নিষেধাজ্ঞার মাঝেও পদ্মার তীরে ইলিশ বেচাকেনা জমজমাট
![]() |
| নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পদ্মা নদীর পাড়ে ইলিশ বিক্রি করছেন জেলেরা। শুক্রবার বিকেলে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার বন্দরখোলার ইউনিয়নের কাজিরসূরা এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
পদ্মার তীরে জেলেদের নোঙর করা কয়েকটি নৌকা। মাঝনদী থেকে আসা জেলেদের এসব নৌকা পাড়ে ভিড়তেই শুরু হয় ক্রেতাদের হাঁকডাক। কেউ জিজ্ঞেস করছেন, ইলিশের কেজি কত? কেউ বলছেন, জোড়া কত? আবার কেউ জানতে চাইছেন, থালায় যা আছে ‘ঠিকা’ কত? এভাবেই দরদাম করে জেলেদের কাছ থেকে ব্যাগভরে ইলিশ কিনছেন ক্রেতারা।
এ দৃশ্য গতকাল শুক্রবার বিকেলে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার পদ্মা নদীবেষ্টিত বন্দরখোলা ইউনিয়নের কাজিরসূরা এলাকার। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে প্রকাশ্যে বসে অস্থায়ী ইলিশের হাট। এ ছাড়া বন্দরখোলা, মাদবরেরচর, চরজানাজাত ও কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নের আরও অন্তত চারটি এলাকায়ও এভাবে ইলিশ কেনাবেচা চলছে।
শিবচর উপজেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে কাজিরসূরা এলাকায় ইলিশ কিনতে এসেছিলেন ব্যবসায়ী দেলোয়ার সাঈদ। তিনি বলেন, ‘বাজারে তো ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। নিষেধাজ্ঞার সময় পদ্মার পাড়ে তাজা ইলিশ কম দামে পাওয়া যায়। তাই এখানে আসছি। এখানে ছোট-বড় সব ধরনের ইলিশ আছে। আমার মতো অনেকেই ঠিকায় মাছ কিনছে।’
মা ইলিশ রক্ষায় ৪ থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশ শিকার, ক্রয়, পরিবহন ও সংরক্ষণ নিষিদ্ধ করেছে সরকার। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে মৎস্য কর্মকর্তাদের পাশাপাশি নৌ পুলিশ, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অংশ নিচ্ছেন।
তবু এর মধ্যেই পদ্মায় অবৈধভাবে ইলিশ শিকার চলছে। সরকারি নিষেধাজ্ঞার পরও কেন ইলিশ কিনছেন—এমন প্রশ্নে ব্যবসায়ী দেলোয়ার সাঈদ বলেন, ‘এত আইন দিয়ে তো কেউ আর চলে না। আমরা আগেও এখানে আসছি, ইলিশ কিনে চলে গেছি। কেউ তো কিছু বলে নাই। তাহলে এখন আপনারা এসব বলছেন কেন?’
![]() |
| জেলেদের নৌকা পাড়ে ভিড়তেই ক্রেতাদের হাঁকডাক শুরু হয়ে যায়। শুক্রবার বিকেলে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার বন্দরখোলা ইউনিয়নের কাজিরসূরা এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
ছোট–বড় মিলিয়ে আটটি ইলিশ ১ হাজার ৩০০ টাকায় কিনেছেন ইকবাল হোসেন নামের আরেক ক্রেতা। তিনি বলেন, ‘সবার মতো আমরাও এখানে মাছ কিনতে এসেছি। ১ হাজার ৩০০ টাকার মাছ কিনেছি। নিষেধাজ্ঞার মধ্যে জেলেরা মাছ ধরে বিক্রি করতে আসেন, তাই আমরা মাছ কিনি। জেলেরা না এলে তো আমরা মাছ কিনতে আসতাম না।’
শিবচর উপজেলা মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ইলিশের প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে পদ্মা নদীর ১২ কিলোমিটার এলাকায় অভিযান চালাচ্ছে শিবচর মৎস্য বিভাগ। যৌথ বাহিনীর তিনটি দল ২৪ ঘণ্টাই নদীতে অভিযান চালাচ্ছে। গত ১৩ দিনে অভিযান চালিয়ে ৭ লাখ ৪০ হাজার মিটার কারেন্ট জাল ধ্বংস করা হয়েছে। এ ছাড়া ৪৩ জেলেকে আটক করে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও ২ লাখ ৪১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জব্দ করা ৩৭০ কেজি ইলিশ বিভিন্ন মাদ্রাসা ও এতিমখানায় বিতরণ করা হয়েছে।
এবার শিবচর উপজেলায় কার্ডধারী ২ হাজার ৬৮০ জেলেকে ২৫ কেজি করে মোট ৬৭ মেট্রিক টন চাল দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে পদ্মা নদীর তীরের পাঁচটি ইউনিয়নে আছেন ১ হাজার ৪৯৪ জন জেলে।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, পদ্মায় নিয়মিত অভিযান হলেও তা বেশ ঢিলেঢালা। নদীবেষ্টিত এসব হাটে পুলিশ ও প্রশাসনের তদারকি নেই। তাই জেলেরা সুযোগ বুঝে মাছ ধরে এনে প্রকাশেই হাটে বিক্রি করছেন।
এ বিষয়ে শিবচর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা সত্যজিৎ মজুমদার বলেন, ‘গত সোমবার কাজিরসূরাসহ বিভিন্ন অস্থায়ী হাটে সেনাবাহিনী নিয়ে আমরা অভিযান করেছি। এখন আবার সেখানে হাট বসেছে। আবারও আমরা অভিযান চালাব। কাজিরসূরাতেই মূল ইলিশের হাট বসে। সীমিত লোকবল নিয়ে তো সব ধরনের অভিযান করা সম্ভব নয়।’
পদ্মায় নিয়ম করে অভিযান চললেও তা অনেকটা ঢিলেঢালা। নদীবেষ্টিত হাটগুলোয় পুলিশ ও প্রশাসনের তদারকি নেই। জেলেরা সুযোগমতো মাছ শিকার করে তা অনেকটা প্রকাশ্যেই বিক্রি করছেন।
গতকাল বিকেলে পদ্মা নদীর শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নের চরচান্দ্রা, চরজানাজাত ইউনিয়নের পদ্মার বুকে জেগে ওঠা হিরা খাঁরঘাট, মাদবরেরচর ইউনিয়নের পুরোনো কাওড়াকান্দি ফেরিঘাট, একই ইউনিয়নের বড়বাড়ির পেছনে পুরানকান্দি এলাকা ও বন্দরখোলা ইউনিয়নের কাজিরসূরা বাজারসংলগ্ন নদীর পাড় ঘুরে দেখা যায়—এসব অস্থায়ী হাটে জেলেরা নৌকা নিয়ে আসছেন। নৌকায় বসেই ইলিশ বিক্রি করছেন পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে। ওই বিক্রেতারা নদীর পাড়ে ডালি সাজিয়ে মাছ বিক্রির জন্য বসেছেন। সেখান থেকে সাধারণ ক্রেতারা দরদাম করে কিনছেন ইলিশ। পুরুষের পাশাপাশি অনেক নারীও এসেছেন ইলিশ কিনতে।
এসব হাটে ইলিশ কেজি ছাড়াও সংখ্যা বা জোড়া হিসেবেও বিক্রি হচ্ছে। এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ জেলেরা বিক্রি করছেন ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায়, আর ছোট ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৫৫০ টাকা কেজিতে।
কাজিরসূরা এলাকার জেলে আব্বাস মাদবর বলেন, ‘আমরা কার্ড পাই না, চাউল পাই না, কোনো সাহায্য–সহযোগিতা পাই না। তাই বাধ্য হয়ে ইলিশ ধরতে আসছি। মাছ না ধরলে খাব কী? পুলিশ আসে, ধাওয়া দেয়। এর মধ্যেই আমরা ঝুঁকি নিয়ে জাল ফেলি।’
![]() |
| এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
ইলিশ বিক্রেতা মো. মাসুদ নামের আরেক জেলে বলেন, ‘গাঙের পাড়ে মানুষ আসে। আমরা জেলেদের থেকে মাছ কিনে বেচি। পুলিশ আসলে সবাই পালিয়ে যায়। পরে আবার আসে। এভাবেই চলছে।’
শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এইচ এম ইবনে মিজান বলেন, ‘মা ইলিশ রক্ষায় আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। অস্থায়ী হাটগুলো কিছুটা দুর্গম এলাকায়, আবার সেখানে প্রচুর মানুষের ভিড় থাকে—তাই অভিযান চালানো কঠিন। সেনাবাহিনী নিয়ে একবার হাটগুলো ভেঙে দিয়েছি। এরপরও ইলিশ কেনাবেচা চলছে।’
ইউএনও আরও বলেন, ‘এবার আমরা ক্রেতাদের ঠেকাতে চেকপোস্ট বসানোর উদ্যোগ নিয়েছি। ইতিমধ্যে দুজন ক্রেতাকে আটক করে জরিমানা করা হয়েছে। জেলেদের পাশাপাশি যাঁরা মাছ কিনতে আসবেন, তাঁদেরও আমরা আইনের আওতায় আনব।’
জানতে চাইলে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘পদ্মা নদীর পশ্চিম অংশে আমরা সকাল, বিকেল ও রাতে অভিযান চালিয়েছি। ইতিমধ্যে আটটি ট্রলার ও একটি স্পিডবোট জব্দ করা হয়েছে। ৪৩ জেলেকে আটক করা হয়েছে। ইলিশ রক্ষায় নদীতে ২৪ ঘণ্টা অভিযান ও পাহারা দরকার ছিল। কিন্তু লোকবল কম থাকায় সেটা সম্ভব হচ্ছে না।’



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন