ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি এখন ধ্বংসস্তূপ
![]() |
| একসময়ের ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি এখন কেবলই ইটের স্তূপ আর আগাছায় ভরা এক ধ্বংসস্তূপ | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
বরেণ্য চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার এক বছর পার হয়েছে। একসময় ঐতিহ্যবাহী সেই বাড়ি এখন কেবল ইটের স্তূপ আর আগাছায় ভরা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে বাকি আছে ভাঙা ইটের পাঁজা এবং কয়েকটি ভাঙা দেয়াল, যেখানে গত বছর আঁকা হয়েছিল ঋত্বিকের একটি পোর্ট্রেট। সেই দেয়াল যেন চুপচাপ এক সাংস্কৃতিক অবহেলার করুণ ইতিহাস বলছে।
রোববার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, খসে পড়া দেয়ালে ‘বাড়ী থেকে পালিয়ে’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘অযান্ত্রিক’—এর মতো সিনেমার নাম ও চিত্রকর্ম আঁকা। তার মধ্যে মোটা ফ্রেমের চশমা পরা ছোট চুলের ঋত্বিক যেন তারই বাড়ির ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকিয়ে আছেন।
এই বাড়ির মাধ্যমে বহু মানুষ রাজশাহীকে চিনেছেন। কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক একবার ঋত্বিকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ দেখার স্মৃতিচারণায় বলেছিলেন, ‘সেই সিনেমা দেখার মুগ্ধতা বুকের মধ্যে মধুর মতো জমে আছে।’ কালের পরিক্রমায় ঋত্বিকের সেই বাড়িই আজ ‘মেঘে ঢাকা তারা’ হয়ে গেছে। স্মৃতি আছে, কিন্তু অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। রাজশাহীর চলচ্চিত্রকর্মীরা চান, এই ধ্বংসস্তূপের ওপরই ঋত্বিকের স্মৃতি সংরক্ষণে টেকসই কোনো উদ্যোগ নেওয়া হোক।
![]() |
| ঋত্বিক ঘটক | গ্রাফিকস: পদ্মা ট্রিবিউন |
ঋত্বিক ঘটক জীবনের শুরুটা কাটিয়েছেন রাজশাহীর এই পৈতৃক বাড়িতে। এখানে থাকার সময় তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজে পড়াশোনা করেছেন। রাজশাহী কলেজ ও মিঞাপাড়ার সাধারণ গ্রন্থাগার মাঠে কালজয়ী কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে নাট্যচর্চাও করেছেন। ওই সময় ‘অভিধারা’ নামে সাহিত্যের কাগজ সম্পাদনা করেছিলেন ঋত্বিক। তার চারপাশে তখন রাজশাহীতে সাহিত্য ও নাট্য আন্দোলন জোরদার হয়েছিল। এ বাড়িতে থেকেছেন ঋত্বিকের ভাইঝি, বরেণ্য কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর মিঞাপাড়ার এই বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়। অভিযোগ ওঠে পাশের রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিরুদ্ধে। তবে কলেজ কর্তৃপক্ষ তখন দাবি করে, তাদের প্রাক্তন কিছু শিক্ষার্থী এ কাজ করেছেন। একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও সুপারিশ বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
বাড়িটির ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ১৯৮৯ সালে এরশাদ সরকার বাড়ির ৩৪ শতাংশ জমি কলেজকে ইজারা দেয়। ২০১৯ সালে এর একাংশ ভেঙে সাইকেল গ্যারেজ তৈরির চেষ্টা হলে দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। পরে ২০২০ সালে জেলা প্রশাসন বাড়িটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায়। বিগত সরকারের একজন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী স্থানটি পরিদর্শন করে প্রতিশ্রুতি দিলেও তা কেবল আশ্বাসেই সীমাবদ্ধ থাকে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাড়িটি ভাঙার পর ২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট রাজশাহীর চলচ্চিত্রকর্মীরা সেখানে জড়ো হলে কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। জেলা প্রশাসন তখন একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে। আট পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকে, প্রাথমিক ভাঙচুরের সঙ্গে কলেজ কর্তৃপক্ষের সরাসরি সম্পৃক্ততা প্রমাণিত না হলেও পরে ‘ঝুঁকি’ দেখিয়ে ভবনের বাকি অংশ ভাঙার বিষয়টি তারা স্বীকার করেছে। এতে ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতি সংরক্ষণে কলেজ কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলা প্রমাণিত হয়েছে, মন্তব্য করেন তদন্ত কর্মকর্তা।
![]() |
| রাজশাহীতে ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক ভিটায় এক পাশে হোমিওপ্যাথিক কলেজ ও হাসপাতাল। অন্য পাশে ধ্বংসস্তূপ। গত রোববার নগরের মিঞাপাড়া এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিবেদনে তিনটি সুপারিশ করা হয়েছিল। এক, ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতিবিজড়িত জায়গাটি স্থানীয় ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটির নামে দেওয়া হোক। দুই, স্থায়ী মালিকানা দেওয়ার আগ পর্যন্ত হোমিওপ্যাথিক কলেজ কর্তৃপক্ষকে এটি সংরক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হোক এবং জন্মশতবার্ষিকী পালনের জন্য জায়গাটি প্রস্তুত করা হোক। তিন, সেখানে ‘ঋত্বিক মঞ্চ’ ও ‘ঋত্বিক সংরক্ষণাগার’ দ্রুত নির্মাণের ব্যবস্থা করা হোক।
কিন্তু এত দিনেও এসব সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি আহসান কবীর বলেন, ‘জমি অনেক পাওয়া যাবে, কিন্তু এমন একটি ঐতিহাসিক বাড়ি আর দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না। আমরা চাই, এই ধ্বংসস্তূপের ওপরই ঋত্বিকের স্মৃতিতে একটি চলচ্চিত্রকেন্দ্র হোক। এটি কোনো সংগঠনের হাতে না দিয়ে সরকারই নিয়ন্ত্রণ করুক, কিন্তু কিছু একটা হোক।’
রাজশাহী জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) টুকটুক তালুকদার বলেন, ‘এখানে ঋত্বিক ঘটককে কেন্দ্র করে কিছু করার পরিকল্পনা আমাদের আছে। স্তূপ হয়ে থাকা ইটগুলো সরানোর নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নানা কারণে তা সম্ভব হয়নি। তবে আমরা সেখানে একটি উদ্যোগ নিতে চাই।’
অবহেলা আর আক্ষেপের মধ্যেই ঋত্বিক ঘটকের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপিত হবে তাঁর পৈতৃক বাড়ির ধ্বংসস্তূপে। আজ মঙ্গলবার বিকেল চারটায় জাতীয় সংগীত, গণসংগীত, প্রদীপ প্রজ্বালন, ঋত্বিক আলোচনা ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে বরেণ্য এই নির্মাতাকে স্মরণ করা হবে।
ঋত্বিক ঘটক ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। আজ তাঁর ১০০তম জন্মবার্ষিকী।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন