হাসিবুর রহমান
![]() |
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-জাকসু ভবন | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
তেত্রিশ বছর পর আন্দোলনের মুখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলেও নির্ধারিত তারিখে ভোট হবে কি না, তা নিয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।
ভোটের দাবি থাকলেও কোনো ছাত্র সংগঠনই নিরুত্তাপ বা শর্তহীন অবস্থানে নেই। বরং প্রত্যেক সংগঠনই তাদের দাবিদাওয়ার বিষয়ে অনড়।
নানা মতবিরোধ, দাবি-দাওয়া আর ভিন্ন অবস্থানের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে নির্বাচনের প্রক্রিয়া। ফলে অনেকেই মনে করছেন, এসব সংকট কাটিয়ে প্রশাসন কতটা সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে, তার ওপরই নির্ভর করছে দশম জাকসুর ভবিষ্যৎ।
বিশেষ করে গত ৫ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর ‘আওয়ামী লীগের দোসরদের বিচার’ দাবি উঠেছে। অনেক শিক্ষার্থী মনে করছেন, এই ইস্যুকে জাকসু নির্বাচনের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলা জটিলতা আরও বাড়িয়েছে।
ইতিমধ্যে তফসিল ও ভোটের তারিখ দুইবার পেছানো হয়েছে। সর্বশেষ ৩১ জুলাই ভোটগ্রহণের দিন ধার্য হলেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে এখনও সন্দেহ কাটেনি—আসলে নির্ধারিত দিনে ভোট হবে তো?
তফসিল ঘোষণার পর প্রায় ছয় সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও ক্যাম্পাসে নির্বাচনী উত্তাপ তেমন দেখা যাচ্ছে না। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন এখনো আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু করেনি। যদিও নেতারা বলছেন, প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।
নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার কথা উঠে এসেছে নির্বাচন কমিশনের সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক মাফরুহি সাত্তারের বক্তব্যেও।
তিনি বলেন, 'যেহেতু তিন দশকের বেশি সময় ধরে জাকসু নির্বাচন হয়নি, তাই সবাই এখনো অনভিজ্ঞ। এই অনভিজ্ঞতা নিয়ে নির্বাচন করা কঠিন। শিক্ষকদের মধ্যেও সহনশীলতা কম দেখা যাচ্ছে। প্রশাসন ও আবাসিক হলগুলোতেও অতীতের ‘ফ্যাসিবাদী’ ধাঁচের কাঠামো এখনো অনেক ক্ষেত্রে রয়ে গেছে।'
তবে নির্বাচন কমিশনের সদস্যসচিব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক রাশিদুল আলম মনে করেন, ভোট আয়োজন সম্ভব।
তার ভাষায়, 'বর্তমানে নির্বাচন করার মত পরিবেশ রয়েছে। আগের চেয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। সবার সহযোগিতা থাকলে নির্ধারিত দিনে শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ সম্ভব বলে আমি বিশ্বাস করি।'
অবশেষে রোডম্যাপ
৫ আগস্টের আন্দোলনের পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জাকসু নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে গিয়ে অন্তত দুইবার পিছিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের লাগাতার দাবির মুখে গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে রোডম্যাপ প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এর ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়। এরপর ১৩ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসানের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধি দল।
বৈঠক শেষে উপাচার্য সাংবাদিকদের জানান, রোডম্যাপ অনুযায়ী ১ ফেব্রুয়ারি তফসিল ঘোষণা করা হবে। তবে নির্ধারিত তারিখে তা সম্ভব হয়নি।
পরবর্তীতে তফসিল ঘোষণা ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাব্য তারিখ জানায়। সেই হিসেবে ৩০ এপ্রিল তফসিল ঘোষণার কথা থাকলেও, ভোটের জন্য নির্ধারিত হয় ২১ মে’র বদলে ৩১ জুলাই।
এদিকে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে কর্তৃপক্ষ খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে, গঠন করেছে পরিবেশ পরিষদ। হলে হলে মতবিনিময় সভার মাধ্যমে অংশীজনদের মতামত নিয়ে গঠনতন্ত্রেও আনা হয়েছে কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন।
তবে এতসব প্রস্তুতির পরও নির্বাচন আদৌ নির্ধারিত দিনে হবে কি না—তা নিয়ে সংশয় এখনো কাটেনি অনেক শিক্ষার্থী ও শিক্ষক মহলে।
জাকসুর ইতিহাসে দুই নেতা হত্যাকাণ্ডের শিকার
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ—জাকসুর প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৭২ সালে। সেই নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন গোলাম মোর্শেদ এবং জিএস ছিলেন রোকনউদ্দীন। ভিপি সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তবে ছিলেন বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী। অন্যদিকে রোকনউদ্দীন জাসদ ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন।
এরপর ১৯৯২ সালের ৬ জুলাই অনুষ্ঠিত হয় নবম এবং এখন পর্যন্ত সর্বশেষ জাকসু নির্বাচন। সেই নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন মাসুদ হাসান তালুকদার এবং জিএস হন শামসুল তাবরীজ। দুজনই ছিলেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
জাকসুর নির্বাচিত নয়জন ভিপি ও জিএসের মধ্যে দুজন দায়িত্বে থাকা অবস্থায় নিহত হন। এদের একজন ১৯৭২ সালের জিএস রোকনউদ্দীন। অন্যজন ১৯৭৩ সালের জিএস মোজাম্মেল হক।
রোকনউদ্দীনের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন কলা ভবনের সামনে স্থাপন করা হয়েছে একটি পাঠাগার—‘রোকন স্মৃতি গ্রন্থকেন্দ্র’। এটি পরিচালনা করে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের একটি অংশ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী এবং পরে একই বিভাগের অধ্যাপক নুরুল হক জানান, 'রোকনউদ্দীন জিএস থাকা অবস্থায় একদিন মোটরসাইকেলে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ যাচ্ছিলেন। চাষাঢ়ায় গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি নিহত হন। তার মরদেহ ঘটনাস্থল থেকেই উদ্ধার করা হয়।'
অধ্যাপক নুরুল হক আরও জানান, '১৯৭৩ সালের জাকসু নির্বাচনে তিনি নিজেও ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী ছিলেন। সে নির্বাচনে জয়ী হন মোজাম্মেল হক, যিনি ছিলেন মুজিববাদী ছাত্রলীগের নেতা।'
তার স্মৃতিচারণে উঠে আসে, 'জিএস থাকাকালীন মোজাম্মেল হককে বিশ্ববিদ্যালয়ের আল বেরুনী হলের নিজের কক্ষে জানালা দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, খুনিরা চলে যাওয়ার সময় সর্বহারা পার্টির স্লোগান দেয়।'
![]() |
জাকসু নির্বাচন ও ‘ফ্যাসিবাদের দোসরদের’ বিচারের দাবিতে এক শিক্ষার্থীর আমরণ অনশন | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
জিএস: রোকন উদ্দিন
জিএস: মোজাম্মেল হক
জিএস: দোলোয়ার হোসেন
জিএস: আতাউর রহমান
জিএস: সামসুদ্দিন মাসুদ
জিএস: আজিজুল হাসান চৌধুরী
জিএস: মো. আজগর হোসেন
জিএস: কে এম রাশেদুল হাসান
জিএস: শামসুল তাবরীজ
![]() |
৩০ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
নির্বাচন ও বিচারের দ্বৈরথ
গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্রিয় ছাত্রসংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে প্রশাসনের ভেতরে থাকা 'আওয়ামী লীগের দোসর' এবং ‘স্বৈরাচারী সুবিধাভোগীদের’ বিচারের দাবি উঠে আসে। সংগঠনগুলোর মতে, আগের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত না করে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
তবে এ নিয়ে সংগঠনগুলোর অবস্থানে একমত হলেও কৌশলে রয়েছে ভিন্নতা। কেউ বলছে—‘বিচার আগে, নির্বাচন পরে’; কেউ বলছে—‘দুটো একসঙ্গে চলতে পারে’; কেউ আবার ইসলামী ছাত্রশিবিরের অংশগ্রহণ নিয়েই আপত্তি তুলেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর বলেন, 'ছাত্রদলের প্রাণের দাবি জাকসু নির্বাচন। আমরা ভোটের জন্য প্রস্তুত। খসড়া তালিকাও প্রস্তুত। কিন্তু প্রশাসন এখনো আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানো ছাত্রলীগ ও সংশ্লিষ্ট দোসরদের বিচারের আওতায় আনতে পারেনি। সেই সঙ্গে হলগুলোতে ছাত্রলীগ নেতাদের দাপট অব্যাহত।'
তিনি আরও বলেন, 'যতক্ষণ না বিচার নিশ্চিত হচ্ছে, ততক্ষণ নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়।'
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আবদুর রশীদ জিতু বলেন, 'নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাকে আমরা ইতিবাচক মনে করি। তবে তার আগে জুলাইয়ের ঘটনায় জড়িত শিক্ষক, কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীদের বিচারের আওতায় আনাটা খুব জরুরি। আশা করছি, জুনের মধ্যেই তদন্ত শেষ করে প্রশাসন আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেবে।'
ইসলামী ছাত্রশিবির জাবি শাখার সেক্রেটারি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'জাকসু নির্বাচন ও বিচারপ্রক্রিয়া একসঙ্গে চলতে পারে। প্রশাসনের এখতিয়ারভুক্ত শাস্তিগুলো দ্রুত কার্যকর হওয়া উচিত, না হলে এটিকে নির্বাচনী প্রতারণা বলেই মনে হবে।'
ছাত্র ইউনিয়নের (অমর্ত্য অংশ) সভাপতি অমর্ত্য রায় বলেন, 'জাকসু এবং বিচার—দুটোরই প্রয়োজন আছে। একটি যেন আরেকটির মুখাপেক্ষী না হয়। বিচার ধীরগতিতে হলে জাকসুর কার্যকারিতা হারাবে। তাই আমরা চাই, নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন হোক।'
ছাত্রফ্রন্টের জাবি শাখার সংগঠক সজিব আহমেদ বলেন, 'আমরা প্রশাসনকে বলেছি—জাকসু নির্বাচন এবং বিচার দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু ভোটের তারিখ ৩১ জুলাই, তার আগেই বিচার শেষ করা সম্ভব।'
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও বিচার কার্যক্রম তদারক কমিটির প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, 'আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে যাতে জুনের মধ্যেই বিচার কার্যক্রম শেষ হয়। সময় লাগলে অংশীজনদের সঙ্গে আবারও আলোচনায় বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।'
জাকসু রোডম্যাপ ঘোষণার শুরু থেকেই ইসলামী ছাত্রশিবিরের অংশগ্রহণ নিয়ে বিতর্ক চলে আসছে। নির্বাচন যত এগোচ্ছে, আপত্তিও তত বাড়ছে।
২৯ এপ্রিলের পরিবেশ পরিষদের সভায় শিবিরের উপস্থিতিতে সভা বর্জন করেন বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রির সংগঠক সোমা ডুমরি ও ছাত্রফ্রন্ট (একাংশ)-এর সংগঠক সোহাগী সামিয়া। একই সভায় জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের একাংশের সভাপতি ফাইজা মাহজাবিন বলেন, 'যদি নির্বাচনে শিবির অংশ নেয়, তাহলে আমরা তাতে আপত্তি জানাব।'
![]() |
১৯৯১ সালের ৬ জুলাই অনুষ্ঠিত জাকসু নির্বাচনের ছাত্রদলের প্যানেল পোস্টার। |
‘সন্দেহ’
বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী ঐন্দ্রিলা মজুমদার অর্ণা বলেন, '৩০ ডিসেম্বর রোডম্যাপ অনুযায়ী মে মাসেই নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। এখন তারিখ পিছিয়ে ৩১ জুলাই করা হয়েছে। সেই তারিখেও নির্বাচন হবে—এমন নিশ্চয়তা কোথায়? প্রশাসনকে আমরা জাকসু নির্বাচন নিয়ে সন্দেহভাজন হিসেবেই দেখি।'
১৯৯৩ সালের জাকসুর মাধ্যমে সিনেটে নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জামাল উদ্দিন রুনু। তিনি বলেন, 'সব নির্বাচনই যেন সুষ্ঠু হয়, সেটাই প্রত্যাশা। কিন্তু ফ্যাসিস্ট শাসনের রেখে যাওয়া কাঠামো দিয়ে নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হবে, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।'
তিনি আরও বলেন, 'রাষ্ট্র বা বিশ্ববিদ্যালয় কেউই এখনও বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে পারেনি। আগে একটি সমতাভিত্তিক (লেভেল প্লেয়িং) পরিবেশ তৈরি করতে হবে—সেটআপ বদলাতে হবে, বিচার সম্পন্ন করতে হবে। এরপরই নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব।'
১৯৯২ সালের জাকসুতে শহীদ সালাম-বরকত হল সংসদের সমাজসেবা সম্পাদক ছিলেন দর্শন বিভাগের অধ্যাপক মোস্তফা নাজমুল মানছুর। তিনি বলেন, 'আগে রাজনীতি অনেক গঠনতান্ত্রিক ছিল। ভিপি-জিএসসহ পুরো প্যানেল নির্ধারণ হতো কাউন্সিলের মাধ্যমে। এখনকার বাস্তবতায় সেটি কতটা সম্ভব?'
তিনি আরও বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরে দেশে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচনের চর্চা নেই। এই অনভ্যাসের কারণে নির্বাচন সঠিকভাবে করা কঠিন হবে। আনাড়ি লোক দিয়ে নির্বাচন পরিচালিত হলে তা গ্রহণযোগ্যতা হারাতে পারে। আমার মতে, প্রশাসনের আরও কিছু প্রস্তুতির সময় নেওয়া উচিত।'
![]() |
১৯৯১ সালের ৬ জুলাই অনুষ্ঠিত জাকসু নির্বাচনের ছাত্রদল জয়লাভ করে। সেই সংবাদ তখনকার সংবাদমাধ্যমে। |
হলে হলে মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থী
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের নোটিস থাকলেও তারা দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে হলে অবস্থান করছে। এই পরিস্থিতি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে ভোটের পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নিয়ে।
শিক্ষার্থীরা জানান, সহস্রাধিক মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থী দীর্ঘ সময় ধরে হলে অবস্থান করছেন। ৫ অগাস্টের আগে তারা ছাত্রলীগের নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ছিলেন। পরে আবার একইভাবে আন্দোলনকারী ছাত্র সংগঠনের নেতাদের আশ্রয় পেয়ে হলের আসন নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক ও জাবি শিক্ষার্থী তৌহিদ সিয়া বলেন, 'মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে ফ্যাসিবাদী আমল থেকে আমরা দীর্ঘ আন্দোলন করেছি। অভ্যুত্থানের পরও প্রশাসন এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। এই অবস্থা নির্বাচনের পরিবেশ ও নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।'
তিনি আরও বলেন, 'বিশেষ করে হল সংসদ নির্বাচনের জন্য এটি আরও খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করবে। তাই প্রশাসনকে ব্যাচভিত্তিক দ্রুত মেয়াদোত্তীর্ণদের ব্যাপারে কঠোর হওয়া উচিত।'
ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের (একাংশ) সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইমন বললেন, 'আগের প্রশাসনও মেয়াদোত্তীর্ণদের বিরুদ্ধে নোটিস দিয়েছিল, এই প্রশাসনও তাই করছে। কিন্তু এই বিষয়েই বোঝা যায় প্রশাসন আসলে জাকসু নির্বাচন করতে চায় না।'
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাধ্যক্ষ কমিটির সভাপতি ও পরিবেশ পরিষদের সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, 'হলগুলোতে প্রায় এক হাজারের বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থী অবস্থান করছে। কেউ এক বছর, কেউ দুই বছর, আবার কেউ তিন বছর ধরে সেখানে আছেন। প্রশাসন বারবার নোটিস দিলেও তারা হল ছাড়ছে না।'
তিনি আরও জানান, 'মেয়াদোত্তীর্ণরা জুনিয়রদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে নানা সমস্যা সৃষ্টি করছে। হল প্রশাসন এই ইস্যু মোকাবেলায় বৈরি পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। নির্বাচন চলাকালীন এমন অবস্থা হলে নির্বাচন মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হতে পারে।'
অধ্যাপক নজরুল বলেন, '৩০ জুনের মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগ নিশ্চিত না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন সম্ভব নয়।'
![]() |
১৯৭২ সালের জাকসুর নির্বাচিত প্রথম জিএস রোকনউদ্দীন হত্যার শিকার হন। তার স্মরণে বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ‘রোকন স্মৃতি গ্রন্থকেন্দ্র’ | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর ভোট নেই
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) গঠনতন্ত্রে সম্প্রতি সংস্কার হলেও এমফিল, জিআইএস অ্যান্ড আইআরএস মাস্টার্স ও আইবিএ-জেইউ মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকারে রাখা হয়নি। এ সংক্রান্ত সংশোধিত গঠনতন্ত্র ২৬ এপ্রিল বিশেষ সিন্ডিকেট সভায় পাস হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সদস্যসচিব ও এমফিল গবেষক ওয়াসিম আহমেদ অনিক অভিযোগ করেন, 'সর্বশেষ উপাচার্য আনোয়ার স্যারের সময় যখন জাকসুর তফসিল ঘোষিত হয়েছিল, তখন এমফিলের শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকার ছিল। কিন্তু বর্তমান প্রশাসন আমাদের ভোটাধিকার রাখেনি।'
তিনি বলেন, 'আমরা এখান থেকেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছি। দীর্ঘ ৩৩ বছর ধরে নির্বাচন হয়নি; এত বছর পর ভোটাধিকার প্রয়োগের আশা করাই স্বাভাবিক। আশা করি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিষয়টি সুনজরে দেখবে।'
অন্যদিকে, জাকসুর গঠনতন্ত্র পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংস্কার কমিটির প্রধান উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান বলেন, 'এমফিল বা অন্যান্য মাস্টার্স শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকারে রাখা হয়নি কারণ তাদের পক্ষ থেকে কোনও আবেদন আসেনি।'
এ মন্তব্যের প্রেক্ষিতে ওয়াসিম অনিক বলেন, 'জাকসুর অংশগ্রহণকারী সভায় অনার্স-মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের ডাকা হলেও এমফিল শিক্ষার্থীদের ডাকা হয়নি। তাই আমরা মতামত বা আবেদন করতে পারিনি। আমাদের ভোটাধিকারের জন্য যদি আদালতের পথ নিতে হয়, আমরা প্রস্তুত।'
![]() |
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-জাকসু ভবন | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
ভবনের ভগ্নদশা
৩৩ বছর বন্ধ থাকার পরও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) ভবন এখন সম্পূর্ণ ভগ্নদশায়। ভবনটি বর্তমানে নোংরা, অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ নয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
শিক্ষার্থীরা জানান, নিয়মিত এখানে মাদকাসক্তদের আসর বসে, যার কারণে ভবনটি অনেকে ভীতির জায়গায় পরিণত হয়েছে। মেডিকেল সেন্টারের পাশে অবস্থিত এই ভবনের পরিবেশ খুবই দূর্ভোগজনক।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, ভবনটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৭২ সালে। ১৯৯২ সালের নবম জাকসু নির্বাচনের পর থেকেই এটি বন্ধ রয়েছে।
সম্প্রতি ভবন পরিদর্শন করা হলে দেখা যায়, বাইরের নামফলক ফিকে ও অস্পষ্ট, ভেতরে কোনো আসবাবপত্র নেই, বৈদ্যুতিক সংযোগও বিচ্ছিন্ন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী ও ছাত্র অধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নাজিরুল ইসলাম বলেন, 'জাকসু ভবন যেন এক কলঙ্কিত স্মারক। পাশের লেক থেকে উঠে আসা দুর্গন্ধ আর জলাবদ্ধতায় ভবনের আশপাশের পরিবেশ একেবারে নরকে পরিণত হয়েছে।'
উপাচার্য ও বর্তমান জাকসুর সভাপতি অধ্যাপক কামরুল আহসান জানান, 'ভবনটি পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শীঘ্রই সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে।'