[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

পটিয়ার সেই সাংস্কৃতিক সংগঠনের নাম রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ

প্রকাশঃ
অ+ অ-

প্রতিনিধি পটিয়া

চট্টগ্রামের পটিয়ার সাংস্কৃতিক সংগঠন রূপনিকেতনের বর্তমান সদস্যরা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

মাস্টারদা সূর্য সেনের ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের সশস্ত্র প্রতিরোধ স্তিমিত হয়ে এসেছে। ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা বিপ্লবীরা তখন চেষ্টা করছেন জনগণের মনোবল ও ঐক্য ধরে রাখার। সেই লক্ষ্যে চট্টগ্রামের পটিয়ার কেলিশহরের জমিদার সুরেন্দ্র লাল রায়ের বাড়ি রায় ভবনে বসল বৈঠক। সিদ্ধান্ত হলো সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে সুসংগঠিত হবেন বিপ্লবীরা। দ্রোহের চেতনা পৌঁছে দিতে গড়ে তোলা হবে সাংস্কৃতিক সংগঠন।

তবে সংগঠনের নাম নিয়ে একমত হতে পারছিলেন না কেউ। সিদ্ধান্ত হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে পরামর্শ করে সংগঠনটির নামকরণ করা হবে। কিছুদিন পর সুরেন্দ্র লাল রায়ের বড় ছেলে সুবোধ রঞ্জন রায় শান্তিনিকেতনে গেলে এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আলোচনা করেন। বোলপুরের শান্তিনিকেতনের সঙ্গে মিলিয়ে কবিগুরু পটিয়ায় প্রস্তাবিত সংগঠনের নামকরণ করেন ‘রূপ নিকেতন’। ১৯৩৭ সালে এভাবেই শুরু হয় পটিয়ার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বাতিঘর রূপ নিকেতনের যাত্রা।

উত্তর কেলিশহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উত্তর পাশে রায় ভবনের অবস্থান। বর্তমানে ভগ্নদশা এই বাড়িতেই সেদিন বৈঠকে বসেছিলেন সুরেন্দ্র লাল রায়ের বড় ছেলে প্রভাস রঞ্জন রায়, মেজ ছেলে সরোজ রঞ্জন রায়, ছোট ছেলে কবি ও সাহিত্যিক সুবোধ রঞ্জন রায়; ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, কৃষক ও তেভাগা আন্দোলনের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা পূর্ণেন্দু কানুনগো, তাঁর কাকা নরেশ কানুনগো, সুপ্রীতি ভূষণ চৌধুরী, বিনোদ বিহারী চক্রবর্তী, নীরেন্দ্র লাল পাঠক, বিনোদ বিহারী চৌধুরী, হরিসাধন মুখার্জি, কেশব চন্দ্র পাঠক, সূর্য কানুনগো প্রমুখ নামকরা ব্যক্তি। প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্য থেকে সূর্য কানুনগো প্রতিষ্ঠানটির তবলা ও বিনোদ বিহারী সেতার শিক্ষক ছিলেন।

১৯৬৫ সালে রায় ভবন থেকে রূপ নিকেতনের কার্যক্রম স্থানান্তর করে পূর্ণেন্দু কানুনগোদের বাড়ি কানুনগো ভবনের বৈঠকখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। কানুনগো ভবনের নানা গাছের ছায়াঘেরা দেউড়ি–ঘরে রূপ নিকেতনের নিয়মিত ক্লাস হতো। পাকিস্তানি শাসকদের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে তখন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) মাঠ প্রাঙ্গণে রবীন্দ্র-নজরুল জন্মজয়ন্তী পালনের সাহসী উদ্যোগ নিয়েছিলেন সংগঠকেরা। গ্রামের স্কুল–কলেজে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীরা সারা বছর এ সংগঠনের এসে সংগীত ও নৃত্য শিক্ষা গ্রহণ করতেন।

কেলিশহরে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী শহীদ প্রমোদ রঞ্জন চৌধুরী ও কিশোর শহীদ কৃষ্ণ চৌধুরীর আবক্ষ মূর্তির সামনে ১৯৭৪ সালে বিপ্লবী প্রমোদ-কৃষ্ণ স্মৃতি তোরণ নির্মাণ করা হয়। সে সময় চট্টগ্রামের জেএম সেন হলের সামনে মাস্টারদা সূর্য সেনের আবক্ষমূর্তি উন্মোচন অনুষ্ঠানে ভারত থেকে আসেন বিপ্লবী কল্পনা দত্ত, গণেশ ঘোষসহ অনেকে। এ সময় তাঁরা কেলিশহরে এসে প্রমোদ-কৃষ্ণ স্মৃতি তোরণ উদ্বোধন করেন। তখন অতিথিদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে রূপ নিকেতন।

১৯৮৯ সালে দক্ষিণ চট্টগ্রামে প্রথম পয়লা বৈশাখের শোভাযাত্রার আয়োজন করে রূপ নিকেতন। তখন পটিয়া সদর কিংবা থানা পর্যায়ে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানের কোনো আয়োজন হতো না। রূপ নিকেতন সূর্যোদয়ের মুহূর্তে সংগীতের মাধ্যমে ‘এসো হে বৈশাখ’ গানে নতুন বছরকে আহ্বান করে পুরো চট্টগ্রামের মধ্যে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। বর্তমান কার্যকরী সভাপতি দিবাকর চৌধুরী এভাবেই জানালেন বিপ্লবীদের হাতে গড়া সংগঠন রূপ নিকেতনের ইতিহাস।

৮৮ বছর ধরে সংস্কৃতি চর্চায় ভূমিকার রাখছে এই সংগঠন | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

দিবাকর চৌধুরী বলেন, বাঙালির ঐতিহ্য সংস্কৃতির ধারণ ও লালন করাই হচ্ছে রূপ নিকেতনের মূল লক্ষ্য। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শোষণ–নিপীড়নের বিরুদ্ধে গণজাগরণ তৈরির লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠন কখনো তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়নি। কোনো ধরনের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা না থাকায় প্রতিষ্ঠানটি কখনো সরকারি অনুদান পায়নি। রূপ নিকেতনের অনেক ছাত্রছাত্রী দেশে–বিদেশে আলো ছড়াচ্ছেন। কিন্তু পরের প্রজন্মকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁরা প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত থাকলে এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও অনুসারীদের স্বপ্ন আরও অনেক দূর এগিয়ে যেত।

১৯৯০ সালের দিকে ডাক্তার সুখেন্দ দাশগুপ্তের বাড়ির আঙিনায় কার্যক্রম শুরু হয় সংগঠনটির। ১৯৯৬ সালে সুখেন্দ দাশগুপ্তের স্ত্রী নীলিমা দাশগুপ্তের দান করা আট শতক জায়গার ওপর সেমিপাকা করে একটি স্থায়ী ভবন নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে সেটিতেই রূপ নিকেতনের কার্যক্রম চলছে। ৮৮ বছর ধরে রূপ নিকেতনের শিক্ষার্থীরা শিল্পী, নাট্যকার ও আবৃত্তিকার হিসেবে দেশে–বিদেশে খ্যাতি লাভ করেছেন।

বর্তমান পরিচালনা পরিষদের সভাপতি পংকজ সেন ও সাধারণ সম্পাদক আশীষ পাঠক বলেন, প্রতি শুক্রবার চারজন শিক্ষক-শিক্ষিকা দিয়ে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ক্লাস চলে। প্রায় ১২০ জন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে মাসিক ন্যূনতম ৫০ টাকা বেতন নেওয়া হয় শুধু। শুভানুধ্যায়ী ও সংগঠকদের অনুদান–সহায়তায় প্রায় শত বছরের অস্তিত্ব ধরে রেখেছে রূপ নিকেতন।

অবৈতনিক শিক্ষক ওস্তাদ নির্মলেন্দু চৌধুরী মৃত্যুর আগপর্যন্ত রূপ নিকেতনের অধ্যক্ষ ছিলেন। রূপ নিকেতনের প্রাক্তন শিক্ষার্থী রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী কান্তা দে ও সুরকার হিসেবে রাজীব মজুমদার বর্তমানে বেতার ও টিভির নিয়মিত শিল্পী হিসেবে কাজ করছেন। রাজীব মজুমদার বর্তমানে চট্টগ্রামের একটি সংগীত বিদ্যালয় পরিচালনা করেন। রূপ নিকেতনের প্রাক্তন ছাত্র পলাশ দে বর্তমানে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট তবলাবাদক।

বর্তমান বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনর নিয়মিত শিল্পী কান্তা দে বলেন, তখনকার সময়ে গ্রামাঞ্চলের মধ্যে খুবই প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তির জন্য প্রসিদ্ধ সংগঠন রূপ নিকেতন। ১৯৮৮ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় প্রথম রূপ নিকেতনে ভর্তি হন তিনি। সেখান ওস্তাদ নির্মলেন্দু চৌধুরীর হাতে তাঁর সংগীতের পথচলা শুরু। ধলঘাট ইউনিয়নের আলামপুর গ্রাম থেকে হেঁটে সংগীত শিক্ষার জন্য এখানে চলে আসতেন। এ প্রতিষ্ঠানটিকে তিনি কখনো ভুলতে পারবে না। এটি তাঁর প্রাণের সংগঠন। তিনি রূপ নিকেতনের একজন আজীবন সদস্য। প্রাক্তন ছাত্রী হিসেবে যখনই সময় পান তখনই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ছুটে আসেন।

Fetching live reactions...
Was this article helpful?

Comments

Comments

Loading comments…
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন