কৃষ্ণের দাবি ‘সংকেত’ পেয়েছেন, দল বলছে, সিদ্ধান্ত হয়নি
| খুলনা-১ আসনে কৃষ্ণ নন্দীকে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী করা হতে পারে বলে আলোচনা হচ্ছে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনার ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘু অধ্যুষিত’ একটি আসনে জামায়াতে ইসলামী একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রার্থী দিতে পারে, এমন আলোচনা চলছে।
খুলনা-১ (দাকোপ-বটিয়াঘাটা) আসনে জামায়াতের পক্ষ থেকে প্রার্থী হওয়ার সংকেত পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ী কৃষ্ণ নন্দী। তিনি দলটির হিন্দু শাখার ডুমুরিয়া উপজেলা কমিটির সভাপতি।
যদিও দল ইতিমধ্যেই এখানে একজন নেতাকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং তিনি প্রচারও চালাচ্ছেন। জামায়াত বলছে, কৃষ্ণ নন্দীর প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
কৃষ্ণ নন্দীর প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি ডুমুরিয়া, দাকোপ ও বটিয়াঘাটার রাজনৈতিক মহল এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আলোচনার সৃষ্টি করেছে।
স্থানীয়রা জানান, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের ঘনিষ্ঠ এই নেতার বাড়ি ডুমুরিয়ার চুকনগরে। সেখানে তার একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। এর আগে তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য নারায়ণ চন্দ্র চন্দের ঘনিষ্ঠ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন।
গত বছরের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কৃষ্ণ নন্দী ডুমুরিয়া উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর হিন্দু শাখার নেতা হন। এরপর তাকে নির্বাচনি প্রচারে দেখা গেছে।
সম্প্রতি ডুমুরিয়ার এক সভায় কৃষ্ণ নন্দী বলেন, 'আমি ২০০৭ সাল থেকে জামায়াতে ইসলামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। দীর্ঘ সময় সদস্যদের দুঃখ-কষ্টে পাশে থেকেছি। আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়নের সময় নেতাকর্মীদের পাশে ছিলাম। দেড় বছর আগে ডুমুরিয়ায় দলের হিন্দু শাখার সভাপতির দায়িত্ব পাই।'
কৃষ্ণ নন্দীর বাড়ি ডুমুরিয়ায় হলেও প্রার্থী হওয়ার কথা চলছে পাশের দাকোপ-বটিয়াঘাটা আসনে। কারণ, ডুমুরিয়া-ফুলতলা নিয়ে গঠিত খুলনা-৫ আসনের প্রার্থী দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার।
তবে খুলনা-১ আসনে বটিয়াঘাটা উপজেলা জামায়াতে ইসলামী আমির শেখ আবু ইউসুফকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল এবং তিনি প্রচার চালাচ্ছেন।
দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জামায়াতের মনোনয়ন পেতে হলে প্রার্থীকে ন্যূনতম ‘রুকন’ হতে হয়। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসলাম ধর্মের বাইরেও প্রার্থী দেওয়ার বিষয়টি দলের মধ্যে আলোচনা চলছে।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সদস্য ও খুলনা জেলার সেক্রেটারি মুন্সি মিজানুর রহমান মিজান বলেন, 'চলতি মাসের ১৫-১৬ তারিখের দিকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, কিছু এলাকায় আমরা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও উপজাতি প্রার্থী দেব। সেই আলোকে কৃষ্ণ নন্দীর বিষয়ে কিছু আলোচনা চলছে। কেন্দ্র থেকে ইতিমধ্যেই আমাদের প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে, তবে পরে দল প্রার্থী পরিবর্তন করতে পারবে।'
কৃষ্ণ নন্দী দাবি করেছেন, দলের পক্ষ থেকে তাকে ‘ইতিবাচক সংকেত’ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, 'দল যদি আমাকে প্রার্থী ঘোষণা করে, আমি প্রস্তুত। আনুষ্ঠানিক পরিচয় করানোর পর নির্বাচনি এলাকায় যাব।'
অন্য আসনে প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, খুলনা-১ আসনে নিজের বাড়ি না থাকলেও সেখানে তার অনেক স্বজন রয়েছেন।
এদিকে খুলনা-১ আসনে প্রচার চালানো বটিয়াঘাটা উপজেলা জামায়াতে ইসলামী আমির মাওলানা আবু ইউসুফ বলেন, 'প্রার্থী হিসেবে নাম ঘোষণার পর থেকে আমি নির্বাচনি এলাকায় প্রচার চালাচ্ছি। কেন্দ্র থেকে এখনো কোন পরিবর্তন জানানো হয়নি। যদি অন্য কাউকে প্রার্থী করা হয়, তিনিই নির্বাচন করবেন। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানা নেই।'
খুলনা-১ আসনটি হিন্দু অধ্যুষিত। এখানে জামায়াত নেতা শেখ আবু ইউসুফ ১৯৯৬ সালে ভোটে অংশ নেন। পরবর্তী পাঁচটি নির্বাচনে দল এখানে প্রার্থী দেয়নি। তিন দশক পর আবার নির্বাচনি প্রচার চালাচ্ছে।
দলটির নেতাকর্মীরা জানান, প্রথম দফায় খুলনা-৪, খুলনা-৫ ও খুলনা-৬ আসনের প্রাথমিক প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। এরপর চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি বাকি তিন আসনের প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। খুলনা-১ আসনে শেখ আবু ইউসুফের নাম ঘোষণা করা হয়।
ডুমুরিয়া-ফুলতলা নিয়ে গঠিত খুলনা-৫ আসনও হিন্দু অধ্যুষিত। এক বছর ধরে ডুমুরিয়া ও ফুলতলায় জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের বিভিন্ন রাজনৈতিক সমাবেশে কৃষ্ণ নন্দীকে দেখা গেছে। তার নেতৃত্বে প্রতিটি সমাবেশে হিন্দু নারী-পুরুষদের উপস্থিতি চোখে পড়েছে।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক সংসদ সদস্য মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, 'হিন্দু কমিউনিটি ও উপজাতিদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে এমন অনেকেই যোগাযোগ করছেন। খুলনা, কিশোরগঞ্জসহ আরও কয়েকটি জেলা থেকে এমন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। খুলনা থেকে অনেকেই কৃষ্ণ নন্দীর নাম বলছেন। আমরা বিষয়টি নিয়ে ভাবছি, কিন্তু সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি।'
দাকোপ দেশের একমাত্র হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ উপজেলা। এখানে ৫৪.৪৪ শতাংশ বাসিন্দা হিন্দু, ২.১২ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং ৪৩.৪৩ শতাংশ ইসলাম ধর্মের অনুসারী। বটিয়াঘাটার ২৭.৫৬ শতাংশ বাসিন্দা হিন্দু ধর্মের।
খুলনা-১ আসনে ১৯৯১ সাল থেকে জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। বিএনপির প্রার্থী কখনো সুবিধা করতে পারেননি। জামায়াতের শেখ আবু ইউসুফ ১৯৯৬ সালে মাত্র ২,৩০৮ ভোট পেয়ে দুই শতাংশ ভোট পান।
দলের একাধিক নেতা মনে করছেন, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম বর্তমানে সীমিত। এজন্য হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রার্থী দিয়ে জয় নিশ্চিত করতে চায় জামায়াত।
খুলনা-১ আসনে ১৯৯১ সালের পর ১৯৯৬ সালের একতরফা নির্বাচন ছাড়া বিএনপি কখনো জেতেনি। এখানে সব সময় আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র হিন্দু প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। বামপন্থির প্রভাব থাকলেও জামায়াতের অবস্থান সব সময় দুর্বল ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম কিছুটা বেড়েছে।
এখানে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে জেলা কমিটির সাবেক আহ্বায়ক আমীর এজাজ খান প্রচার চালাচ্ছেন। তিনি ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৮ সালে এখানে দলীয় প্রার্থী ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রদল নেতা জিয়াউর রহমান (পাপুল) ও পার্থ দেব মণ্ডল গণসংযোগ করছেন। বাম গণতান্ত্রিক জোটের পক্ষে দাকোপ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান কিশোর কুমার রায়ও আলোচনায় রয়েছেন।
১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখনকার খুলনা-১ আসনটি খুলনা-৫ নামে ছিল। স্বাধীনতার পর এ আসনে প্রথম সংসদ সদস্য হন কুবের চন্দ্র বিশ্বাস। পরের নির্বাচনে জয় পান প্রফুল্ল কুমার শীল। ১৯৯৬ সালের একতরফা নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন প্রফুল্ল কুমার মণ্ডল।
১৯৯৬ সালের জুনে জয়ী হন শেখ হাসিনা। পরে তিনি আসন ছেড়ে দিলে উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান শেখ হারুনুর রশিদ। কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থী পঞ্চানন বিশ্বাস বিজয়ী হন। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের টিকেটে আবার জয়ী হন পঞ্চানন। ২০০৮ সালে জয়ী হন ননী গোপাল মণ্ডল। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে পঞ্চানন বিশ্বাস আবার সংসদ সদস্য হন। ২০২৪ সালে জয়ী হন ননী গোপাল মণ্ডল।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন