশপাশ, দাউদকান্দি, চান্দিনা, কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বিভিন্ন অংশে জারুল, লাল সোনাইল, সোনালু, কৃষ্ণচূড়াসহ বিভিন্ন ফুল ফুটেছে। এসব ফুলের মনমাতানো সৌন্দর্য আর সৌরভে আকৃষ্ট হচ্ছেন চলাচলকারীরা, এ জন্য যানবাহন থামিয়ে ফুলের ছবি তুলতে দেখা যায় অনেককে।
![]() |
গ্রীষ্মের শুরুতেই জারুল ফুল ফোটে এবং শরৎ পর্যন্ত দেখা যায়। রোববার কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ডুবাইচর এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
সাইদুর রহমান নামের এক বিদ্যালয় শিক্ষক বলেন, ফুল গাছগুলোর সৌন্দর্য আরও বাড়াতে মহাসড়কের বিভাজক নিয়মিত পরিচর্যা করা প্রয়োজন। এ ছাড়া সামনে বর্ষা মৌসুমে নতুন করে আরও গাছ লাগানো দরকার।
নজরকাড়া লাল সোনাইল বা লাল সোনালুর বৈজ্ঞানিক নাম ‘ক্যাসিয়া জাভানিকা’ বলে জানালেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, লালচে গোলাপি ও সাদার সংমিশ্রণযুক্ত এই ফুলের গাছ সৌন্দর্যবর্ধনে অনেকে ব্যবহার করে থাকেন। নামে লাল সোনাইল বলা হলেও গোলাপি রঙের আভাই বেশি এই ফুলে। নান্দনিক সৌন্দর্যের ফুলগুলো ছড়ায় মুগ্ধতা। সাধারণত গ্রীষ্মকালে ফোটে এবং ফুল ফোটা অব্যাহত থাকে বর্ষা পর্যন্ত।
জারুল ফুলের বিষয়ে এই শিক্ষক বলেন, জারুল ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম ‘লেজারস্ট্রমিয়া স্পেসিওসা’ এবং ইংরেজি নাম ‘জায়ান্ত ক্রেপ মার্টেল’। জারুলগাছের পাতা সবুজ, পুরু ও বেশ বড়। পাতাঝরা বৃক্ষ শীতকালে পত্রশূন্য থাকে। বসন্তে গাঢ় নতুন সবুজ পাতা গজায়। গ্রীষ্মের শুরুতেই এর ফুল ফোটে এবং শরৎ পর্যন্ত দেখা যায়। গাছের শাখা-প্রশাখা ও কাণ্ড শক্ত, শাখা-প্রশাখার অগ্রভাগে দণ্ড-বোঁটায় অসংখ্য ফুল ফোটে। ফুল শেষে গাছে বীজ হয়, বীজ দেখতে গোলাকার। জারুল বীজের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে। বাংলাদেশে সাধারণত নীলাভ ও গোলাপি রঙের জারুল ফুল দেখা যায়।
![]() |
লাল সোনাইলের গোলাপি আভায় মোহিত মহাসড়কে চলাচলকারী হাজারো পথচারী | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
‘কুমিল্লা গার্ডেনার্স সোসাইটি’ নামে গাছ নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা আবু মোহাম্মদ নাঈম বলেন, জারুল, লাল সোনাইল, সোনালু, কৃষ্ণচূড়া, কুরচির মতো বাহারি ফুলে এখন বর্ণিল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভাজক। মহাসড়ক সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য এভাবে গাছ লাগানো একটি ভালো উদ্যোগ। পাশাপাশি কিছু গাছ অযত্নে মারাও গেছে। যেসব স্থানে গাছ মরে গেছে, সেসব স্থানে খালি জায়গায় আবার গাছ রোপণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া দরকার। তাহলে মহাসড়কের সৌন্দর্য আরও বাড়বে।
এ প্রসঙ্গে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খন্দকার গোলাম মোস্তফা বলেন, মহাসড়কের সৌন্দর্যবর্ধন এবং রাতের বেলায় বিপরীত দিকের গাড়ির হেডলাইটের আলো যেন চালকের চোখে না পড়ে এ জন্য ডিভাইডারে বিভিন্ন ধরনের গাছের পাশাপাশি এসব ফুলের গাছ রোপণ করা হয়েছে। বর্তমানে এসব ফুলের সৌন্দর্যে চলাচলের সময় মানুষ মুগ্ধ হচ্ছেন। তবে কয়েকটি স্থানে কিছু গাছ মরে গেছে। সামনে বর্ষা মৌসুমে নতুন করে যেসব স্থানে বৃক্ষ রোপণ করা হবে। এ ছাড়া সওজের নিযুক্ত শ্রমিকেরা নিয়মিত বিভাজকের গাছগুলোর পরিচর্যা করে যাচ্ছেন।