[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

নিফাক শব্দের অর্থ কী এবং মুনাফিকের লক্ষণগুলো কী

প্রকাশঃ
অ+ অ-
ছবি: ফ্রিপিক

ইসলামে “নিফাক” এমন এক আধ্যাত্মিক রোগ, যা মানুষের ইমানকে ভেতর থেকে ধ্বংস করে দেয়। এটি এমন এক দ্বিমুখী আচরণ—বাইরে মুসলমানের রূপে দেখা গেলেও অন্তরে থাকে অবিশ্বাস ও প্রতারণা। নবীজি (স.) নিফাককে সবচেয়ে ভয়ংকর মানসিক ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যা মানুষকে ধীরে ধীরে ইমান থেকে বিচ্যুত করে।

নিফাক শব্দের অর্থ
“নিফাক” শব্দটি এসেছে আরবি “নাফাকা” ধাতু থেকে, যার অর্থ গর্ত করা, আড়াল করা বা দ্বিমুখিতা প্রদর্শন করা। আরবিতে “নাফাকা” বলা হয় এমন সুড়ঙ্গকে যার দুটি মুখ থাকে—এক মুখে প্রবেশ করে অন্য মুখে বের হওয়া যায়। ঠিক তেমনি, মুনাফিক ব্যক্তি এক মুখে ইমানের কথা বলে, অন্য মুখে অবিশ্বাস ও প্রতারণা লুকিয়ে রাখে।

কোরআনের দৃষ্টিতে নিফাক
কোরআনে “নিফাক” বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে আলোচিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “মানুষের মধ্যে কেউ কেউ বলে, ‘আমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করি,’ অথচ তারা বিশ্বাসী নয়।” (সূরা বাকারা, আয়াত: ৮)

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, “নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আগুনের নিম্নতম স্তরে থাকবে, আর তুমি তাদের জন্য কোনো সহায়ক পাবে না।” (সূরা নিসা, আয়াত: ১৪৫)

এই আয়াত থেকে স্পষ্ট হয়—নিফাক এমন গুরুতর অপরাধ, যার জন্য জাহান্নামের সবচেয়ে নীচে শাস্তি নির্ধারিত হয়েছে।

নিফাকের প্রকারভেদ
আলেমগণ নিফাককে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন —

১️. নিফাক ইতিকাদি (অবিশ্বাসমূলক নিফাক): যেখানে অন্তরে অবিশ্বাস থাকে কিন্তু মুখে ঈমানের প্রকাশ করা হয়। এটি কুফরের এক রূপ এবং মানুষকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়।

২️. নিফাক আমলি (কর্মগত নিফাক): যেখানে ইমান থাকে, কিন্তু আচরণে মুনাফিকি বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। যেমন: মিথ্যা বলা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা, আমানত ভঙ্গ করা। (ইমাম নববি, শারহ সহিহ মুসলিম, ২/৪৬, দারুল হাদিস, কায়রো)

মুনাফিকের তিনটি লক্ষণ
সহিহ হাদিসে নবীজি (স.) স্পষ্টভাবে মুনাফিকের তিনটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, “মুনাফিকের তিনটি লক্ষণ আছে: যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে; যখন প্রতিশ্রুতি দেয়, তা ভঙ্গ করে; এবং যখন আমানত রাখা হয়, তা খিয়ানত করে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৩; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৫৯)

এই তিনটি বৈশিষ্ট্যই নিফাক আমলির প্রতিফলন, যা মানুষকে ধীরে ধীরে সত্যনিষ্ঠতা ও ইমান থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।

তিনটি লক্ষণের বিশ্লেষণ
১️. মিথ্যা বলা: মিথ্যা ইসলামি নৈতিকতার পরিপন্থী। নবীজি (স.) বলেছেন, “সত্য মানুষকে নেকির দিকে নিয়ে যায়, আর মিথ্যা নিয়ে যায় পাপের দিকে।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬০৭)

মিথ্যা অভ্যাসে পরিণত হলে তা অন্তরের ঈমানকে ধ্বংস করে দেয়, এবং মানুষ নিফাকের পথে পা বাড়ায়।

২️. প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা: ইসলামে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা নৈতিক দায়িত্ব। আল্লাহ তাআলা বলেন, “তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ করো; নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।” (সূরা ইসরা, আয়াত: ৩৪)

যে ব্যক্তি বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, সে নিজের প্রতি মানুষের বিশ্বাস নষ্ট করে এবং আল্লাহর কাছে মুনাফিকদের দলে অন্তর্ভুক্ত হয়।

৩️. আমানতের খিয়ানত করা: অমানত মানে শুধু টাকা-পয়সা নয়, বরং দায়িত্ব, পদ, বা কাউকে দেওয়া বিশ্বাসও। নবীজি (স.) বলেছেন,  “যার মধ্যে আমানত নেই, তার ইমানও নেই।” (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১২৫৬৫)

অর্থাৎ, যে ব্যক্তি দায়িত্বে অবিশ্বস্ত, সে ঈমানদার হতে পারে না। 

মুনাফিকির সামাজিক প্রভাব
নিফাক শুধু ব্যক্তিগত পাপ নয়, এটি সমাজে নৈতিক অবক্ষয়ের কারণ হয়। একজন মুনাফিক সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, কারণ সে কখনোই স্পষ্ট অবস্থান নেয় না। কোরআনে বলা হয়েছে,  “তারা প্রতিটি দলের সঙ্গেই যায়; একদল সফল হলে বলে—আমরা তো তোমাদের সঙ্গে ছিলাম।” (সূরা হাশর, আয়াত: ১১)

অর্থাৎ, মুনাফিক ব্যক্তি সর্বদা সুবিধাবাদী, তার কোনো আদর্শ বা সত্যনিষ্ঠ অবস্থান থাকে না।

ইসলামি পণ্ডিতদের বিশ্লেষণ
ইমাম গাজালি (রহ.) লিখেছেন, “নিফাকের মূল হলো হৃদয়ের দ্বৈততা; বাহিরে আল্লাহর আনুগত্য, ভেতরে নিজ স্বার্থের আনুগত্য।” (ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন, ৩/৫৮, দারুল মাআরিফ, কায়রো, ১৯৯২)

ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন,  “মুনাফিক এমন ব্যক্তি, যার জিহ্বা বিশ্বাস করে, কিন্তু হৃদয় অস্বীকার করে।” (আয-যাদুল মা‘আদ, ৪/৩৮৪, দারুল ফিকর, বৈরুত, ২০০৩)

নিফাক থেকে বাঁচার উপায়
১️. নিয়মিত আত্মসমালোচনা করা—আমি কি কথায় বা কাজে দ্বিমুখী আচরণ করছি?

২️. আমানত রক্ষা ও সত্যবাদিতায় অটল থাকা।

৩️. দোয়া করা: “আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযুবিকা মিনাল নিফাকি ওয়াশ শিরকি ওয়াল কুফরি।”

অর্থ: “হে আল্লাহ, আমি আপনার আশ্রয় চাই নিফাক, শিরক ও কুফর থেকে।”

নিফাক বা মুনাফিকি ইসলামি সমাজের জন্য এক নীরব ব্যাধি। এটি কেবল ইমান ধ্বংস করে না, বরং সমাজের বিশ্বাস ও বন্ধনকেও দুর্বল করে দেয়। যে মুসলিম সত্যবাদী, আমানতদার ও প্রতিশ্রুতিশীল—সে-ই প্রকৃত ইমানদার। নবীজি (স.) আমাদের সতর্ক করেছেন,  “যার মধ্যে মুনাফিকির বৈশিষ্ট্য আছে, সে যতক্ষণ না তা পরিত্যাগ করে, ততক্ষণ পর্যন্ত মুনাফিকই থেকে যায়।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৪) 

একটি মন্তব্য করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন