প্রতিনিধি রাজশাহী

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিটের বাইরে অপেক্ষায় জব্বার সরদারের স্ত্রী–সন্তান। গতকাল বুধবার বিকেলে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন   

সাত বছর আগে সৌদি আরবে শ্রমিক হিসেবে গিয়েছিলেন আবদুল জব্বার সরদার (৪৫)। বিমানবন্দর নেমেই তাঁকে ক্লিনারের কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়। পরে তিনি বুঝতে পারেন, দালালেরা তাঁকে বিমানবন্দরের ‘ক্লিনার’ হিসেবে বেচে দিয়েছেন। তিন বছর পর শূন্য হাতে তাঁকে বিমানবন্দর থেকে বিদায় করে দেওয়া হয়। হঠাৎ দেখা পাওয়া এলাকার এক ব্যক্তির মাধ্যমে পরে অন্যত্র কাজ পেলেও সুদিনের আর দেখা পাননি রাজশাহীর তানোর উপজেলার হিরানন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা জব্বার সরদার।

এক বছর আগে সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হওয়ার পর তাঁকে আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে) ভর্তি করা হয়। এই খবর পেয়ে স্বামীকে ফেরাতে সরকারের এক দপ্তর থেকে আরেক দপ্তরে ছোটাছুটি শুরু করেন স্ত্রী। তাঁর চেষ্টায় অচেতন অবস্থায় দেশে ফিরেছেন জব্বার সরদার। গত রোববার (২৬ মে) তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে।

জব্বার সরদার একজন কৃষিশ্রমিক ছিলেন। ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি তিনি সৌদি আরবে যান। তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে।

এক বছর ধরে অচেতন স্বামীকে দেশে ফেরানোর লড়াই করতে গিয়ে স্ত্রী আদরি খাতুন দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। হয়েছেন ঋণগ্রস্ত। গতকাল বুধবার (২৮ মে) রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিটের বাইরে বসে সেই কাহিনি বলতে গিয়েই তিনি হাঁপিয়ে ওঠেন। জানান, তাঁরা প্রথমে বুঝতে পারেননি যে দালালের খপ্পরে পড়েছেন। তিন বছরে বিনা পয়সায় তাঁর স্বামীকে দিয়ে বিমানবন্দরে ক্লিনারের (পরিচ্ছন্নতাকর্মী) কাজ করানো হয়। তারপর খালি হাতে বিদায় দেওয়া হয়। তখন দেশে ফেরারও কোনো উপায় ছিল না। ফিরিয়ে আনার মতো টাকাও বাড়িতে ছিল না। ধারদেনা করে সাত লাখ টাকা জোগাড় করে বিদেশে গিয়েছিলেন জব্বার সরদার। সেই ঋণও শোধ হয়নি।

জব্বার সরদার ও আদরি খাতুন দম্পতি ছবি: সংগৃহীত

আদরি খাতুন বলেন, তাঁর স্বামী ধারণা করেছিলেন সৌদি আরবে পুলিশ ধরলে তাঁকে দেশে পাঠিয়ে দেবেন। তিনি নিজে থেকে পুলিশের কাছে ধরা দেন। পুলিশ তাঁর ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে তাঁকে আবার ছেড়ে দেয়। এরপর নিরুপায় হয়ে জব্বার সেখানকার একটা নদীর ধারে বসে কাঁদছিলেন। পকেটে তখন ভাত খাওয়ার একটি টাকাও ছিল না। তাঁকে দেখে অপরিচিত একজন লোক খাবার দিয়ে যান। কয়েক দিন পর লোকটি জানতে চান, কী হয়েছে, বসে কাঁদেন কেন। পরিচয় হয়, লোকটা রাজশাহীর তানোর উপজেলার মন্ডুমালা এলাকার মানুষ। নাম মোয়াজ্জেম। তিনি ভারতীয় একটি মালিকের টাইলস কারখানায় জব্বারকে একটি কাজ জুটিয়ে দেন। সেখানেই কাজ করছিলেন। এই অবস্থায় গত বছর ১০ মে তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন। তাঁকে উদ্ধার করে সৌদি আরবের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করায়।

জব্বারের মালিক ভারতীয় নাগরিক। তিনি হিন্দিতে কথা বলেন। অন্যদিকে আদরি হিন্দি বোঝেন না। তখন তিনি মোয়াজ্জেমের মাধ্যমে মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। জব্বারকে আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়। তিন মাস পর তাঁরা দেশে ফেরানোর জন্য কথা বলেন। কিন্তু খরচ চান ৭০ লাখ টাকা। কারণ, জব্বারের কোনো কাগজপত্র নেই। কোনো উপায় না দেখে আদরি খাতুন ভারতীয় কোম্পানির মালিকের পরামর্শে ঢাকায় ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মাধ্যমে আবেদন করেন। তাতেও কোনো কাজ হয় না।

বাধ্য হয়ে তানোর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে যান আদরি খাতুন। তিনি বলেন, ২২ দিন অপেক্ষা করেও ভেতরে ঢোকার সুযোগ পাননি। অবশেষে একদিন তিনি চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেন, ‘হায়রে দুনিয়ার মানুষ। মানুষের জন্য কেউ আগায়ে আসে না!’ তাঁর কান্না শুনে একজন পুলিশ সদস্য তাঁকে ইউএনওর কার্যালয়ের ভেতরে নিয়ে যান। সব শুনে ইউএনও সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। ১৫ দিন পর তিনি যোগাযোগ করতে পারেন। তিনি আদরি খাতুনকে ফোনে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন।

আবদুল জব্বার সরদার একেবারে কঙ্কাল হয়ে গেছেন। ওখানে এক বছর ইউসিইউতে ছিলেন। তাঁর শরীরে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি দরকার। মাথায় একটা অস্ত্রোপচার লাগবে।

— আবু হেনা মোস্তফা কামাল, আইসিইউ ইনচার্জ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

তবে ঠিক কার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল বলতে না পারলেও আদরি খাতুন জানান, জব্বারকে পাঠানোর জন্য সেখান থেকে ৭০ লাখ টাকা চাওয়া হয়। একপর্যায়ে তাঁরা বিমানভাড়া বাবদ ১৯ হাজার টাকা দিতে বলেন। আদরি খাতুন সেই টাকাও জোগাড় করতে পারেন না। তখন সৌদি থেকে সময় চান। আদরি বলেন, ‘এই করতে করতে এক বছর পার হয়ে গেল।’

হঠাৎ গত ১৩ মে আদুরিকে ফোন দিয়ে বলা হয়, ঢাকায় পৌঁছার পর যে হাসপাতালে রোগীকে ভর্তি করানো হবে সেই হাসপাতালে বেড প্রস্তুত রাখতে। তাঁরা সেই হাসপাতালে রোগীকে পৌঁছে দেবেন। সঙ্গে চিকিৎসক ও নার্স যাবে। চিকিৎসক–নার্স হাসপাতালে গিয়ে ছয় ঘণ্টা ধরে কথা বলে রোগীকে বুঝিয়ে দিয়ে আসবেন। আদরি খাতুন বলেন, তাঁরা কিছু টাকাও দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঢাকায় পৌঁছানোর পর তাঁরা কোনো টাকাই দেননি। হাসপাতাল পর্যন্তও আসেননি। বিমানবন্দরে রোগী রেখে চলে গেলেন।

আদরি বলেন, ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করে সাত ঘণ্টা রাখতেই ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। তখন নিরুপায় হয়ে ২৫ হাজার টাকায় অক্সিজেনসহ গাড়ি ভাড়া দিয়ে গত শনিবার রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। প্রথম দিন আইসিইউতে বেড পাওয়া গেল না। রোববার (২৫ মে) বেড পেয়েছেন।

হাসপাতালের আইসিইউ ইনচার্জ আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, আবদুল জব্বার সরদার একেবারে কঙ্কাল হয়ে গেছেন। ওখানে এক বছর ইউসিইউতে ছিলেন। তাঁর শরীরে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি দরকার। মাথায় একটা অস্ত্রোপচার লাগবে। তিনি আশা করছেন, এরপরই জব্বারের জ্ঞান ফিরতে পারে। ছেলে যাতে তাঁকে খাওয়াতে পারেন সেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। শিখে গেলে কাল-পরশু রোগীকে সাধারণ ওয়ার্ডে পাঠানো হবে।

এমন অবস্থায় আদরি খাতুন দুচোখে অন্ধকার দেখছেন। তিনি বলেন, এখন চিকিৎসা তো দূরের কথা তাঁদের খেয়ে বেঁচে থাকার মতো কোনো আর্থিক সংগতি নেই। স্বামী বাঁচবে এই আশায় শুধু ধারের ওপরে রয়েছেন।