মাঠপর্যায়ে দ্বিধাবিভক্ত আওয়ামী লীগ

আওয়ামী লীগ

নিজস্ব প্রতিবেদক: পঞ্চগড়-১ আসনে (সদর, তেঁতুলিয়া ও আটোয়ারী) আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন দলটির জেলা শাখার সহসভাপতি নাঈমুজ্জমান ভূঁইয়া (মুক্তা)। অপর দিকে এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন আরও চার আওয়ামী লীগ নেতা। এর মধ্যে বর্তমান সংসদ সদস্য মজাহারুল হক প্রধান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাতও রয়েছেন।

আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলের একাধিক নেতার স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘটনায় সমস্যায় পড়েছেন পঞ্চগড়ের নেতা-কর্মীরা। সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সায়েদ আল বলেন, ‘নির্বাচনের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছি। একদিকে দল মনোনীত প্রার্থী আছে, অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতারাই দাঁড়িয়েছেন। কাকে ছেড়ে কার কাছে যাব, ভেবে পাচ্ছি না। এই অবস্থায় তৃণমূলের বেশির ভাগ নেতা-কর্মী দ্বিধাবিভক্তিতে ভুগছেন।’

এই চিত্র শুধু পঞ্চগড়ের নয়। ১২টি জেলা থেকে প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এসব জেলার ৩২টি সংসদীয় আসনের ২০টিতে বর্তমান সংসদ সদস্যরাই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। ১০টি আসনে বর্তমান সংসদ সদস্যরা মনোনয়ন পাননি। তাঁদের মধ্যে ৭ জনই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। বাকি দুটি আসনের একটিতে বর্তমানে জাতীয় পার্টি (জাপা) ও আরেকটিতে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সংসদ সদস্য রয়েছেন।

তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই ৩২ আসনে দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে বর্তমান সংসদ সদস্য ছাড়াও সাবেক সংসদ সদস্য, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ দলের মাঠপর্যায়ের শীর্ষ নেতারা প্রার্থী হয়েছেন।

তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বলছেন, যাঁরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশই দীর্ঘদিন ধরে দল করেন। এমন নেতারা দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় নেতা-কর্মীরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন। কোন পক্ষে অবস্থান নেবেন, তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতাও রয়েছে। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা না এলে এই বিভক্তি স্থায়ী হতে পারে।

পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগে দুটি পক্ষ। এক পক্ষের নেতৃত্বে আছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। অপর পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম এ আউয়াল ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। রেজাউল করিম এবার পিরোজপুর-১ (সদর-নাজিরপুর) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে এম এ আউয়াল স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।

বর্তমান সংসদ সদস্য দলের ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় দলের নেতা-কর্মীরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন। পিরোজপুর জেলা এবং সদর, নাজিরপুর ও ইন্দুরকানি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ দলের একটি অংশ আউয়ালের পক্ষে কাজ করছে। রেজাউল করিমের পক্ষে রয়েছে আরেকটি অংশ। এবার নির্বাচন ঘিরে দলে বিভক্তি আরও বাড়বে বলে মনে করছেন নেতা-কর্মীরা।

কুমিল্লায় স্বতন্ত্রদের চাপে দলীয়রা
দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায় কুমিল্লার ১১টি আসনের মধ্যে ৮টি আসনে আওয়ামী লীগ নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এর মধ্যে দুজন সংসদ সদস্যও রয়েছেন। কুমিল্লা-২ (হোমনা ও মেঘনা) আসনে দলের মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য সেলিমা আহমাদ। এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন হোমনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আবদুল মজিদ।

কুমিল্লা-৬ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী টানা তিনবারের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন। এবার এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা আঞ্জুম সুলতানা। আঞ্জুম সুলতানা বর্তমানে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য। 

কুমিল্লা-৮ (বরুড়া) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবু জাফর মোহাম্মদ শফি উদ্দিন। এই আসনে প্রার্থী হয়েছেন দুবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য নাছিমুল আলম চৌধুরী।

শুরুতেই বিপাকে নওগাঁর দুই প্রার্থী
নওগাঁর ছয়টি আসনের প্রতিটিতেই আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিপক্ষে দলটির এক বা একাধিক নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তবে নওগাঁ-৩ ও নওগাঁ-৪ আসনে এবার বর্তমান সংসদ সদস্যরা মনোনয়ন পাননি। তাঁরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ফলে অপেক্ষাকৃত নতুন দুই প্রার্থী বিপাকে পড়েছেন।

নওগাঁ-৪ (মান্দা) আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে ছয়বার জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন বর্তমান সংসদ সদস্য এবং সাবেক মন্ত্রী ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক। এবার তিনি দলীয় মনোনয়ন পাননি। তবে তিনি স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাহিদ মোর্শেদ।

নওগাঁ-৩ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য ছলিম উদ্দিন তরফদার এবার দলীয় মনোনয়ন পাননি। তিনিসহ আওয়ামী লীগের তিন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।

চট্টগ্রামের সাত আসনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী
চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের মধ্যে অন্তত ৭টিতে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কারণে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীরা।

চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিনের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মোতালেব। চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) নৌকার প্রার্থী চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী। এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী।

দলের নেতা-কর্মীরা বলছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী নিয়ে কেন্দ্রের ইতিবাচক মনোভাব থাকায় নেতা-কর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। কিছু আসনে চট্টগ্রাম জেলা ও নগর কমিটির শীর্ষ নেতারা নৌকা প্রতীকের পরিবর্তে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থন দিচ্ছেন বলে আলোচনা রয়েছে।

বরিশালে জোটের রাজনীতিতে ‘জট’
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বরিশালের দুটি আসনে আকস্মিক প্রার্থী হওয়ায় স্থানীয় ১৪–দলীয় জোটের রাজনীতিতে বেশ টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। রাশেদ খান মেননের পৈতৃক বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলায় হলেও তিনি জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয়। এবার তিনি বরিশাল-২ (বানারীপাড়া-উজিরপুর) ও বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী) আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ায় জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।

বরিশাল-২ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য তালুকদার ইউনুসকে। বরিশাল-৩ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির (জাপা) গোলাম কিবরিয়া টিপু। আর আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছে বাবুগঞ্জ উপজেলা সভাপতি ও সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সরদার খালেদ হোসেনকে। রাশেদ খান মেনন মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ায় বরিশালে জোটের রাজনীতির হিসাব-নিকাশ আরও জটিল হয়েছে।

তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা বলছেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে পুলিশ ও প্রশাসনের গুরুত্ব বেশি ছিল। এবার দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার ঘোষণায় দলীয় নেতা-কর্মীদের গুরুত্ব অনেকটাই বেড়ে গেছে। তবে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলের লোকজনই প্রার্থী হবেন—এমন কৌশলের জন্য তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা প্রস্তুত ছিলেন না। ফলে হঠাৎ দলের এমন সিদ্ধান্তে তাঁরা বেশি বিপাকে পড়েছেন।