শিয়ালের আক্রমণে পদ্মার চরের ২০০ গবাদি পশু আহত, দুই কৃষকও জখম
![]() |
| রাজশাহীতে শিয়ালের কামড়ে আহত গরু। শনিবার পদ্মার নদীর চরে বাথানে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
কথায় আছে, ‘আদাড় গাঁয়ে শিয়াল বাঘ’। রাজশাহীতে শেয়াল যেন বাঘের মতো আচরণ করছে। পদ্মা নদীর চরের বাথানে একদল শিয়ালের হামলায় ২০০ গরু-মহিষ আহত হয়েছে। শিয়ালের দল শুধু গরু-মহিষকে জখম করেই থামেনি, দুই কৃষকের ওপরও হামলা করেছে। এছাড়া চারজনকে তাড়া করে নদীতে নামিয়েছে।
ঘটনা ঘটে ২০ ডিসেম্বর রাত এবং ২১ ডিসেম্বর সকালে। এই ঘটনায় চরের বাসিন্দাদের মধ্যে শিয়ালের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। আহত দুই কৃষক রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। গরুগুলোকে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে।
চর মাঝারদিয়াড় এলাকার কৃষক আবদুল হান্নান বলেন, ঘটনার আগের দিন চরখানপুরে দুই রাখাল একটি শিয়াল মেরে ফেলে। ওই দৃশ্য চারটি শিয়াল দূর থেকে দেখেছে। সেই রাতেই শিয়ালের দল বাথানে হামলা চালায়।
রাজশাহী বন বিভাগের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন্য প্রাণী পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবির বলেন, শিয়ালের খাবারের অভাব হলে, কেউ বিরক্ত করলে বা প্রজনন মৌসুমে তারা এ ধরনের আচরণ করে। ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি তাদের প্রজনন মৌসুম।
![]() |
| রাজশাহীর পদ্মার চরে শনিবার বিকেলে দেখা যায় এই শিয়ালকে। সে মানুষ দেখে মোটেও পালায়নি | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ সূত্রে জানা গেছে, এ বছর হাসপাতালে শিয়ালের কামড়ে আহত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। গত বছর ১৭৬ জন রোগী শিয়ালের কামড়ে আহত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছিলেন। এ বছর ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৮৮ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।
রাজশাহীর পবা উপজেলার পদ্মা নদীতে জেগে ওঠা একটি চর রয়েছে, যার নাম ষাটবিঘা। এই চরে পাশের খানপুরের লোকজন গরুর বাথান করেছেন। দিনের বেলা চরের মাঠে গরু চরে বেড়ায়, আর রাতের বেলায় বাথানে রেখে গৃহস্থরা বাড়িতে চলে যান। ২১ ডিসেম্বর ভোরে তাঁরা দেখেন, গরুগুলো বাথান থেকে বেরিয়ে চরের মাঠে ছড়িয়ে পড়েছে। গরুগুলোর নাক-মুখ ও কান ছিঁড়ে ফেলা, নাক-মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে। শুধু যে বাথানগুলো চারপাশে নেট বা জাল দিয়ে ঘিরে রাখা ছিল, সেই গরুগুলো রক্ষা পেয়েছে। বাথানে ছয় শতাধিক গরু ছিল, যা বেড়া ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসে। কৃষকেরা বলছেন, এটি শিয়ালের কাজ। রাতে হামলার পর সকালেও ছয়টি শিয়াল বাথানের পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা এসেও শিয়ালগুলো দেখেছেন।
পবা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবদুল লতিফ জানান, আহত ২০০ গরু-মহিষকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সেখানে থাকাকালীন এক রাখালকে শিয়াল ধাওয়া করতে দেখেছেন।
শনিবার সকালে রাজশাহী শহর থেকে পদ্মা নদী পার হয়ে বাথানে গিয়ে সিজন আলী নামের একজন কৃষকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, তাঁর ৪০টি গরুর মধ্যে ২৬টি শিয়ালের আক্রমণের শিকার হয়েছে। গরু ছাড়াও শিয়াল তাঁর তিনটি মহিষকেও জখম করেছে। তিনি বলেন, রাতে হামলা থামেনি। সকাল ১০টার দিকে কৃষক আফসার আলী ও আক্কাস আলীকে কামড় দেয়।
বাথানের কাছ থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে চরের ভেতরে চারটি বাড়ি আছে। তাদের মধ্যে একজন আফসার আলী। তিনি গ্রামে ফেরি করে বাড়িতে তৈরি ঝুড়ি বিক্রি করেন। এক হাতে আঙুলের মাথা ছিঁড়ে গেছে, নিচের ঠোঁটও ছিঁড়ে গেছে, এবং দুই চোয়ালে দুটি দাঁত বসিয়েছে শিয়াল।
আফসার আলী বলেন, কৃষি কর্মকর্তাকে তাঁর পেঁয়াজের জমি দেখাতে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন চাচাশ্বশুর আক্কাস আলী। তখন একটি শিয়াল লেজ নেড়ে তাঁর দিকে ছুটে আসে। তিনি দুই হাত দিয়ে শিয়ালকে ঠেকানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু শিয়াল তাঁর মুখে কামড় দেয়। ঠোঁট বাঁচাতে শিয়ালের মাথা চেপে ধরেন। চাচাশ্বশুর হাতের হাঁসুয়া দিয়ে শিয়ালের এক পাশে আঘাত করেন। শিয়াল তখন অন্য পাশ দিয়ে হামলা চালিয়ে তাঁর হাতের আঙুলে কামড় দেয়। শেষমেশ হাঁসুয়ার একটি কোপ খেয়ে চাচাশ্বশুর হাতের মাংস কেটে যায়।
মাঝারদিয়াড় গ্রামের কৃষক আবুল কালাম বলেন, ‘আফসারকে কামড়ানোর দিন শিয়াল আমার পাশে এসে দাঁড়াল। ভয় নেই। মুখে রক্ত ছিল। মাটিতে মুখ মুছল। তখন দেখি মাটির ঢেলাতে রক্ত লেগে গেছে।’
আফসারের স্ত্রী ফাইমা খাতুন বলেন, শিয়াল পশ্চিম দিকে মাঝারদিয়াড় এলাকায় গিয়ে চারজন পেঁয়াজচাষিকে তাড়া করেছে। তাঁরা ভয়ে নদীতে ঝাঁপ দেন। আরেকজনের কাছে লাঠি থাকায়, মাথায় আঘাত দিলে শিয়াল মারা যায়।
পথে দেখা হয় কৃষক মাহমুদ সুজন আলীর সঙ্গে। তাঁর ২০টি গরুকে শিয়ালের কামড় দিয়েছে। ঘটনার তিন দিন আগে মাঠে তাঁর একটি বাছুর ছিল, সেটিও তিনটি শিয়ালের ঘেরায় পড়েছিল। পরে বাছুর উদ্ধার করেন। ফেরার পথে আফসার আলী একটি লাঠি হাতে নিয়ে প্রতিবেদককে দেখান। পথে তিনবার শিয়ালের দেখা পান।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আতোয়ার রহমান বলেন, এ ধরনের আক্রমণে গরু-মহিষকে পাঁচটি ডোজ দেওয়া হয়। এর মধ্যে দুই ডোজ দেওয়া হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে আরও ওষুধ নেই। জেলা প্রশাসককে বিষয়টি জানানো হয়েছে। জেলা পরিষদ একটি অনুদান দেয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে।


Comments
Comments