খুলনা–২ আসনে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে দলে এখনো বিভক্তি
![]() |
| খুলনা-২ আসনে বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছে সংসদ সদস্য ও মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে | ফাইল ছবি |
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে খুলনা–২ আসনে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে দলের ভেতরে দ্বিধা–বিভক্তি এখনো কাটেনি। সাবেক সংসদ সদস্য ও মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে প্রার্থী ঘোষণা করা হলেও নগর বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব, থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের অনেক নেতা ও তাঁদের অনুসারীরা তা মেনে নিতে পারছেন না। তাঁদের অভিযোগ, নজরুল ইসলাম গত চার বছর ধরে দলীয় ঐক্য নষ্টে ভূমিকা রেখেছেন।
খুলনা–২ আসনে (খুলনা সিটি করপোরেশনের ১৬ থেকে ৩১ নম্বর ওয়ার্ড) মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন নজরুল ইসলাম এবং তাঁর বিরোধী হিসেবে পরিচিত মহানগর বিএনপির সভাপতি শফিকুল আলম (মনা) ও সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম তুহিন। এদের মধ্যে নজরুল ইসলামকেই প্রার্থী হিসেবে বেছে নিয়েছে বিএনপি। অপর দুজন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক ও খুলনা–৩ আসনের মনোনয়ন পাওয়া রকিবুল ইসলাম বকুল এর অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রার্থীদের বিরোধ মিটিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশ দিলেও খুলনা–২ আসনে তা এখনো কার্যকর হয়নি। নগর বিএনপির শীর্ষ দুই নেতার সঙ্গে নজরুল ইসলামের এখনো সরাসরি কথা হয়নি। এমনকি প্রাথমিক মনোনয়ন ঘোষণার পরও ৭ নভেম্বর বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে দুই পক্ষ আলাদা কর্মসূচি পালন করে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম এখন বিভক্ত দুই পক্ষের মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করছেন। গত শুক্রবার রাত আটটা থেকে কেডি ঘোষ রোডের দলীয় কার্যালয়ে তিনি বর্তমান নেতৃত্বের সঙ্গে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা বৈঠক করেন। সেখানে মহানগরের থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা অংশ নেন। বৈঠকে নজরুল ইসলামের প্রার্থিতা নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শুরুতে রকিবুল ইসলাম কেন্দ্রীয় নির্দেশনা ও নির্বাচনী কৌশল তুলে ধরেন এবং ঐক্যের আহ্বান জানান। পরে আলোচনায় নেতারা অভিযোগ করেন, নজরুল ইসলাম দীর্ঘদিন দল থেকে দূরে ছিলেন, তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি এবং বারবার কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করেছেন।
বৈঠকে উপস্থিত এক নেতা বলেন, ‘আমরা রকিবুল ইসলামকে জানিয়েছি, নজরুল ইসলাম মঞ্জু অতীতে জিয়া পরিবার নিয়ে কটূক্তি করেছেন। তাঁকে প্রার্থী হিসেবে মেনে নেওয়া আমাদের জন্য কঠিন। আমরা বলেছি, এই আসনে জিয়া পরিবারের কাউকে বা প্রয়োজনে রকিবুল ইসলাম বকুলকেই প্রার্থী করা হোক।’
অন্য এক নেতা বলেন, ‘নগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর থেকেই মঞ্জু (নজরুল ইসলাম) নিজেকে দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। পরে পদত্যাগ করা কিছু নেতাকে আশ্রয় দিয়ে তিনি বিভক্তি আরও বাড়িয়েছেন। এখন দেখা যাচ্ছে, যাঁরা দল ছেড়েছিলেন, তাঁরাই বিএনপির নামে ব্যানার লাগিয়ে প্রচারণা করছেন। এতে আমাদের মতো তৃণমূল কর্মীদের মনোবল ভেঙে যাচ্ছে। মনোনয়নের আগে অন্তত আমাদের মতামত নেওয়া উচিত ছিল।’
নগর বিএনপির আগের আহ্বায়ক কমিটির এক নেতা বলেন, জাতীয় নির্বাহী কমিটির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম অভিযোগগুলো শুনেছেন। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, বিষয়গুলো কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে তুলে ধরবেন।
খুলনা সদর থানা বিএনপির সভাপতি হুমায়ূন কবির রোববার বিকেলে জানান, দীর্ঘ সময়ের ওই বৈঠকে খুলনার সদর ও সোনাডাঙ্গা থানা বিএনপি, ১৬ থেকে ৩১ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি এবং সব অঙ্গসংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে প্রত্যেক নেতা খুলনা–২ আসনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীকে নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন। দলের কেন্দ্রীয় নেতা রকিবুল ইসলাম তৃণমূলের এই মতামত কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে পৌঁছে দেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি পদ হারান নজরুল ইসলাম। সে সময় আহ্বায়ক করা হয় শফিকুল আলমকে (মনা) এবং সদস্যসচিব করা হয় শফিকুল আলমকে (তুহিন)। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে নজরুল ইসলামের অনুসারীরা খুলনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। তাঁর অনুসারী প্রায় পাঁচ শতাধিক নেতা তখন পদত্যাগ করেন। এরপর নজরুল ইসলামকে কেন্দ্রীয় বিএনপির খুলনা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়। পরে সম্মেলনের মাধ্যমে খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি হন শফিকুল আলম (মনা) এবং সাধারণ সম্পাদক হন শফিকুল আলম (তুহিন)।
তবে নজরুল ইসলাম মঞ্জুর সমর্থকেরা বলেন, দলীয় পদ হারানোর পরও রাজনীতি থেকে সরে যাননি নজরুল ইসলাম। তিনি বিভিন্ন ব্যানারে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছেন এবং তাঁর অনুসারীদের নিয়ে কেন্দ্রীয় কর্মসূচি পালন করেছেন। খুলনায় নানা সমাবেশ, শোভাযাত্রা ও সামাজিক আয়োজনে তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি ছিল নিয়মিত। জুলাইয়ের গণ–অভ্যুত্থানেও তাঁর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।
বিএনপির মনোনীত প্রার্থী নজরুল ইসলামের সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তবে সম্প্রতি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘খুলনায় বিভক্তির রাজনীতির চ্যালেঞ্জ এখনো আছে, আমরা সেটা মোকাবিলা করব। মনোনয়নকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতা শেষ হয়েছে বলে মনে করি। এখন প্রার্থীকেন্দ্রিক রাজনীতিকেই গুরুত্ব দিতে হবে।’
এ বিষয়ে মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম তুহিন বলেন, ‘তৃণমূল নেতারা দলের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে যেকোনো দাবি জানাতে পারেন। শেষ পর্যন্ত আমরা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত মেনেই কাজ করব।’

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন