বরিশালে বিএনপির ঐক্যের নকশা
বরিশাল মহানগর বিএনপির রাজনীতিতে গত চার বছর ধরে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছিল। এ দ্বন্দ্ব শুরু হয় মহানগর বিএনপির সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ারকে সরিয়ে তাঁর বিরোধী পক্ষকে নিয়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের মাধ্যমে। এই কমিটিতে মজিবরের সমর্থকদের কোনো পদ দেওয়া হয়নি, এমনকি নগরের ৩০টি ওয়ার্ডে তাঁর অনুগত কমিটিও ভেঙে দেওয়া হয়েছিল।
সবকিছুর পরও মজিবর রহমান বরিশাল-৫ (সদর) আসনে আবারও দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। এতে বিবাদমান সব পক্ষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাঁর পক্ষে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বরিশালে জেলা ও মহানগর বিএনপি, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা এক সভায় মিলিত হয়ে ধানের শীষকে বিজয়ী করার অঙ্গীকার জানিয়েছেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বরিশাল নগরের সদর রোডের অশ্বিনী কুমার হলে বিএনপির বরিশাল সদর-৫ আসনের প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ারের সঙ্গে জেলা ও মহানগর বিএনপির যৌথ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভা ঘিরে সকাল থেকেই সদর রোডে বিভিন্ন ওয়ার্ড ও ইউনিটের নেতা-কর্মীরা সমবেত হন। তারা মিছিল নিয়ে অশ্বিনী কুমার হলে পৌঁছে এবং ‘ধানের শীষের বিজয় চাই’, ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’—এসব স্লোগানে এলাকা মুখর করে তুলেন।
সভায় বক্তারা জানান, বরিশাল-৫ আসনে একাধিক প্রার্থী আগ্রহ প্রকাশ করলেও যিনি মনোনয়ন পেয়েছেন, সবাই তাঁর পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন। তারা বলেন, দলের ভেতরে কোনো বিভেদ নেই; সবার লক্ষ্য এক—ধানের শীষকে বিজয়ী করা।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বরিশাল-৫ আসনের প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, 'দেশের মানুষ গত ১৬ বছর ভোট দিতে পারেনি। আজ তারা ভোটের অধিকার ফিরে পেতে মুখিয়ে আছে। সেই অধিকার ফিরিয়ে আনতেই আমাদের সংগ্রাম। ধানের শীষ শুধু একটি প্রতীক নয়—এটি জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতার প্রতীক। যারা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে, মানুষের ভোটাধিকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, তাদের আমরা জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তি দিয়ে জবাব দেব।'
তিনি আরও বলেন, 'বরিশাল বিএনপি সব সময় আন্দোলনের সামনের সারিতে থেকেছে। এবারও আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকব। ধানের শীষের পক্ষে ভোটের ঢেউ ঘরে ঘরে তুলতে হবে।'
মতবিনিময় সভায় বরিশাল নগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খানের সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন মহানগরের সদস্যসচিব জিয়া উদ্দিন সিকদার, জেলা বিএনপির সদস্যসচিব আবুল কালাম, বরিশাল সদর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক নুরুল আমীন, মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি নুরুল আলম প্রমুখ।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর কেন্দ্রীয় বিএনপি মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে। তৎকালীন সভাপতি মজিবর রহমান বাদ দিয়ে তাঁর বিরোধী মনিরুজ্জামান খানকে আহ্বায়ক ও মীর জাহিদুল কবিরকে সদস্যসচিব করা হয়। এরপর ২০২২ সালের ২২ জানুয়ারি ৪১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়। আগের কমিটির ১৭১ সদস্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ নেতারা কেউ স্থান পাননি। নতুন কমিটিকে নিয়ে অন্তত ৩১ নেতা আপত্তি তোলেন। পরে নগরের ৩০টি ওয়ার্ডের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। এতে মজিবরের অনুসারীরা রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েন এবং নগর বিএনপির বিভেদ প্রকট হয়। পরে তাকে যুগ্ম মহাসচিব পদ থেকে সরিয়ে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা করা হয়।
গত বছরের ২৩ জুন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করে ৪ নভেম্বর মনিরুজ্জামান খানকে আহ্বায়ক, জিয়া উদ্দিন সিকদারকে সদস্যসচিব করে ৪২ সদস্যের নতুন কমিটি দেওয়া হয়। এতে আগের আহ্বায়ক কমিটির অনেক নেতা বাদ পড়েন। বাদ পড়া নেতারা মজিবরের অনুসারী পদবঞ্চিত নেতাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আলাদা দলীয় কর্মসূচি পালন করেছেন। সম্প্রতি বিরোধের জেরে একজন যুগ্ম আহ্বায়ককে হেনস্তা করা হয়, একই দিনে বর্তমান ও সাবেক যুগ্ম আহ্বায়কের বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ ওঠে। এসব পরিস্থিতির মধ্যে মজিবর রহমান আবারও দলীয় মনোনয়ন পাওয়ায় বরিশাল বিএনপির রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের অবরোধ ও বিভেদের অবসান হয়েছে।
মজিবর রহমান বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র, একাধিকবার সংসদ সদস্য এবং জাতীয় সংসদের হুইপ ছিলেন। এছাড়া তিনি প্রায় ২০ বছর বরিশাল মহানগর বিএনপির সভাপতি ছিলেন।
নগর বিএনপির সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক তারিন বলেন, 'মজিবর রহমান সব সময়ই বরিশালে ঐক্যবদ্ধ বিএনপি চেয়েছেন, বিভেদ চাননি। এবার মনোনয়ন পাওয়ার পর তিনি বরিশালে এসে সবাইকে নিয়েই কাজ শুরু করেছেন। বৃহস্পতিবারের যৌথ সভায় নগর ও জেলা বিএনপির সব নেতা-কর্মী ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার অঙ্গীকার করেছেন। এভাবেই সব বিভেদের অবসান হয়েছে।'

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন